ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

রুনা তাসমিনা

ভোরের স্নিগ্ধতা নিয়ে সকাল হবে

প্রকাশিত: ১২:০১, ১৯ জুলাই ২০১৯

 ভোরের স্নিগ্ধতা নিয়ে  সকাল হবে

‘ভুলনা আমায়’ কিংবা ‘সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে’ রেশমি চুড়ি পরা হাতে সুঁই-সুতার নিপুণ কারুকাজে এক সময় ঘরের দেয়ালে শোভা হয়ে থাকত এসব শ্লোক। কুরশীর কাঁটায় বোনা বাবা, ভাই, স্বামী কিংবা ছেলের গায়ের গেঞ্জি অথবা উলে বোনা সোয়েটার ছিল গৃহস্থালি কাজের বাইরে মেয়েদের কাজ। নিজের গুণটাকে বা প্রতিভাকে প্রকাশ করার হাতের পারদর্শিতার পথটিই খোলা ছিল একমাত্র। খেলাধুলা স্বাস্থ্যের জন্য খুব জরুরী হলেও ওই সময়ে মেয়েদের জন্য খেলাধুলা নিষিদ্ধই ছিল বলা যায়। বলা হতো বেশি ছুটোছুটি করলে মেয়েদের সতী পর্দা ছিঁড়ে যায়। দাম্পত্য জীবন সন্দেহ দিয়ে শুরু হয়, অথবা ভেঙে যায়। তাই দৌড়ঝাঁপ থেকে মেয়েদের বিরত রাখা হতো। হাতের কাজের প্রশিক্ষণ দিত ঘরের বয়োজ্যেষ্ঠরা। সুঁই-সুতার কারুকাজে হাতপাখা, বিছানার চাদর, ওয়ালমেট ইত্যাদি বানানো, কিংবা উল, কুরশীতে সোয়েটার, গেঞ্জি, টেবিলের চাদর এসবেই মেয়েরা ছিল অভ্যস্ত। সময়ের বিবর্তনের সঙ্গে ধীরে ধীরে বদলাতে লাগল কিছু পরিবারের চিন্তাভাবনা। মেয়ে শিশু-কিশোরী বাড়ির আঙিনায় ঁিচ-খুঁত খঁত, গোল্লাছুট, দড়ি, কানামাছি খেলার জন্য অনুমতি পেত। তবুও বাবা কিংবা ভাই মেয়ে, বোনের জন্য খেলনা কিনতে গেলে পুতুলই কিনে দিত। তাকে একটি সিম্বলিক খেলনা দিয়ে বুঝিয়ে দিত, সে মেয়ে। পুতুল খেলতে খেলতে মেয়েটি নিজের অজান্তে শিখে যেত ঘরকন্যা। ব্যতিক্রমধর্মী কিছু পরিবার আরেকটু এগিয়ে থেকে তারা অনুমতি দিত তাদের মেয়ে সন্তানদের স্কুলের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় দড়ি, স্মরণশক্তি পরীক্ষা, মিউজিক্যাল চেয়ার, সুঁই-সুতা প্রতিযোগিতা মেয়েদের জন্য নির্ধারিত ছিল। প্রসঙ্গত বলা যায়, সুঁই-সুতা প্রতিযোগিতা পরোক্ষে ইঙ্গিত একটি মেয়ের প্রজন্মের ঐতিহ্য ধরে রাখার। তবে আশার কথা এই- সময় বদলেছে। এখন পরিবার থেকে মেয়েরা পাচ্ছে অনুপ্রেরণা নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার। শিক্ষাঙ্গন, সাহিত্যাঙ্গন, খেলাধুলা, অফিস-আদালত কোথায় নেই মেয়েদের বিচরণ! এভারেস্টের চূড়া থেকে সাগরের জাহাজে মেয়েরা রাখছে সাফল্যের স্বাক্ষর। ঘর সামলানোর পাশাপাশি পরিবারে সচ্ছলতা আনার জন্য স্বামীর সঙ্গে ধরছে সংসারের হাল। একজন নারী একহাতে সামলাচ্ছে ঘরের পাশাপাশি তার কর্মক্ষেত্র। এই চিত্র বিংশ শতকের প্রথম দিকের। বর্তমান সময়ের দিকে তাকালে খুব হতাশ হয়ে দেখতে পাই, বীভৎস এক চিত্র। খবরের কাগজ খুললেই প্রতিদিন পড়তে হচ্ছে নারী নির্যাতনের খবর। সে নয় বছরের হোক বা নব্বই বছরের। ধর্ষণ, হত্যা যেন প্রতিযোগিতা দিয়ে বাড়ছে প্রতিদিন। আমাদের ছোট্ট সোনামণি মেয়েটি নিজের লিঙ্গ বুঝে উঠার আগেই শিকার হচ্ছে চাচার মতো আপনজনের বিকৃত যৌন নির্যাতনের শিকার। ভালবেসে ঘরবাঁধার স্বপ্ন দেখা সেই পুরুষটিই হচ্ছে প্রেমিকার ধর্ষক! হত্যাকারী! ঘর, রাস্তা, অফিস কোথাও নিরাপদ নয় মেয়েরা। প্রীতিলতা, বেগম রোকেয়া, একাত্তরের বীরাঙ্গনার দেশে এমন হওয়ার কথা তো ছিল না! তবু কেন হচ্ছে? মায়ের দুধের ঘ্রাণ এখনও তো তেমনই আছে। তবুও কীভাবে এই মায়ের বুকে বড় হয়ে ওঠা কিশোর, যুবক, প্রৌঢ় পুরুষটি পশুর চাইতেও জঘন্য হয়ে উঠছে? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর নিশ্চয় আছে। আমরা সন্তানকে বেশি স্বাধীনতা দিয়ে ফেলছি অপ্রাপ্ত বয়সে। খবর রাখছি না সে কোথায়, কার সঙ্গে মিশছে। তার রাত করে বাড়ি ফেরার উত্তরে সে যা বলছে তা-ই শুনছি। একবাক্যে বলতে গেলে বলতে হয়, আমরা অভিভাবকের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করছি না কেউই। আমাদের, বিশেষ করে মায়েদের একটু সচেতনতা পুরো সমাজকেই বদলে দিতে পারে। নিজের ছেলেকে রক্ষা করতে পারে অপরাধ জগতে পা দেয়ার আগেই। কোন সমস্যাই সমাধান না নিয়ে আসে না। আমরা পেরেছি, পারব আবার আশার আলো জ্বালতে। সংসার তথা বিশ্ব হবে কন্যা, জায়া, জননীর জন্য নিরাপদ। ধুয়ে যাবে সমস্ত ময়লা-আবর্জনা। নারীরা আবার ভালবেসে তার প্রিয়তম পুরুষের জন্য লিখবে ‘ভুলনা আমায়’ কিংবা অফিস থেকে ফেরা স্বামীটি হাসিমুখে তাকাবে ‘সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে’ লেখাটির দিকে। বিংশ শতকের পৃথিবীতে মেয়েদের স্থান, মায়েদের স্থান, স্ত্রীদের স্থান সম্মানের সঙ্গে মূল্যায়ন হবে। ভোরের স্নিগ্ধতা নিয়ে আবার সকাল হবে নারীদের জীবনে।
×