ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

বাঁধ ভেঙ্গে প্লাবিত কমলগঞ্জ

প্রকাশিত: ০৮:৩২, ২১ জুলাই ২০১৯

  বাঁধ ভেঙ্গে প্লাবিত কমলগঞ্জ

প্রকৃতির দানে ভরপুর ১৮৭.৩৬ বর্গমাইল এলাকার চতুর্দিকে রাজকান্দি পাহাড় ও ১৪টি চা বাগান বেষ্টিত বাংলাদেশের বহুজাতিসত্তার আবাসভূমি, পর্যটন আকৃষ্ট হাম হাম জল প্রপাত, মাধবপুর লেক, নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর বাহারি জীবন, লাউয়াছড়ার একমাত্র রেইন ফরেস্ট, বিভিন্ন প্রজাতির বিরল পশুপাখির বিচরণ স্থল, কাঠ, আনারস, লেবুসহ বিভিন্ন জাতের ফল, সবজি ও খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ এবং পান, চা, বাঁশজাত দ্রব্য, মণিপুরীদের হাতে তৈরি কাপড় ইত্যাদি পণ্য রতানিকারক একমাত্র উপজেলা কমলগঞ্জ আজ বন্যাকবলিত। প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর প্রায় ২ লাখ মানুষের এই ছোট জনপদের ওপর দিয়ে মাত্র কয়েক মাইলব্যাপী বয়ে চলা কমলগঞ্জের দুঃখ ধলাই নদী, প্রতি বছর পার ভেঙ্গে ভাসিয়ে নিয়ে যায় ঘর-বাড়ি, চাষকৃত ধান, শাক-সবজির বাগান, ভেঙ্গে দিয়ে যায় কৃষকের স্বপ্ন, ধ্বংস করে যায় কৃষকের চাষ করা পুকুরের মাছ, আবর্জনাপূর্ণ ময়লা পানিতে ভরে যায় এলাকার পানির উৎস পুকুর, পানিতে ডুবে যায় বাড়ির পিট ল্যাট্রিন, মানুষের মলমূত্র, পশুর মলমূত্র একসঙ্গে মিশে একাকার হয়ে যায়। এই পরিবেশে মানুষের জীবনযাপন যে কত কষ্টকর তা নিজে না ভুগলে উপলব্ধি করা কঠিন। এই অবস্থায় নেই বাথ রুমে যাওয়ার স্থান, নাই রান্না করার জায়গা, পরিবারের মা ও শিশুরা যে কি এক অমানবিক জীবনযাপন করেন তা ভাষায় বর্ণনা করা কঠিন। কোথায় রান্না করবে, কিভাবে রান্না করবে, লাকড়ি পাবে কোথায়, না খেয়েই শুকনা খাবার যা পাওয়া যায় তাই খেয়ে জীবন বাঁচায়। বন্যার পানি চলে যাওয়ার পর রান্না ঘরে, ভেজা লাকড়ি দিয়ে বাঁশের তৈরি চুঙ্গা দিয়ে ফুঁ দিতে দিতে ডাল-ভাত রান্না করা যে কত কষ্টকর তা মায়েরা মুখ ফুটে বলে না, শুধু ছেলেমেয়েদের মুখের দিকে চেয়ে, ভবিষ্যতের সুখের আশায়, কষ্ট সহ্য করে যায়। গত রোববার বিকেলে আদমপুর ইউনিয়নের হকতিয়ারখোলা ও রহিমপুর ইউনিয়নের বিষ্ণুপুর গ্রামে ধলাই প্রতিরক্ষা বাঁধে ২টি নতুন ভাঙন দেখা দিয়েছে। অতিবৃষ্টির ফলে উজান থেকে আসা পাহাড়ী ঢলে কমলগঞ্জের ঘোড়ামারা, কেওয়ালীঘাট, রূপসপুর, রাধাগোবিন্দপুর, মহেশপুর, শ্রীরামপুর, দক্ষিণ ধুপাটিলা, পালিতকোনা, রসুলপুর, বনবিষ্ণুপুর, গোপীনগর, রশিদপুর, নোয়াগাঁও, চন্দ্রপুর, কোনাগাও, বনবিষ্ণুপুর, রায়নগর, রামপুর, রামচন্দ্রপুর, হরিস্মরণ, জালালপুর, জগন্নাথপুর, প্রতাপী, কান্দিগাঁও, রামপাশা, কুমড়াকাঁপন, রামপুর, বিষ্ণুপুর. নারায়ণপুর, কান্দিগাঁও, গঙ্গানগর, হকতিয়ারখোলা, কেওয়ালীঘাট, জালালপুর, বন্দরগাঁও, সতিঝিরগাঁও, মারাজানের পার, রাধানগর, হরিপুর প্রভৃতি গ্রামই ধলাই নদীর বাঁধভাঙ্গা পানির স্রোতে প্লাবিত হয়। ধলাই নদীর পানি বেড়ে প্রতিরক্ষা বাঁধে নতুন ও পুরনো ভাঙ্গন দিয়ে কমলগঞ্জের পৌরসভা, রহিমপুর, আদমপুর, পতনঊষার, মুন্সীবাজার ও শমশেরনগর, কমলগঞ্জ সদর ইউনিয়নের মোট ১১৫টি গ্রাম বন্যায় প্লাবিত হয়েছে। শুক্রবার দিবাগত রাত দুটোয় কমলগঞ্জ পৌরসভার রামপাশা এলাকায় বাঁধ ভেঙ্গে যায়। ৮ ও ৯ নম্বর ওয়ার্ড প্লাবিত হয়। বিকেলে রহিমপুর ইউনিয়নের প্রতাপী এলাকায় পুরনো ভাঙ্গন দিয়ে পানি প্রবেশ করে আশপাশের গ্রাম প্লাবিত হয়। হাট-বাজার, নলকূপ, স্কুল ঘর, বাড়ি-ঘর পানিতে সয়লাব হয়ে গেছে। রাস্তাঘাটসহ দোকানপাট সব পানিতে নিমজ্জিত। ধলাই নদীর যদি স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ করা হতো তাহলে কমলগঞ্জবাসীকে এই দুর্ভোগ প্রতি বছর সহ্য করতে হতো না। এই বন্যায় কৃষকের মেরুদন্ড একেবারে ভেঙ্গে দিয়ে যায় যা সোজা করতে বছর লেগে যায়, যখন মেরুদন্ড একবার সোজা হয় ঠিক তখনই আবার বন্যায় ধ্বংস করে দিয়ে যায় শস্য ও ধান, তাই প্রতি বছর বন্যার কারণে ১০০শ’ ভাগ কৃষিনির্ভর মণিপুরী বাঙালীসহ সব সম্প্রদায়ের জনগোষ্ঠীর অর্থনৈতিক মেরুদন্ড একেবারে ভেঙ্গে দিয়ে যায়। তাই আর কালবিলম্ব না করে কমলগঞ্জের মানুষকে এই প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে বাঁচানোর জন্য ধলাই নদীর ওপর প্রতি বছর বালির বাঁধ মেরামত না করে স্থায়ী পাকা বাঁধ তৈরি করে দিলে এবং ধলাই নদীকে খনন করে ভরাট মাটি এবং বালি অপসারণ করে দিলে নদীর নাব্য এবং পানির ধারণক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে এবং নদীর কিনারা ভেঙ্গে পানি বাইরে আসার সম্ভাবনা কমে আসবে। স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসের অংশ ও এই ধলাই নদী, পাকিস্তান সেনাবাহিনী যখন ১৯৭১ সালে মে মাসের প্রথম সপ্তাহে নিরীহ নাগরিকদের ওপর হামলা করার জন্য শেরপুর থেকে শমসেরনগর বিমান ঘাঁটির দিকে আসছিল তখন মুক্তিযোদ্ধারা চৈত্রঘাটে অবস্থিত ধলাই নদীর ওপর নির্মিত ব্রিজটি ডিনামাইট দিয়ে ভেঙ্গে দিলে সেদিন কমলগঞ্জের মানুষ হানাদার বাহিনীর হাত থেকে রক্ষা পায়। ধলাই নদীর পাদদেশে অবস্থিত ধলাই বর্ডার আউট পোস্ট এলাকায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও মুক্তি বাহিনীর সঙ্গে প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়। স্বাধীনতার পর থেকে বহুবার ধলাই নদীর পানির প্রবল স্রোত বাঁধ ভেঙ্গে বন্যার প্লাবনের সময় আমরা ও বহু দিন কাটিয়েছি এবং বন্যাপীড়িত মানুষের কষ্ট নিজ চোখে দেখেছি ও উপলব্ধি করেছি বিধায় আজকে তাদের এ অবস্থা থেকে চিরতরে মুক্তি দেয়ার জন্য দেশের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে আকুল আবেদন রাখছি। এই নদী দীর্ঘদিন ধরে ভরাট হয়ে বৃষ্টির সময় পানি ধরে রাখার মতো গভীরতা হারিয়ে ফেলেছে তাই প্রতি বছর দু’বার বন্যা প্লাবিত হয় এই উপজেলা, উপজেলা প্রশাসন ভাল করেই জানেন এই দুঃখের কাহিনী, উপজেলা চেয়ারম্যান ভাল করে জানেন কমলগঞ্জের ধলাই নদী বছর বছর কীভাবে এলাকার মানুষের জীবনকে বিপর্যস্ত করে তুলে। বন্যার পর প্রত্যেক বছর মাটি এবং বালি দিয়ে তাসের ঘরের মতো হাল্কা বাঁধ নির্মাণ করে দায়িত্ব শেষ করেন পানি উন্নয়ন বোর্ড ও উপজেলা প্রশাসন। পরবর্তী সময়ে আর তাদের খোঁজ থাকে না। এই হলো দীর্ঘদিনের ইতিহাস। এই ইতিহাসের যবনিকা সমাপ্ত করতে হলে, উর্ধতন কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে জরিপ করে ধলাই নদীর কিনারায় স্থায়ী পাকা বাঁধ নির্মাণসহ নদী খননের ব্যবস্থা করলে এই সমস্যা থেকে এই জনগোষ্ঠীকে বাঁচানো সম্ভব অন্যথায় মেরুদণ্ডহীন এই উপজেলার মানুষ আস্তে আস্তে হারিয়ে যাবে প্রকৃতির নির্মমতার কাছে। ধলাই নদীকে ঘিরেই যে এই এলাকার মানুষের জীবন ও জীবিকা নির্ভর করত তার প্রমাণ পাওয়া যায় ধলাই নদীর পারে অবস্থিত মণিপুরী জনগোষ্ঠীর বসবাস দেখে। ভারতের মণিপুরী স্টেট থেকে যখন এই সম্প্রদায়ের মানুষ কমলগঞ্জে বসবাস শুরু করেন তখন এই ধলাই নদীকে কেন্দ্র করেই কিন্তু গড়ে উঠেছিল এই মণিপুরীদের বাসস্থান। অধিকাংশ মণিপুরী গ্রাম তাই নদীর কিনারায় অবস্থিত।
×