ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

শিক্ষার সঙ্গে সংস্কৃতির সম্মিলন এখন সময়ের দাবি

প্রকাশিত: ১০:১৯, ২১ জুলাই ২০১৯

 শিক্ষার সঙ্গে সংস্কৃতির সম্মিলন এখন সময়ের দাবি

মনোয়ার হোসেন ॥ সংস্কৃতির গতিশীলতার নেপথ্যে রয়েছে শিক্ষা। আবার শিক্ষার প্রকৃত উদ্দেশ্য পূরণ করে সংস্কৃতি। তাই শিক্ষার সঙ্গে সংস্কৃতির সম্পর্কটা খুবই ঘনিষ্ঠ। তবে দেশের প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা ঘটেনি সংস্কৃতির। বার্ষিক অনুষ্ঠান ছাড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও তেমনভাবে হয় না সংস্কৃতিচর্চা। সংস্কৃতিজনরা বলছেন, শিক্ষা গ্রহণ পদ্ধতিতে ভীষণভাবে অবহেলিত সংস্কৃতি। অথচ মানবিক মানুষ গড়তে প্রয়োজন শিক্ষার সঙ্গে সংস্কৃতির সংযোগ। শিক্ষার সঙ্গে সংস্কৃতির সম্মিলন শিক্ষার্থীর মাঝে জাগিয়ে তোলে শুভ ও অশুভ বোধ। বাড়িয়ে দেয় ভেতরে সৌন্দর্যবোধ। শিক্ষার সঙ্গে সংস্কৃতির দূরত্বের সুযোগে প্রায়শই ভুল পথে চালিত হচ্ছে অনেক শিক্ষার্থী। খেলাধুলা বা সংস্কৃতির মতো অংশগ্রহণমূলক কর্মকান্ডের বাইরে থেকে আকৃষ্ট হচ্ছে মৌলবাদ ও মাদকের প্রতি। কেউ বা সরাসরি জড়িয়ে পড়ছে জঙ্গিবাদে। এমন প্রেক্ষাপটে শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে সংস্কৃতির সংযোগ ঘটানোর দাবি তুলেছেন সংস্কৃতিজন, শিক্ষাবিদসহ বিশিষ্টজনরা। মুখস্থ বিদ্যার অনুসারী শিক্ষাপদ্ধতিতে মননশীল মানুষ গড়তে পাঠ্যক্রমে সৃজনশীল বিষয়ের সংযুক্তি চাইছেন তারা। চিত্রকলা ও সঙ্গীতকে পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্তির দাবি তুলেছেন তারা। গত কয়েক বছর ধরেই বিষয়টি নিয়ে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বরতদের দফায় দফায় বৈঠক হলেও আসেনি ইতিবাচক কোন সিদ্ধান্ত। তাই শুধু আলোচনার মাঝেই বৃত্তবন্দী হয়েছে শিক্ষার সঙ্গে সংস্কৃতির সংযোগের বিষয়টি। মুখে মুখে মননশীল জাতি গড়তে সংস্কৃতির বিকল্প নেই বলা হলেও কার্যক্রমে নেই তার প্রতিফলন। মানবিক মানুষ বিনির্মাণে শিক্ষার সঙ্গে সংস্কৃতির সংযোগের বিকল্প নেই বলে উল্লেখ করেন সংস্কৃতিজন ও সাবেক সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর। এ প্রসঙ্গে তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, খেলাধুলার সঙ্গে সংস্কৃতিচর্চা শিশুর মানবিক বিকাশে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। খেলাধুলার পাশাপাশি ছবি আঁকা বা গান শেখার মতো বিষয়গুলো শিশুদের মানবিক মানুষ হওয়ার বোধ জাগিয়ে দেয়। অংশগ্রহণমূলক কার্যক্রমে অংশ নিয়ে প্রফুল্ল হয় মন-মানসিকতা। অথচ আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় সংস্কৃতির সঙ্গে শিক্ষার সমন্বয় ঘটেনি। সে কারণেই অন্য বিষয়ের মতো চিত্রকলা ও সঙ্গীতকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে পাঠ্যক্রমে। এ বিষয়ে প্রতিটি বিদ্যালয়ে এই দুই বিষয়ের ওপর পৃথক শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে। আমি সংস্কৃতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পালনকালে এ বিষয়ে কয়েক দফা প্রাথমিক ও গণশিক্ষা এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। এসব মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীরাও পাঠ্যক্রমে সঙ্গীত ও চিত্রকলার অন্তর্ভুক্তি যৌক্তিক মনে করলেও এ বিষয়ে কোন সিদ্ধান্ত হয়নি। শুধু আলোচনাই হয়েছে। বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়া হয়নি। এখন সময় এসেছে উদ্যোগ নেয়ার। অন্য বিষয়ের মতোই প্রথম থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত সঙ্গীত ও চিত্রকলাকে বাধ্যতামূলক বিষয়ে পরিণত করে শিক্ষার সঙ্গে সংযোগ ঘটাতে হবে সংস্কৃতির। তাহলে অভিভাবকরাও সন্তানকে পড়ার চাপ দিয়ে তাদের ভেতরের সুপ্ত প্রতিভাকে বিনষ্ট করবে না। এটা করতে না পারলে উগ্রবাদের প্রতি আকৃষ্ট হওয়া কিংবা সামাজিক মূল্যবোধের অভাবে বেড়ে ওঠা শিশুরা একসময় বিপদ ডেকে আনবে। অথচ সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে অংশগ্রহণের জন্য চাতক পাখির মতো অপেক্ষায় থাকে শিক্ষার্থীরা। এসবের প্রতি আছে তাদের প্রবল আসক্তি। কিন্তু আমরা বড়রা তাদের সেই বিকাশের পথটিকে মসৃণ করার পরিবর্তে জিপিএ ফাইভের মোহে ক্রমাগত পড়ার চাপ দেই। ফলে তাদের মনটা শুকিয়ে যায়। এক সময় সেই শুকিয়ে যাওয়া মনটি শুভ ও অশুভ বোধের পার্থক্য ধরতে না পেরে জড়িয়ে পড়ে জঙ্গিবাদসহ নানা সহিংস কর্মকান্ডে। পাশাপাশি বিকাশ ঘটে না সামাজিক মূল্যবোধের। এভাবে শিক্ষার্থীদের বিকাশে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে রেখেছি আমরা। শিক্ষাব্যবস্থায় সংস্কৃতিসংলগ্ন বিষয় প্রণয়নে মন্ত্রণালয়ের সীমাবদ্ধতার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, জেএসসি, পিএসসিসহ নানা পরীক্ষার কারণে তাদের এমনিতেই ধকল যায়। তাই নতুন করে পাঠ্যসূচীতে সংস্কৃতি-সম্পর্কিত বিষয়ের সংযুক্তি নিয়ে ভাবতে চান না। তবে আজ হোক আর কাল হোক শিক্ষার সঙ্গে সংস্কৃতির সমন্বয় সাধনে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগী হতেই হবে। আবার সব সময় সরকারের মুখাপেক্ষী থেকে সবকিছু হয় না। তাই সরকারী- বেসরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান-গুলোকেও সংস্কৃতিচর্চার বিষয়ে নিজস্ব উদ্যোগ নিতে হবে। পাঠ্যক্রমে সঙ্গীত ও চিত্রকলাকে সংযুক্তির বিষয়টি নিয়ে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হয় শিক্ষামন্ত্রী ডাঃ দীপু মনির সঙ্গে। কয়েক দফায় মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি সাড়া দেননি। এই বিষয়ে মুঠোফোনে খুদে বার্তা পাঠিয়েও তার কোন মন্তব্য জানা যায়নি। শিক্ষার সঙ্গে সংস্কৃতির সংযোগহীনতায় আক্ষেপ করে জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বলেন, প্রাথমিক পর্যায় থেকেই পাঠ্যক্রমে সংস্কৃতিকে যুক্ত করতে হবে। কারণ, সংস্কৃতিচর্চার মাধ্যমে শিক্ষার্থীর মানসিক বিকাশ পরিপূর্ণ হয়। এর ফলে তাদের ভেতর সামাজিক মূল্যবোধ বিকশিত হওয়ার পাশাপাশি জাগ্রত হয় দেশপ্রেম। শিক্ষা কমিশনের সর্বশেষ প্রতিবেদনেও পাঠ্যক্রমে নৃত্য-গীতসহ সংস্কৃতি-সম্পর্কিত বিষয়কে সংযুক্তির সুপারিশ করা হয়েছিল। তখন অনেকেই পাঠ্যক্রমে নৃত্য-গীতের সংযুক্তিতে মেয়েরা বাইজি হয়ে যাবে-এমন কটুবাক্য বলে সেই সুপারিশের বিরোধিতা করেছিলেন। তারপর থেকেই সেই সুপারিশের আর অগ্রগতি হয়নি। শিক্ষাব্যবস্থায় সংস্কৃতিবান্ধব সেই প্রস্তাবটির বাস্তবায়ন হয়নি। অথচ শিক্ষার সঙ্গে সংস্কৃতিচর্চার সম্মিলন না ঘটলে শিশুর পরিপূর্ণ মানসিক বিকাশ হয়। এমন প্রেক্ষাপটে পাঠ্যসূচীতে সঙ্গীত ও চিত্রকলার মতো বিষয় অন্তর্ভুক্তির বিকল্প নেই। পাঠ্যসূচীতে সংস্কৃতিকে অবহেলিত উল্লেখ করে বিশ্ব আইটিআইয়ের সাম্মানিক সভাপতি নাট্যজন রামেন্দু মজুমদার বলেন, শিক্ষার সঙ্গে সংস্কৃতির যোগ অবিচ্ছেদ্য। অন্যদিকে সংস্কৃতি হচ্ছে এই বাংলাদেশের মূল ভিত্তি। তাই পাঠ্যসূচীতে সঙ্গীত, চিত্রকলা, নৃত্যসহ সংস্কৃতির সঙ্গে সম্পর্কিত বিষয়কে সংযোগ করতে হবে। একসময় শিক্ষানীতিতে এ বিষয়গুলো পাঠ্যসূচীতে অন্তর্ভুক্তির সিদ্ধান্তও হয়েছিল। কিন্তু সেটা আর বাস্তবায়িত হয়নি। অথচ শিক্ষাব্যবস্থায় সংস্কৃতির সংযুক্তি না থাকলে অসাম্প্রদায়িক ও মানবিক বাংলাদেশ বিনির্মাণ অসম্ভব। এই দাবি নিয়ে আমরা শিক্ষা মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে অসংখ্যবার আলোচনা করেছি। দফায় দফায় বৈঠক হয়েছে। তবে সেগুলো শুধু আলোচনাতেই থেকেছে বাস্তবায়ন হয়নি। আমাদের কথাগুলো কেউ কানে তোলেনি। শিক্ষার সঙ্গে খেলাধুলাসহ সংস্কৃতিচর্চার প্রয়োজনীয়তার উদাহরণ তুলে ধরে কথাশিল্পী ও শিক্ষাবিদ সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, শ্রীলঙ্কার পাঠ্যক্রমেও খেলাধুলাসহ সংস্কৃতির বিভিন্ন বিষয় যুক্ত হয়েছে। এসব বিষয়ে পৃথক নম্বর দেয়া হয় শিক্ষার্থীদের। অথচ আমাদের দেশে শুধুই মুখস্থনির্ভর শিক্ষা দেয়া হচ্ছে শিক্ষার্থীদের। জিপিএ ফাইভের আকাক্সক্ষায় বাড়ছে কোচিং বাণিজ্য। এই শিক্ষাব্যবস্থায় মানসিক বিকাশের সুযোগ সীমিত। পাঠ্যক্রমে সঙ্গীত ও চিত্রকলা সংযুক্ত করার প্রস্তাবটি খুবই ভাল। তবে এটা হিতে বিপরীত হতে পারে। কারণ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি অভিভাবকরাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করছে শিক্ষার্থীদের। তারা তাদের সন্তানদের মানসিক বিকাশের পরিবর্তে চাপিয়ে দিচ্ছে পড়ার চাপ। জন্মদিনে একটি ভাল বই উপহার দেয়ার পরিবর্তে হাতে তুলে দিচ্ছে খেলনা বন্দুক। এই অবস্থায় পাঠ্যক্রমে সঙ্গীত ও চিত্রকলা সংযুক্ত করার সিদ্ধান্ত নিলে এসব অভিভাবকরাও এর বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে পারে। সব মিলিয়ে বলা যায়, প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থায় অবজ্ঞার শিকার হচ্ছে সংস্কৃতি। সংস্কৃতির গুণাগুণ বিচার না করে তাকে দূরে সরিয়ে রাখা হচ্ছে। অথচ শিক্ষাব্যবস্থায় ৫০ শতাংশ পাঠ্যপুস্তক বিদ্যাচর্চার সঙ্গে বাকি পঞ্চাশ শতাংশ হওয়া উচিত প্রকৃতি দর্শন, সঙ্গীত পরিবেশনা, ছবি আঁকা, বই পড়া, ভ্রমণের মতো বিষয়। দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় সংস্কৃতি সম্পূর্ণ অবহেলিত বলে মন্তব্য করেন সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, গত প্রায় দশ বছর ধরে আমরা প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের পাঠ্যসূচীতে সংস্কৃতির সঙ্গে সম্পর্কিত চিত্রকলা, গান শেখার মতো বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করার দাবি জানিয়ে আসছি। পৃথকভাবে এসব বিষয় অন্তর্ভুক্তির পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট বিষয়ের শিক্ষক নিয়োগের কথাও বলেছি। শিক্ষা মন্ত্রণালসহ বিভিন্ন মহলের সঙ্গে দফায় দফায় এ বিষয়ে বৈঠকও হয়েছে। কিন্তু সেটা শুধু দাবিতেই থেকেছে বাস্তবায়িত হয়নি। মুখে মুখে সংস্কৃতির শক্তির কথা বলা হলেও প্রায়োগিক ক্ষেত্রে সেটাকে পাত্তা দেয়া হচ্ছে না। অথচ লেখাপড়ার পাশাপাশি মানবিক বোধ জাগ্রত করতে সংস্কৃতির কাছেই ফিরে যেতে হবে। মূল্যবোধের স্খলন প্রতিরোধেও সংস্কৃতির ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষার্থীদের মানবিক বোধ জাগ্রত করতেও বিকল্প নেই সংস্কৃতির। ভিকারুননিসা নূন স্কুল এ্যান্ড কলেজের শিক্ষিকা ও উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর সংগঠক সঙ্গীতা ইমাম বলেন, আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পয়লা বৈশাখ, নবান্ন উৎসবসহ বিভিন্ন ঋতুভিত্তিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। সপ্তম শ্রেণী পর্যন্ত চিত্রাঙ্কনে পাস না করে কোন শিক্ষার্থী প্রথম, দ্বিতীয় বা তৃতীয় হতে পারে না। অথচ সম্প্রতি সরকারীভাবে জানানো হয়েছে, পৃথক বিষয় হিসেবে চিত্রাঙ্কন চর্চার প্রয়োজন নেই। আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটিতে সংস্কৃতিচর্চা হলেও দেশের বেশির ভাগ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই সংস্কৃতিচর্চা শূন্যের কোটায়। এসব স্কুল-কলেজের শিক্ষকরাও সংস্কৃতিমনস্ক নয়। আবার কোথাও চর্চা হলেও সেটা আমাদের সংস্কৃতির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ না হয়ে ভুলভাবে হচ্ছে। ভিন্ন দেশের সংস্কৃতি আশ্রিত নাচ-গানের মাধ্যমে অপসংস্কৃতির চর্চা যুক্ত হচ্ছে। তাই চিত্রকলা বা সঙ্গীতকে পাঠ্যক্রমে যুক্ত করাটা যেমন জরুরী তেমনি শিক্ষক ও অভিভাবকদেরও সংস্কৃতিচর্চার গুরুত্ব উপলব্ধি করতে হবে।
×