ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

লঙ্কায় বাংলাদেশ দলের সামনে অনেক চ্যালেঞ্জ

প্রকাশিত: ০৯:২০, ২২ জুলাই ২০১৯

লঙ্কায় বাংলাদেশ দলের সামনে অনেক চ্যালেঞ্জ

মোঃ মামুন রশীদ ॥ আগত ভবিষ্যত নিয়ে অনেক আগে থেকেই চিন্তা-ভাবনা, নানা জল্পনা-কল্পনা! বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দল থেকে যদি পঞ্চপান্ডবের বিদায় ঘটে তখন কারা হবেন কান্ডারি? সবেমাত্র বিশ্বকাপ শেষ করেই শ্রীলঙ্কা সফরে গেছে বাংলাদেশ দল। এই সফরেই হয়তো ভবিষ্যতটা কেমন হবে তার একটি রূপরেখা বেরিয়ে আসবে। কারণ দীর্ঘ সময় পর দলের নেতৃত্বে নেই মাশরাফি বিন মর্তুজা। ইনজুরির কারণে ওয়ানডেতে দেশের ইতিহাসে সফলতম এ অধিনায়ক ছিটকে গেছেন শ্রীলঙ্কা সফর থেকে। একই সঙ্গে বিশ্বসেরা ওয়ানডে অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসানও নেই। ইনজুরি সমস্যায় পুরোপুরি ফিটনেস ফিরে পাননি মুশফিকুর রহীম ও মাহমুুদুল্লাহ রিয়াদ। প্রথমবার কোন ওয়ানডে সিরিজে নেতৃত্ব দেবেন তামিম ইকবাল। ব্যাট হাতে সম্প্রতি প্রত্যাশিত ফর্মে না থাকা তারজন্য তাই অনেক বড় চ্যালেঞ্জ সফলতা বের করে আনা। গত দুই বছর ধরে শ্রীলঙ্কা দলটি ধুঁকলেও এবার বিশ্বকাপে আশাতীতভাবে ভালই করেছে। তাই তারা উজ্জীবিত। আইসিসি র‌্যাঙ্কিংয়ে বাংলাদেশের চেয়ে পিছিয়ে থাকলেও ঘরের মাটিতে ভাঙ্গাচোরা দলে পরিণত হওয়া বাংলাদেশ দলকে কঠিন চাপে ফেলবে লঙ্কানরা। দীর্ঘ সময় পর বাংলাদেশ দলে যারা সুযোগ করে নিয়েছেন তাদেরও সামর্থ্য প্রমাণের চ্যালেঞ্জ রয়েছে। মাশরাফি-সাকিব ছাড়া ভবিষ্যত বাংলাদেশ দল কেমন হবে তারই এক পরীক্ষা হয়তো এবার শ্রীলঙ্কায় ৩ ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজে হতে চলেছে। শুধু সাকিব, শুধু তামিমকে ছাড়া এর আগে বাংলাদেশ দল খেলেছে। তবে সেসব অতীত। ২০১৪ সালের শেষদিকে নতুন করে ওয়ানডে অধিনায়ক হন দীর্ঘ ইনজুরি কাটিয়ে ফেরা মাশরাফি। তারপর এই প্রথম কোন সিরিজে তিনি থাকছেন না। অনেকদিন পরই পুরো একটি ওয়ানডে সিরিজ খেলা হবে না দলকে নেতৃত্ব দিয়ে টানা সাফল্য পাইয়ে দেয়া মাশরাফির। অথচ ২০১৪ সালের শুরু থেকে সেপ্টেম্বর-অক্টোবর পর্যন্ত ঘোর অমানিশায় ডুবে গিয়েছিল বাংলাদেশ দল। টানা পরাজয়ের বৃত্তে বন্দী দলকে ‘জাদুবলেই’ হয়তো বের করে আনেন মাশরাফি। তার দলের সবাইকে সংঘবদ্ধ রাখা, উজ্জীবিত রাখা, অনুপ্রাণিত করার যে ক্ষমতা তা দিয়েই আমূল বদলে ফেলেছিলেন দলের চেহারাটাকে। এই সময়েই বাংলাদেশ দল নিজেদের সেরা র‌্যাঙ্কিং ৭ নম্বরে উঠে এসেছে। মাশরাফির অধীনেই বিশ্বকাপে প্রথমবার কোয়ার্টার ফাইনাল খেলেছে টাইগাররা, কোন টি২০ আসরের প্রথম ফাইনাল (এশিয়া কাপ ২০১৬) খেলেছে, ২০১৭ সালের চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে সেমিফাইনাল খেলেছে, টানা ৬টি ওয়ানডে সিরিজ জিতেছে যার মধ্যে ইংল্যান্ড, পাকিস্তান, ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে প্রথম সিরিজ জয় ছিল। আর বিশ্বকাপের আগে আয়ারল্যান্ডে অনুষ্ঠিত ত্রিদেশীয় সিরিজে প্রথম কোন শিরোপাও বাংলাদেশ দলের তাঁবুতে এসেছে মাশরাফির অধীনে। এই দীর্ঘ সময়টাতে নেতৃত্ব গুণে এবং ব্যক্তিগত পারফর্মেন্সে উজ্জ্বল ছিলেন মাশরাফি। তবে ইনজুরি নিয়ে খেলা চালিয়ে যাওয়ার কারণে বিশ্বকাপটা একেবারেই বাজে কেটেছে তার। পুরো ক্যারিয়ারে এত বাজে কোন সিরিজ বা টুর্নামেন্ট কাটেনি মাশরাফির। তবে অধিনায়ক হিসেবে ঠিকই দলকে সুসংহত রাখতে পেরেছিলেন। তিনিই এবার শ্রীলঙ্কা সফরে ৩ ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজে অনুপস্থিত। মাশরাফি, সাকিব, তামিম, মুশফিক ও রিয়াদ গত কয়েক বছরে নিয়মিত পারফর্মার বাংলাদেশ দলের। তাদের ধারাবাহিক নৈপুণ্যেই টানা সাফল্য এসেছে দলের। তবে মাশরাফির আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে ইতি টানার সময় ঘনিয়ে এসেছে। পরবর্তী বিশ্বকাপে হয়তো দেখা যাবে না রিয়াদকেও। এ পঞ্চপা-বের বাইরে দুর্দান্ত নৈপুণ্য অন্য ক্রিকেটারদের কাছ থেকে খুব কমই দেখা গেছে। আর তাই বেশ কিছুদিন আগে থেকেই দলের ভবিষ্যত নিয়ে শঙ্কা। সেই শঙ্কার কথা এবার শ্রীলঙ্কা সফরে যাওয়ার আগে মাশরাফি নিজে এবং অন্তর্বর্তীকালীন কোচ খালেদ মাহমুদ সুজন মাথায় রেখে বিকল্প পাইপলাইন শক্ত করার ওপর জোর দিয়েছেন। বাস্তবে কি মাশরাফি-সাকিবসহ বাকিদের উপযুক্ত বিকল্প আছে বাংলাদেশ দলের? ‘এ’ দল ও বিসিবি একাদশে যে ক্রিকেটাররা খেলছেন তাদের মধ্যে থেকেই সাধারণত ভবিষ্যত জাতীয় দল গড়ে ওঠে। তবে সম্প্রতিই সফরকারী আফগানিস্তান ‘এ’ দলের সঙ্গে সিরিজে বাংলাদেশ ‘এ’ দলের খেলা ক্রিকেটারদের পারফর্মেন্স ভাবিয়ে তুলেছে। এমনকি ওয়ানডে সিরিজে জাতীয় দলের ভবিষ্যত কান্ডারি হবেন যারা তাদের মধ্যে সাব্বির রহমান, মোহাম্মদ মিঠুন, এনামুল হক বিজয় খেলেছেন। তারা ভাল কোন নৈপুণ্য দেখাতে ব্যর্থ হয়েছে। শ্রীলঙ্কা সফরে এই ক্রিকেটারদের ওপরই ভরসা করতে হবে বাংলাদেশ দলকে। তামিম এর আগে ২০১৭ সালে নিউজিল্যান্ড সফরে এক টেস্টে দলকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। কিন্তু এবারই প্রথম তিনি পুরো সিরিজে অধিনায়কত্ব করবেন। সেটিও এমন সময়ে যখন নিজের পারফর্মেন্স নিয়েই তাকে লড়াই করতে হচ্ছে। ব্যাট হাতে খারাপ সময় কাটিয়ে ওঠার চ্যালেঞ্জের মধ্যে ভাঙ্গাচোরা দলকে নিয়ে ওয়ানডে সিরিজে ভাল করার কঠিন পরীক্ষা। সাকিব নেই, মাশরাফি নেই এবং অপরিহার্য হয়ে ওঠা পেস অলরাউন্ডার মোহাম্মদ সাইফউদ্দিন নেই। বিকল্প যা ছিল তার মধ্যে তাসকিন আহমেদ, ফরহাদ রেজা আর বিজয় আছেন তামিমের সঙ্গে থেকে লড়াই করার জন্য। তামিম যে দলটি পেয়েছেন তার কোচিং স্টাফও অস্থায়ী। শুধু শ্রীলঙ্কা সফরের জন্য প্রধান কোচের ভূমিকায় সুজন, বোলিং কোচ হিসেবে রমানায়েকে, ব্যাটিং কোচ হিসেবে ওয়াসিম জাফর। দলের ক্রিকেটারদের সঙ্গে ভাল সমন্বয় গড়ার মতো যথেষ্ট সময় পাননি তারা কেউ। সুজন জাতীয় দলের এই ক্রিকেটারদের সঙ্গে যুক্ত থাকলেও বাকিরা ছিলেন না। বিশ্বকাপ পরবর্তী দলে বেশ কয়েকটি পরিবর্তন আসার কারণে সুজনের জন্যও সঠিক নির্দেশনা দেয়াটা কঠিন কাজই হবে। তামিমের অধীনে বাকি ক্রিকেটারদের মনোভাব সিরিজে কেমন থাকবে সেটাও ভাবনার বিষয়। বিজয়, তাসকিন, ফরহাদ, তাইজুল ইসলামরা দীর্ঘদিন ওয়ানডে খেলেননি। শ্রীলঙ্কার মাটিতে গিয়ে ভাল করাটা তাদের জন্যও চ্যালেঞ্জের। মিঠুন, সাব্বির ভাল ফর্মে নেই। এ কয়েকজন ক্রিকেটারই এবার তামিমের সহযোদ্ধা। গত এক বছর ধরে বাংলাদেশ দল প্রায় একই ধরনের একাদশ নিয়ে খেলেছে। সেই একাদশের সঠিক সমন্বয় খুঁজে পাওয়ার জন্যও এবার প্রথম ম্যাচ থেকেই পরীক্ষায় পড়তে হবে। ভাল সমন্বয় বের করতে করতেই পেরিয়ে যাবে মাত্র ৩টি ওয়ানডে সিরিজ। সিরিজে হেরে গেলে র‌্যাঙ্কিংয়ের রেটিং পয়েন্টে ব্যবধান কমে আসবে। সৌম্য সরকার বিশ্বকাপে তেমন সুবিধা করতে পারেননি। ওপেনার হিসেবে তাই বিশ্বকাপের শেষদিকে লিটন কুমার দাস ছিলেন তামিমের সঙ্গী। এবার লিটন না থাকায় দীর্ঘদিন পর বিজয়কে সঙ্গী করে নামতে হবে তামিমকে। সাকিব গত দেড় বছর ধরে ওয়ানডাউনে দুর্দান্ত ফর্মে ছিলেন, তিনি না থাকায় এখন মিঠুন-সাব্বিরের মধ্যে একজনকে সেখানে নামতে হবে। মাশরাফি-সাইফের জায়গায় বোলিংয়ে তাসকিন-ফরহাদ মানিয়ে ওঠার চ্যালেঞ্জে থাকবেন। সবমিলিয়ে সাকিব-মাশরাফিকে ছাড়া এবার ভবিষ্যতের বাংলাদেশ দলের একটি রূপরেখা হয়তো বোঝা যাবে। রবিবার ও আজ দু’দিন অনুশীলনের পর সোমবার শ্রীলঙ্কা বোর্ড প্রেসিডেন্ট একাদশের বিপক্ষে প্রস্তুতি ম্যাচের পর প্রথম ওয়ানডেতেই হয়ে যাবে অনেক ক্রিকেটারের পরীক্ষা। মূল লড়াইয়ে নামার আগে অধিনায়ক তামিমেরও প্রাক-পরীক্ষা।
×