ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

ঢাকা দক্ষিণ সিটি এবার ৩৭০৮ কোটি টাকার বাজেট প্রস্তুত করেছে

প্রকাশিত: ০৯:৩১, ২১ জুলাই ২০১৯

ঢাকা দক্ষিণ সিটি এবার ৩৭০৮ কোটি টাকার বাজেট প্রস্তুত করেছে

মশিউর রহমান খান ॥ ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন নাগরিকদের জীবনমান উন্নয়নে ২০১৯-২০ অর্থবছরের জন্য প্রায় তিন হাজার ৭০৮ কোটি টাকার বাজেট প্রস্তুত করেছে (ডিএসসিসি)। চলতি মাসে যে কোন সময় সংবাদ সম্মেলন করে এ প্রস্তাবিত বাজেট ঘোষণা করবেন মেয়র সাঈদ খোকন। ডিএসসিসি সূত্র জনকণ্ঠকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। প্রস্তাবিত এ বাজেটে বিভিন্ন খাতে আয়-ব্যয় বৃদ্ধি করা হয়েছে। একই সঙ্গে সুযোগ থাকা সত্ত্বেও কয়েকটি খাতে কোন রাজস্ব আয়ই ধরা হয়নি। এর বাইরে অতি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হিসেবে ধরা হলেও মশার ওষুধের জন্য বরাদ্দ আগের তুলনায় কম রাখা হবে বলে জানা গেছে। বর্তমানে ঢাকা মহানগরে ডেঙ্গুজ্বর ভয়ানক আকারে ছড়িয়ে পড়ে ডেঙ্গুতে মানুষ মরতে থাকলেও এ খাতে বরাদ্দ গত বছরের তুলনায় কম রাখা কতটুকু যৌক্তিক হবে তা নিয়ে নগর বিশেষজ্ঞদের মাঝে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। অপরদিকে সিটি কর্পোরেশনের নতুন যুক্ত হওয়া সীমানায় মশা মারতেও বর্তমানের তুলনায় অধিক অর্থের প্রয়োজন হবে। প্রস্তাবিত বাজেটে গত অর্থবছরের চেয়ে প্রায় ১শ’ কোটি টাকা বাড়িয়ে তিন হাজার ৭০৭ কোটি ৮৯ লাখ টাকার বরাদ্দ রাখা হয়েছে। বাজেটে রিক্সা লাইসেন্স ফি আদায়, জবাইখানা ইজারা বাবদ ফি ও শিশু পার্ক দর্শনার্থী ফি বাবদ কোন আয় ধরা হয়নি। অর্থাৎ চলতি বছর নতুন করে আর কোন রিক্সার লাইসেন্স দেবে না সংস্থাটি। এছাড়া বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে নতুন জবাইখানা নির্মাণ করে স্বাস্থ্যকর পদ্ধতিতে পশু জবাই ও জীবাণুমুক্ত মাংস নিশ্চিতে উদ্যোগ নেয়ার কথা থাকলেও এ খাতে সংস্থাটি কোন আয়ই ধরেনি বলে জানা গেছে। তার মানে নতুন করে কোন পশু জবাইখানা নির্মাণ করা হবে না বা পশু জবাইখানা ইজারা বাবদ রাজস্ব আয় হবে না। ফলে যত্রতত্র পশু জবাই করা বৃদ্ধি পাবে ও জীবাণুমুক্ত মাংস পাওয়ার নাগরিক প্রত্যাশা বেশ বাধার মুখে পড়বে। বাজেটের উল্লেখযোগ্য ব্যয়ের মধ্যে মশক নিধন কার্যক্রম বাবদ গত অর্থবছরে ছিল ২৬ কোটি টাকা। এ বছর গত বছরের তুলনায় নতুন করে সীমানা বাড়লেও যুক্ত হওয়া আটটি ইউনিয়নে মশা মারতে বরাদ্দ না বাড়িয়ে উল্টো কমানো হয়েছে। বর্তমান বাজেটে তা ২৫ কোটি ৩০ লাখ টাকা বরাদ্দ ধরা হয়েছে। গত বাজেটের তুলনায় ৭০ লাখ টাকা কম বরাদ্দ ধরা হয়েছে, যা অনেকটাই বিস্ময়ের সৃষ্টি করেছে। প্রস্তাবিত বাজেটে আয়ের খাত সম্পর্কে বলা হয়েছে, প্রারম্ভিক স্থিতি ১২২ কোটি ৫০ লাখ টাকা। রাজস্ব আয়ের মধ্যে কর বাবদ ৩শ’ ৪০ কোটি টাকা, বাজার সালামি ৩১০ কোটি টাকা, যা বিভিন্ন মার্কেট নির্মাণ বাবদ আয় করা হবে। বাজার ভাড়া ৩৫ কোটি টাকা যা মার্কেটের ভাড়া হিসেবে পাওয়া যাবে। ট্রেড লাইসেন্স ফি ৯০ কোটি টাকা ধরা হয়েছে। প্রায় ২ লাখ ট্রেড লাইসেন্সধারীর কাছ থেকে এ টাকা আদায় করা হবে। তবে ডিএসসিসি সূত্র জানায়, ট্রেড লাইসেন্স ফি না বাড়ালেও সরকারের গেজেটে উৎসে কর বাধ্যতামূলকভাবে বর্তমানে ৫ শ’ টাকা প্রদান করতে হয়। সরকারের নিয়মানুযায়ী তা প্রায় ৬ গুণ বেশি অর্থাৎ ট্রেড লাইসেন্সের জন্য উৎসে কর বাধ্যতামূলকভাবে প্রতি ব্যবসায়ীকে ৩ হাজার টাকা করে দিতে হবে। ফলে ডিএসসিসির ধার্য ট্রেড লাইসেন্স ফি বাবদ অর্থ আদায় করা অনেক কঠিন হয়ে পড়বে বলে রাজস্ব শাখা সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। বাজেটে প্রমোদ কর বাবদ ৪০ লাখ টাকা, বিজ্ঞাপন কর বাবদ ৭ কোটি টাকা ধরা হয়েছে। ডিজিটাল বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে এ আয় আরও কয়েকগুণ পর্যন্ত বৃদ্ধি করার সুযোগ থাকলেও অজ্ঞাত কারণে তা কম ধার্য করা হয়েছে। বাস-ট্রাক টার্মিনাল থেকে ৩ কোটি ৫০ লাখ টাকা, কোরবানি উপলক্ষে অস্থায়ী পশুরহাট থেকে ১০ কোটি টাকা, ইজারা (টয়লেট, পার্কিং, কাঁচাবাজার ইত্যাদি) বাবদ ২ কোটি ৫০ লাখ টাকা ধরা হয়েছে। এছাড়া রাস্তা খনন ফি বাবদ ৩০ কোটি টাকা, যন্ত্রপাতি ভাড়া ৮ কোটি টাকা, বিভিন্ন ফরম বিক্রি থেকে ২ কোটি টাকা, কমিউনিটি সেন্টার ভাড়া বাবদ ২ কোটি ৫০ লাখ টাকা ধরা হলেও নতুন কয়েকটি আধুনিক সুবিধাসম্পন্ন কমিউনিটি সেন্টার নির্মাণ করা হচ্ছে। আগামী অর্থবছরের মধ্যেই এসব সেন্টার নির্মাণ কাজ শেষ হবে। ফলে এ বাবদ আয় বর্তমানের চেয়ে অনেক বেড়ে যেতে পারে। কবরস্থান ও শ্মশানঘাট বাবদ ৫০ লাখ টাকা, সম্পত্তি হস্তান্তর কর বাবদ ১০০ কোটি টাকা, ক্ষতিপূরণ (অকট্রয়) বাবদ এক কোটি টাকা, পেট্রোল পাম্প বাবদ ৩ কোটি টাকা ও অন্যান্য (ভূমি, নাট্যমঞ্চ, ছিন্নমূল ও নগর ভবন ইত্যাদি) বাবদ ২ কোটি টাকা আয় ধরা হয়েছে। এসব খাত থেকে মোট রাজস্ব আয় ধরা হয়েছে ৯৫৭ কোটি ৪০ লাখ টাকা। অপরদিকে অন্যান্য আয়ের মধ্যে অপ্রয়োজনীয় ও অব্যবহার্য সম্পদ বিক্রি ও অন্যান্য বাবদ ৫০ লাখ টাকা, ঋণ গ্রহণ ৩০০ কোটি টাকা, ঋণ আদায় এক কোটি ১৭ লাখ টাকা, স্থায়ী আমানতের সুদ থেকে এক কোটি টাকা, বিলুপ্ত ডিসিসির স্থিতি থেকে ৩ কোটি টাকা। এই খাত থেকে ৮ কোটি ৬৭ লাখ টাকা আয় ধরা হয়েছে। এছাড়া সরকারী ও বৈদেশিক উৎসের মধ্যে সরকারী মঞ্জুরি থেকে ৪৪ কোটি টাকা, সরকারী বিশেষ মঞ্জুরি থেকে ৩০ কোটি টাকা, সরকারী ও বৈদেশিক সহায়তামূলক প্রকল্প থেকে দুই হাজার ৫শ’ ৪৫ কোটি ৩২ লাখ টাকা আয় ধরা হয়েছে। এই খাতটি থেকে মোট দুই হাজার ৬শ’ ১৯ কোটি ৩২ লাখ টাকা আয় ধরা হয়েছে। সব মিলিয়ে এবারের বাজেটের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে তিন হাজার ৭০৭ কোটি ৮৯ লাখ টাকা। বাজেটের উল্লেখযোগ্য ব্যয়ের মধ্যে মশক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম বাবদ ২৫ কোটি ৩০ লাখ টাকা বরাদ্দ ধরা হয়েছে, যা গত অর্থবছরে ছিল ২৬ কোটি টাকা। এবছর এখাতে ৭০ লাখ টাকা বরাদ্দ কমানো হয়েছে। কর্মচারীদের প্রতিদান (বেতন, ভাতা ও অন্যান্য) বাবদ ৩৫০ কোটি টাকা, বিদ্যুত, জ্বালানি, পানি ও অন্যান্য বাবদ ৭৪ কোটি, মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ বাবদ ৩৩ কোটি টাকা, সরবরাহ বাবদ ২৯ কোটি ১৭ লাখ টাকা, ভাড়া, রেটস ও কর বাবদ ৭ কোটি টাকা, কল্যাণমূলক ব্যয় ৪২ কোটি ৯০ লাখ টাকা, ভ্রমণ ও যাতায়াত বাবদ ৫ লাখ টাকা, ডাক,তার ও দূরালাপনী বাবদ ২০ লাখ টাকা, আতিথেয়তা বাবদ এক কোটি ৫০ লাখ টাকা, বিজ্ঞাপন ও প্রচার বাবদ ৫ কোটি ৫০ লাখ টাকা, ফি বাবদ ১২ কোটি ৫০ লাখ টাকা, প্রশিক্ষণ ও বিভিন্ন সংস্থার চাঁদা বাবদ ৩ কোটি ২০ লাখ টাকা, বীমা বাবদ এক কোটি টাকা, বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় বিশেষ উদ্যোগ বাবদ ১৩ কোটি ৫০ লাখ টাকা, উচ্ছেদ কার্যক্রম বাবদ ২০ লাখ টাকা ও বিবিধ ব্যয় ধরা হয়েছে ১০ লাখ টাকা। এসব খাতে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ৫শ’ ৯৯ কোটি ১২ লাখ টাকা। ঋণ পরিশোধ ও মামলা সংক্রান্ত ব্যয় ১ কোটি ৫০ লাখ টাকা, সালামি ফেরত ৫০ লাখ টাকা, গৃহ নির্মাণ ও অন্যান্য অগ্রিম বাবদ ৫০ লাখ টাকা। এসব খাতে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ২ কোটি ৫০ লাখ টাকা। উন্নয়ন ব্যয়ে নিজস্ব উৎস থেকে ৪৬০ কোটি ৯৫ লাখ টাকা ও সরকারী ও বৈদেশিক সহায়তামূলক প্রকল্প থেকে দুই হাজার ৫শ’ ৪৫ কোটি ৩২ লাখ টাকা। এসব খাতে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ৩ হাজার ৬ কোটি ২৭ লাখ টাকা। আর সমাপনী স্থিতি থেকে ব্যয় ধরা হয়েছে ১০০ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে বাজেটে ৩ হাজার ৭০৭ কোটি ৮৯ লাখ টাকা বাজেট আয় ও ব্যয় ধরা হয়েছে। এদিকে উপকর চালুর জন্য মেয়রের দীর্ঘদিন যাবত সরকারের কাছে দাবি থাকলেও প্রস্তাবিত বাজেটে উপকর নিয়ে কোন প্রস্তাব করা হয়নি। শুধু এই উপকর প্রথা চালু হলে সিটি কর্পোরেশনের রাজস্ব আয় কয়েকগুণ বৃদ্ধি পেত। এছাড়া বাজেটে এক কোটি টাকা অকট্রয় খাতে (ক্ষতিপূরণ খাতে) ধরা হলেও তা বাস্তবায়ন হতে দেখা যায় না। তাই অকট্রয় খাতের অর্থ বরাদ্দ অন্য খাতে যোগ করার বা নির্ধারিত খাত বাস্তবায়নের দাবি জানিয়েছে নগর বিশ্লেষকরা। এদিকে প্রস্তাবিত বাজেট প্রকাশ না করায় এ নিয়ে কোন কর্মকর্তা মুখ খুলতে রাজি হয়নি।
×