ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

ভারত সরকারের মানবিকতা

প্রকাশিত: ০৮:৫১, ২২ জুলাই ২০১৯

 ভারত সরকারের মানবিকতা

১৯৭১ সালের ২২ জুলাই দিনটি ছিল বৃহস্পতিবার। এই দিন বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যদের উদ্দেশে বলেন, ‘বাংলাদেশ সরকার যেসব পরিকল্পনা নিয়েছে তার মূল লক্ষ্য দেশ উদ্ধার। সেদিন দূরে নয় যেদিন আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি সম্পূর্ণ শত্রুমুক্ত হবে। ৭নং সেক্টরের নায়েব সুবেদার মুবাছারুলের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধা দল মীরগঞ্জ রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণ করে। এ আক্রমণে ৫জন রাজাকার নিহত হয় এবং রাজাকারদের মীরগঞ্জের সঙ্গে চরঘাটের টেলিযোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়। মতিয়ার রহমানের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা পাথরঘাটার ৫-৬ মাইল পশ্চিমে বাশাইল থানার কাছে পাক হানাদারদের একটি টহলদার দলকে আক্রমণ করে। আক্রমণে ৪ জন পাকসেনা নিহত হয়। মুক্তিযোদ্ধারা অনেক অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধার করে এবং নিরাপদে নিজ অবস্থানে ফিরে আসে। জামায়াতে ইসলামীর ভারপ্রাপ্ত আমির মিয়া মোহাম্মদ তোফায়েল করাচীতে এক সাংবাদিক সম্মেলনে সরকারের প্রতি এই মর্মে দাবি জানান, আওয়ামী লীগের যেসব সদস্য গোলযোগে অংশ নিয়েছিলেন, সেসব সদস্যের আসন বাতিল করে গত নির্বাচনে যারা দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেছিলেন সেসব আসনে তাদের নির্বাচিত বলে ঘোষণা করতে হবে। ঢাকায় পাকিস্তান সামরিক শাসক ১৫৭, ১৫৮ এবং ১৫৯ নং সামরিক আদেশ জারি করে। এ আদেশে দালাল রাজাকারদের যে কোন লোককে গ্রেফতার করার ক্ষমতা দেয়া হয়। পাকিস্তান নৌবাহিনীর প্রধান ভাইস এডমিরাল মুজাফফর হাসান চট্টগ্রামে নৌসেনাদের উদ্দেশে বলেন, নৌবাহিনী আরও কার্যকর করার উদ্দেশ্যে ব্যবস্থা নেয়া হবে। নোয়াখালীর কালিতারা বাজারে জেলা শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান এ্যাডভোকেট সায়েদুল হকের সভাপতিত্বে স্বাধীনতা বিরোধীদের সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় বক্তারা মুক্তিযোদ্ধা ও দুষ্কৃতকারীদের হাত থেকে দেশকে রক্ষা করার জন্য দৃঢ়তা প্রকাশ করেন। অস্ট্রেলিয়ান এমপি ম্যানফ্রেড ক্রস, ভারত উদ্বাস্তুদের রেখে দিচ্ছে ইচ্ছা করে এবং তাদের ফিরতে দিচ্ছে না পাকিস্তানের এই বক্তব্যকে ‘অসম্ভব’ বলে উড়িয়ে দেন। পাকিস্তানের সৃষ্ট সঙ্কট ভারত সরকার অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে সামলাচ্ছেন। তারা অবিশ্বাস্য সংযম দেখিয়ে যাচ্ছেন। তারা উদ্বাস্তুদের সাহায্য ও সমবেদনা দেখাচ্ছেন। সত্যি করেই বলা যায় এই সরকার নৈতিক ও মানবিক আচরণ করছেন। ইউএনএইচসিআর এর পরিচালক টমাস জেইমসন ভারতে ইউএনএইচসিআর কার্যালয়ের প্রধান প্রতিনিধি। তিনি সম্প্রতি শরণার্থী শিবিরে সফর করে এসেছেন। এছাড়াও ১০০০ বিদেশী পর্যবেক্ষক শরণার্থী শিবির পরিদর্শন করেন এবং তাদের অধিকাংশ প্রকাশ্যে বলেছেন, উদ্বাস্তুরা বাংলাদেশের সামরিক অপারেশন এর কারণে ভারতে আশ্রয় নিচ্ছে এবং যদি উপযুক্ত অবস্থার সৃষ্টি করা হয় তাহলে তারা নিরাপদ ফিরে যাওয়া নিশ্চিত করবে। পূর্ববাংলার মূল সমস্যা সেখানে বহুদূর থেকে আসা একটি সেনাবাহিনী নিষ্ঠুরভাবে তাদের নিয়ন্ত্রণ করছে। যদি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় পূর্ববঙ্গে উদ্বাস্তুদের ফেরতের ব্যাপারে পদক্ষেপ নেয়ার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে সজাগ হয় তাহলে সেখানে ইতোমধ্যে নির্বাচিত নেতাদের কাছে গ্রহণযোগ্য একটি রাজনৈতিক নিষ্পত্তির মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানের ভিতরে স্বাভাবিক অবস্থার পুনরুদ্ধার সম্ভব। মুজিবনগর সূত্রে প্রাপ্ত খবরে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামীরা পূর্ব বাংলার বিভিন্ন রণাঙ্গনে তাদের তৎপরতা বাড়িয়েছেন। মুক্তিফৌজ শ্রীহট্ট, রাজশাহী এবং কুষ্টিয়া জেলায় পাক সেনাবাহিনীর ঘাঁটির ওপর ক্রমাগত আক্রমণ করে চলেছেন। গত ২৪ ঘণ্টায় মুক্তিফৌজ এর আক্রমণে অসংখ্য পাকসেনা নিহত ও আহত হয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ অনেক সেতু ও যোগাযোগ ব্যবস্থা ধ্বংস হয়েছে। শ্রীহট্ট সেক্টরে মুক্তিফৌজের গেরিলারা বড়লেখায় একটি গুরুত্বপূর্ণ সেতু উড়িয়ে দিয়েছে। সেই সঙ্গে ৮ জন দালালসহ ২৪ জন পাকিস্তানী খতম হয়েছে। গতকাল রাতে মুক্তিফৌজ রাজশাহী শহরের ওপর অতর্কিতে আক্রমণ চালান এবং চারজন রাজাকার ও দু’জন বিশ্বাস ঘাতককে গ্রেফতার করে। রাত্রিবেলা পাকিস্তানী সৈন্যরা রাজশাহী সেনা ছাউনিতে গিয়ে আশ্রয় নেয়। কুষ্টিয়া জেলার মেহেরপুরের কাছে কালা চাঁদপুরেও গতকাল রাতে পাকসেনাদের সঙ্গে মুক্তিফৌজ গেরিলাদের প্রচন্ড গুলি বিনিময় হয়। সংঘর্ষে বহু পাক সৈন্য হতাহত হয়েছে। কুষ্টিয়া জেলার মুক্তিফৌজ কমান্ডোরা কুমারখালী, চিত্রা এবং আলমডাঙ্গা পর্যন্ত এগিয়ে গিয়েছেন। গত মঙ্গলবার কুমিল্লা শহরে মুক্তিবাহিনীর গেরিলা দল কয়েকটি পাকসেনা অবস্থানের ওপর আক্রমণ চালায় এবং এই আক্রমণে প্রাণ বাঁচাতে পাকসেনারা পাঁচ কিলোমিটার দূরে ময়নামতি সেনা শিবিরের দিকে পালিয়ে যায়। জানা গেছে, পাকসেনাদের মনোবল ভেঙ্গে পড়েছে। অপরদিকে এসব গেরিলা আক্রমণ বাংলাদেশের জনগণের মনে নতুন শক্তি ও সাহস যুগিয়েছে। কুমিল্লা শহরের কর্ম চঞ্চল কান্দিরপাড় অঞ্চলে গেরিলাদের মর্টার আক্রমণে একদল পাকসেনা আহত হয়। মুক্তিবাহিনী রাজগঞ্জ থানা, সার্কিট হাউস এবং কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টের ওপর মর্টার আক্রমণ চালায়। এসব সংঘর্ষে পাক সেনাদের বহু হতাহত হয়েছে। মুক্তিবাহিনী শ্রীহট্ট, রাজশাহী ও কুষ্টিয়া জেলার পাকিস্তানী ফৌজের অবস্থানের অপর অবিরাম চাপ অব্যাহত রেখেছে এবং গত ২৪ ঘণ্টায় ওইসব অঞ্চলে গুরুত্বপূর্ণ যোগাযোগ ব্যবস্থা ও বহু পুল ধ্বংস করেছে। মুক্তিফৌজ পদ্মার তীরস্থ তাদের ঘাঁটি থেকে নদী পার হয়ে গত রাতে রাজশাহী শহরের ওপর আকস্মিক হানা দেয় এবং চারজন পাকিস্তানী আধা সামরিক ও ২ জন কুইস লিংকে পাকড়াও করে। গত রাতে কুষ্টিয়া জেলায় পাক সৈন্যদের সঙ্গে মুক্তিফৌজ গেরিলাদের জোর সংঘর্ষ ও গুলি বিনিময় হয়। মুক্তিফৌজ গত রাতে কুষ্টিয়া জেলায় মেহেরপুর পাওয়ার হাউসের ওপর আক্রমণ চালিয়ে ট্রান্সফর্মারটি সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দেয়। গেরিলারা কুষ্টিয়ায় পাক মুসলিম লিগ অফিস আক্রমণ করে এবং একজন লিগ নেতাকে হত্যা করে। আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত সম্পাদকীয় নিবন্ধে বলা হয়েছে, পূর্ববাংলার নানা স্থানে, বিশেষ করে চট্টগ্রামে যে সংখ্যালঘু বৌদ্ধ ছিলেন, পাকিস্তানী ফৌজের বর্বরতায় তারাও অন্যদের মতই আশ্রয়হীন হয়ে পড়েছেন। হানাদার বাহিনী মঠ মন্দির, ঘর-বাড়ী জ্বালিয়ে, নারীদের ওপর পৈশাচিক নির্যাতন চালিয়ে যে নারকীয় অবস্থা সৃষ্টি করেছে তার মধ্যে বেঁচে থাকা অসম্ভব। প্রাণ বাঁচাতে ২০ হাজার বৌদ্ধ বার্মার আরাকান অঞ্চলের পাহাড়ে আশ্রয় নিয়েছেন। আসামের মিজো পাহাড় আঞ্চলেও এসেছেন প্রায় ১৫ হাজার বৌদ্ধ। আর্ত ও বিপন্ন মানুষেরা যে ধর্ম বা মতাবলম্বীই হন, তাঁদের দিকে আমাদের তাকাতে হবে একই উদার মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে। একদিন আমরা হিটলারের জার্মানি থেকে ইহুদীদের দলে দলে উৎখাত ও বিতারিত হয়ে পৃথিবীর দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়তে দেখেছি। অদম্য প্রাণশক্তি ও বলিষ্ঠ সাংস্কৃতিক আত্মপ্রত্যয়ের জোরে তারা চরম দুর্যোগের মধ্যেও টিকে থেকেছেন। এবং শেষ পর্যন্ত উঠে দাঁড়িয়েছেন। স্বৈরাচারী হিটলারই পরাজয়ের ভস্ম মুখে বিদায় নিয়েছেন ইতিহাসের রঙ্গমঞ্চ থেকে। বাঙালী বৌদ্ধরাও এভাবে বিজয়ের অধিকারী হবেন একদিন। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত ইংরেজী অনুষ্ঠান ওয়ার্ল্ড প্রেস রিভিউ অন বাংলাদেশে বলা হয়, বাংলাদেশের জনগণের স্বাধীনতার সংগ্রামকে বিশ্বের একটি অংশ ‘বিচ্ছিন্নতাবাদ’ বা ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন’ বলে উল্লেখ করছে। সাধারণ মানুষের বাংলাদেশের আন্দোলনের খুঁটিনাটি বুঝতে পারছে না যে, এই আন্দোলনটি একেবারেই আলাদা। যদিও পাকিস্তানের শুরু করা গণহত্যার বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী সহানুভূতি ছিল তবুও খুব কম পত্রিকাই, বিশেষত যুক্তরাষ্ট্রের পার্থক্যগুলো তুলে ধরেছিল এবং বুঝিয়েছিল যে বাংলাদেশের জয় অবশ্যাম্ভাবী। বিশ্বের কাছে সম্ভাব্য সব দিক থেকে ব্যাখ্যা করার সময় এসেছে যে, একটি বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন এবং জাতীয় স্বাধীনতার সংগ্রাম যেটার জন্য বাংলাদেশের মানুষ একটা বিদেশী সামরিক বাহিনীর হাতে প্রাণ দিচ্ছে, দুটির মধ্যে আমূল পার্থক্য রয়েছে। দু’শ’ বছরের কঠোর উপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্তির উচ্ছ্বাসের মধ্যে বিভক্ত বাংলার মুসলিমরা ক্ষমতা হস্তান্তরের আসল স্বরূপ বুঝে উঠতে পারেনি। উপনিবেশিক ব্রিটিশ সরকার তাদের হাতেই ক্ষমতা ছেড়েছিল যাদের মাধ্যমে তাদের স্বার্থ উদ্ধার হয়েছিল। সামরিক জান্তার নেতৃত্বাধীন এই গোষ্ঠী জানত তাদের এই শোষণ চিরকাল চলতে পারে না। একথা মাথায় রেখে সশস্ত্র বাহিনীতে তারা সবসময় খেয়াল রাখছিল যেন শতকরা দশ ভাগের বেশি বাঙালী না হয়। তারা ভেবেছিল এভাবেই তারা সশস্ত্র বিদ্রোহের সম্ভাবনাকে বিলুপ্ত করে দিয়েছে। কিন্তু ইতিহাস তাদের হতবাক করে দিয়েছিল। বাঙালীর স্বাভাবিক ধৈর্যের জন্যেই এই অভিশপ্ত ইউনিয়ন ২৩ বছর টিকে ছিল। লেখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক [email protected]
×