ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বাগদি শিশুদের নিরন্তর সংগ্রাম

ইঁদুরের গর্তে শাবল চালিয়ে ধান সংগ্রহ করে ওরা

প্রকাশিত: ১০:১২, ২০ জুলাই ২০১৯

ইঁদুরের গর্তে শাবল চালিয়ে ধান সংগ্রহ করে ওরা

ইফতেখারুল অনুপম॥ গৃহস্থরা ধান কেটে নেয়ার পর ক্ষেতের গর্তের ধান নিয়ে ইঁদুরের সঙ্গে নিরন্তর লড়াই বাগদিদের। তাতে যোগ দেয় শিশুরাও। এজন্য স্কুল কামাই দেয় ওরা। শাবল চালিয়ে ইঁদুরের গর্ত খুঁড়ে ধান ওঠায় ওরা। মাটি কাদায় লেপ্টে থাকা একগুচ্ছ ধানের শীষ টেনে বের করতেই চিক শব্দে লাফিয়ে বেড় হয় জোড়া ল্যাংড়া ইঁদুর। শপাং করে শাবলের গুঁতোয় ছেঁচে দিল দুটোকেই। আবার গর্ত খোঁড়াখুঁড়ি। মূল ভান্ডারে গচ্ছিত ইঁদুরের সঞ্চিত ধান। পুরোটাই ওদের চাই। এ ধানে পিঠা হবে। হবে খেসারি ডালের খিচুড়ি। তাই স্কুল কামাই করে প্রাণান্তকর চেষ্টা। টাঙ্গাইলের গোপালপুর উপজেলার ঝাওয়াইল সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণীর শিক্ষার্থী ননী আর সূচনার এমন কথাই বলছিলাম। দুজন পিসাতো ভাই বোন। ঝাওয়াইল-পাকুটিয়া সড়কের অদূরে ধানি জমিতে দেখা মেলে ওদের। ননীর বাবা রতন চন্দ্র। সূচনার বাবা নিত্য চন্দ্র। সম্প্রদায়ে বাগদি। বাংলাদেশের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর একটি। ননী জানায়, ধানকাটা মৌসুমে বড়দের সঙ্গে ইঁদুরের গর্ত খুঁড়তে ছোটরাও শামিল হয়। ক’দিন ধরে বড়রা ধান কাটার কামলা আর লাকড়ি চেরা হয়ে ব্যস্ত। পিঠা খেতে চাইলে মায় কইলো ‘চরায় যা। ধান নিয়ে আয়গে। তবেই পিঠা হইবো।’ সূচনা জানায়, মামি বলছে ‘ধান আইনলে খেসারি ডাইলে খিচুড়ি অইবো। তাই আইছি।’ ননী গর্ত থেকে ধানের ছড়া টেনে বের করে। আর সূচনা গায়ের ফ্রকের নিচের অংশ টেনে আলগা করে তা পুরে রাখে। শুধু ননী আর সূচনা নয়। ধানকাটা মৌসুমে টাঙ্গাইলের গোপালপুর উপজেলার সব বাগদি পল্লীর একই চিত্র। গৃহস্থরা ধান কেটে নেয়ার পর ক্ষেতের গর্তের ধান নিয়ে ইঁদুরের সঙ্গে নিরন্তর লড়াই বাগদিদের। তাতে যোগ দেয় শিশুরাও। ইঁদুরের গর্তের ধানকে ওরা বলে ‘রাজার ধন’। ঝাওয়াইল বাগদি পল্লীতে গিয়ে দেখা যায়, মাত্র ৪০ শতাংশ খাস জমিতে ৩৫ ঘর বাগদির গাদাগাদি করে বসবাস। দিন আনে দিন খায়। কামলা খাটে, লাকড়ি চেরাই, সেলুন বা হোটেলে কাজ করে। পাড়ার দিগেন বাগদি (৭০) জানান, ইংরেজ শাসনামলে স্থানীয় জমিদাররা ভারতের বিহার ও উড়িষ্যা থেকে বাগদিদের আনেন। যতীন বাগদি জানান, পূর্ব পুরুষদের বলা হয়েছিল, ‘তোরা বাংলা মুলুকে যাবি, বড় চাকরি করবি, ভাল খাবার পাবি, রাজবাড়ির আঙ্গিনায় বউ-বাচ্চা নিয়ে সুখে থাকতি পারবি।’ কিন্তু সে স্বপ্ন অধরাই থেকে যায়। জোটে লাঠিয়ালী, ঢুলি, পালকি বাহক বা পেয়াদাগিরির কাজ। নায়েব কাচারির পাশেই খাস জমিতে গড়ে ওঠে বাগদী পল্লী। কেটেছে দেড় শতক। বংশ পরম্পরায় ষষ্ঠ উত্তর পুরুষের ঠিকানাও সেই খাসভিটা। জমিদারি প্রথা বিলুপ্তির পর বেকার হয়ে যায় বাগদীরা। ঢুলি বা পালকি চালিয়ে টিকেছিল কোনভাবে। কিন্তু যান্ত্রিক বাহনের দাপটে ঢুলি পালকি উঠে যায়। শুরু হয় অর্থনৈতিক টানাপোড়ন। মাথা গোঁজার যে ঠাঁই সেটিও খাসভিটে। স্বপন বাগদী জানান, এরশাদ আমলে প্রভাবশালীরা বাগদী পল্লীতে অগ্নিসংযোগ করে তাদের উচ্ছেদ করে। পরে ভারতীয় দূতাবাসের হস্তক্ষেপে একাংশ ছেড়ে আপোস করতে হয়। বহু চেষ্টাতেও বসতভিটার খাসজমি লিজ নিতে পারেনি। এজন্য সব সময় তারা উচ্ছেদ আতঙ্কে থাকেন। রতন বাগদী জানায়, পেটে ভাত জোটে না। পরনে কাপড় থাকে না। বাচ্চাদের লেখাপড়া শেখানোর সাধ্য নেই। এজন্য বাগদী শিশুরা পেটের দায়ে স্কুল কামাই করে ধান সংগ্রহে মাঠ থেকে মাঠে ঘুরে বেড়ায়। দুই দশক আগেও পাড়ার সবার পেশা ছিল গর্তের ধান আর জঙ্গলের আলু সংগ্রহ। এখন জঙ্গল কমে যাওয়ায় বন আলু আর মিলে না। সংগ্রহ করা ধানে অনেকের দুতিন মাসের খোরাকি হয়। পাড়ার গোবিন বাগদী জানায়, ‘লেখাপড়া শিখে কি অইবো। আমাগো পাড়ায় দুজন ম্যাট্রিক পাস দিছে। কোথাও চাকরি অইছে না। ছোট জাত শুনলে কেউ চাকরি দিতি চায় না।’ বাগদী নেতা সুনীল জানান, টাঙ্গাইলের গোপালপুর ছাড়াও ভুঞাপুর, ঘাটাইল, ধনবাড়ী, মধুপুর ও নাগরপুর এবং জামালপুরের সরিষাবাড়ি, মেলান্দহ ও জামালপুর সদর উপজেলায় প্রায় পাঁচ হাজার বাগদী পরিবারের বসবাস। সবাই প্রান্তিক জনগোষ্ঠী। তারা বর্ণ হিন্দুদের কাছে অচ্ছুত। মুসলিমদের কাছে ছোটজাত। চায়ের দোকান বা হোটেলে ওদের জন্য রয়েছে আলাদা থালাগ্লাস বা কাপপিরিচ। বসার জায়গাও আলাদা। স্কুলে গেলেও ছোটজাত বলে একসঙ্গে খেলতে চায় না সহপাঠীরা। এজন্য হীনম্মন্যতায় ভোগে শিশুরা। লেখাপড়ায় হয় অমনোযোগী। ‘স্কুল তাদের জন্য আনন্দ গৃহ নয়’ জানান পাড়ার লক্ষ্মী বাগদী। বাগদীরা সনাতন ধর্মাবলম্বী হলেও দুর্গাপূজায় অংশগ্রহণের অধিকার নেই তাদের। তারা মনসা ও কালিপূজা করে। তাদের বিবাহ, যৌনজীবন ও সন্তান লালনপালনে নিজস্ব বৈশিষ্ট্য রয়েছে। বিয়ে শাদিতে যৌতুক অপরিহার্য। পূজা ও বিয়েতে মদ আবশ্যিক। সংরক্ষণের অভাবে হারিয়ে যাচ্ছে ওদের প্রাচীন ভাষা, সংস্কৃতি। গোপালপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বিকাশ বিশ্বাস জানান, সরকার ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীর শিশুদের সরকারী ভাতা দিয়ে থাকে। এছাড়া সরকার তাদের শিক্ষা, চিকিৎসা সেবা প্রদানসহ অন্যান্য সহযোগিতা সবসময়ই করে থাকে।
×