ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ড. অরূপ রতন চৌধুরী

সকল অপরাধ ও সন্ত্রাসের জনক মাদক

প্রকাশিত: ০৯:৩৯, ২৩ জুলাই ২০১৯

সকল অপরাধ ও সন্ত্রাসের জনক মাদক

মাদকদ্রব্যের প্রতি আসক্তি ভয়াবহ রূপ নিতে পারে। বর্তমানে এই প্রভাব অতটা বোঝা না গেলেও সুদূরপ্রসারী অনেক প্রভাব রয়েছে। প্রাথমিক স্কুল থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত এর বিস্তৃতি। একটি সময় ছিল যখন সমাজের বিত্তশালী পরিবারের ছেলেমেয়েদের মধ্যে এর আসক্তি ছিল। কিন্তু বর্তমানে তা ছড়িয়ে গেছে প্রায় সর্বত্র। মাদকাসক্ত হওয়ার পেছনে মনোবিজ্ঞানীরা নানাবিধ কারণ ব্যাখ্যা করেছেন, যেমন- ১. মাদকসেবীদের চাপ- বন্ধুদের চাপ ২. নেশার প্রতি কৌতূহল, ৩. সহজ আনন্দ লাভের বাসনা-বিভিন্ন উৎসব/পার্টিতে, ৪. হতাশা/বিষাদ/পরীক্ষায় খারাপ রেজাল্ট, ৫. প্রতিকূল পারিবারিক পরিবেশ এবং পারিবারিকমন্ডলে মাদকের প্রভাব, ৬. ধর্মীয় অনুভূতির অভাব, ৭. শিক্ষা কার্যক্রমে বিষয়টি অনুপস্থিতি, ৮. চিকিৎসা সৃষ্ট, ৯. মাদকের সহজলভ্যতা ১০. ধূমপানের অভ্যাস ইত্যাদি। মাদকের নাটের গুরু হচ্ছে সিগারেট। গবেষণায় দেখা যায়, মাদকাসক্তদের ৯৮ ভাগই ধূমপায়ী। বর্তমানে মাদকাসক্তদের পরিসংখ্যানের কোন তথ্য না থাকলেও বেসরকারীভাবে দেশে ৭৫ লাখের বেশি মাদকাসক্ত রয়েছে। বাংলাদেশের মাদক পরিস্থিতি নিয়ে জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে মাদকাসক্তদের মধ্যে ৮৪ ভাগ পুরুষ, ১৬ ভাগ নারী। সমাজের বিত্তশালী ব্যক্তি থেকে শুরু করে নারী ও শিশু-কিশোররাও মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। দেশে মহিলাদের মধ্যেও মাদকাসক্তদের সংখ্যাও বাড়ছে। এটা উদ্বেগের কারণ। নারী আসক্তদের ৯০ ভাগের বয়স ১৫-৩৫ বছরের মধ্যে। বাদ-বাকি ৩৫-৪৫ বছরের মধ্যে। মাদকাসক্তদের মধ্যে শতকরা পাঁচজন নারী। তাদের মধ্যে ছাত্রী, গৃহিণী, ব্যবসায়ী, চাকরিজীবী রয়েছেন। একটা ড্রাগের পার্শ¦প্রতিক্রিয়া নির্ভর করে তার রাসায়নিক গঠন বৈশিষ্ট্যের ওপর। এই ড্রাগ অপব্যবহারের কারণে রোগী তার রোগের জন্য ওষুধের গুণাগুণ পাওয়ার বদলে হয়ে যায় বিষ। তাই অনেক সময় বিষ স্বল্পমাত্রায় প্রয়োগ করলে হয় ওষুধ, কিন্তু বেশি মাত্রা বা অযথা গ্রহণ করলে হয় বিষাক্ত যা শরীরকে নিস্তেজ করে, ডেকে আনে মৃত্যু। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এই অপব্যবহারের মাধ্যমে সূচনা হয় মাদকাসক্তির। মাদকাসক্তির কারণে স্বল্পমেয়াদী প্রতিক্রিয়া ব্যবহারকারীর মধ্যে ক্ষুধা, বেদনা ও যৌন আকর্ষণের অনুভূতির অভাব দেখা দেয়। শারীরিক অন্যান্য প্রতিক্রিয়ার মধ্যে রয়েছে বমি বমি ভাব, বমি করা, ঘাম হওয়া, চুলকানি এবং চলাফেরায় সমন্বয়ের অভাব অথবা মাথা ঘুরানো। অন্যান্য মাদকদ্রব্যের মতোই আফিম জাতীয় দ্রব্য ব্যবহারকালে গাড়ি অথবা মেশিন চালানোর মতো কাজ বিপজ্জনক। অধিক মাত্রায় গ্রহণের ফলে চোখের মনি সঙ্কুচিত এবং চামড়া স্যাঁতসেঁতে ও শীতল হয়ে যেতে পারে। কোন কোন ক্ষেত্রে শ্বাস-প্রশ্বাস ক্ষীণ হতে হতে থেমে যেতে পারে। মাদকাসক্তির কারণে দীর্ঘমেয়াদী প্রতিক্রিয়া দীর্ঘদিন ধরে ব্যবহারকারীদের মধ্যে ফুসফুসের সমস্যা দেখা দিতে পারে অথবা যকৃত ও মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা হ্রাস পেতে পারে। অপরিষ্কার সুঁচ অথবা সিরিঞ্জ ব্যবহারের কারণে এইচআইভি এইডস, হেপাটাইটিস বি ও ধনুষ্টংকার দেখা দিতে পারে। মাদকাসক্ত মায়েদের গর্ভে জন্মগ্রহণকারী শিশুদের ও মায়েদের কাছ থেকে আসক্তি ও রোগ সংক্রমণ লাভের সম্ভাবনা রয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে ব্যবহার করলে কোন মাদক জীবনের সকল বিষয়ে উৎসাহ হারিয়ে ফেলার মতো অবস্থা সৃষ্টি করে। মাথাব্যথা, পাকস্থলির গোলযোগ, চামড়ার ফুসকুড়ি এবং ক্রোধ ও বিরক্তির অনুভূতি হতেও দেখা যায়। আসক্ত মায়েদের গর্ভস্থ সন্তানদের যকৃত, মস্তিষ্ক, হৃৎপি- ও ফুসফুসে ক্ষতি হয়, জন্মের পর এসব শিশুর মধ্যে পরিহারজনিত লক্ষণসমূহ দেখা দিতে পারে। ভয়ঙ্কর ইয়াবা : ইতোমধ্যেই দেশে ইয়াবা আসক্তির সংখ্যা ৩০ লাখ ছাড়িয়ে গেছে বলে ধারণা করছে মাদকনিয়ন্ত্রণ অধিদফতর। বাংলাদেশের শহর জনপদের ধনী পরিবারের সন্তানদের মধ্যে সম্প্রতি ইয়াবা আসক্তির যে প্রবণতা দেখা দিয়েছে, তা সমগ্র জাতির জন্য এক ভয়াবহ পরিণতির ইঙ্গিতবাহী। ইয়াবা কেবল আমাদের তরুণ প্রজন্মের প্রাণশক্তি ও মেধাকেই ধ্বংস করছে না, ইয়াবার কারণে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে অপসংস্কৃতি ও অপরাধেরও বিস্তার ঘটছে। ইয়াবার অপর নাম ঈৎধুু গবফরপরহব বা উত্তেজক ওষুধ। রাসায়নিক চরিত্র, শক্তি, কার্যকারিতা ও প্রতিক্রিয়া বিচারে এ্যামফিটামিন, মেথামফিটামিন কিংবা কোকেনের চেয়েও ইয়াবা শক্তিশালী উচ্চমাত্রার উত্তেজক মাদকদ্রব্য। দীর্ঘদিন ব্যবহারে যধষষঁপরহধঃরড়হ তৈরি হয় এবং ধীরে ধীরে ফুসফুস, লিভার এবং কিডনি নষ্ট হয়। এ নেশায় আসক্ত ব্যক্তি ব্যবহৃত মাত্রায় প্রয়োজনীয় ফলোদয় না হলেও চরম অবসাদ, হতাশা, বিষাদ ও নৈরাজ্য সৃষ্টি হয়। ব্যবহারকারী তখন যে কোন রকম অপ্রত্যাশিত আচরণ করতে পারে। এ অবস্থায় মানুষ খুন করাও বিচিত্র কিছু নয়। এমনকি হতাশা থেকে মাদকাসক্তকে আত্মহত্যার দিকেও নিয়ে যেতে পারে। বাংলাদেশে বছরে শুধু ইয়াবা বড়িই বিক্রি হচ্ছে ৪০ কোটির মতো, যার বাজার মূল্য হচ্ছে- ৬ হাজার কোটি টাকা (প্রতিটি ১৫০ টাকা) মাদকের ক্ষয়ক্ষতি : মাদকাসক্তির ভয়ঙ্কর চিত্র হচ্ছে যে, প্রয়োজনের বেশি অথবা নিয়মিত মাদক গ্রহণের ফলে ইয়াবা, গাঁজা, ফেনসিডিল, হেরোইন, কোকেনগ্রহণকারী মাদকাসক্তরা নানা ধরনের জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছে তার মধ্যে কিডনি, লিভার ছাড়াও মস্তিষ্কের স্বাভাবিক কাজকর্ম নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ফলে মাদকগ্রহণকারীরা ধীরে ধীরে অসুস্থ হয়ে মৃত্যু মুখে পতিত হয়। মাদকসেবীরা তাদের মাদক কেনার জন্য অর্থ সংগ্রহ করতে অবৈধ ব্যবসা, ছিনতাই, রাহাজানি, খুন, ধর্ষণ ও ডাকাতিতে জড়িয়ে পড়ছে। মাদকাসক্তির কারণে সমাজে সকল ধরনের অনাচার ও অপরাধ সংগঠিত হচ্ছে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী একজন মাদকাসক্ত তার নেশার পেছনে প্রতিদিন সর্বোচ্চ ৫০০ থেকে সর্বনিম্ন ৫০ টাকা খরচ করে। তবে বেশির ভাগের ক্ষেত্রেই দৈনিক খরচ ১০০ থেকে ২০০ টাকার মধ্যে। আর পক্ষান্তরে এই নেশার টাকার জোগান দিতে আসক্তরা বেছে নেয় বিভিন্ন অন্যায় পথ। যার ফলে ঘটছে খুন, ছিনতাই, ডাকাতির মতো ঘটনা। নেশার জন্য বাবা খুন হচ্ছে সন্তানের হাতে। মাদক এখন সকল অপরাধ ও সন্ত্রাসের জনক। একজন যখন অপরাধের জগতে পা বাড়ায়, তখন পা রাখে ড্রাগ বা মাদকের নেশায়। সুতরাং, এটা সহজেই অনুমান করা যায় যে, দেশে মাদকাসক্তির কারণে যুব সমাজের নিজেদের জীবনই শুধু বিপন্ন হয় না, এতে গোটা পরিবার ও সমাজ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাছাড়া ইনজেকশনের মাধ্যমে মাদক গ্রহণের কারণে দেশে এইডস আক্রান্তের সংখ্যাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিবাহ বিচ্ছেদের অনেকগুলো কারণের মধ্যে মাদকাসক্তি একটি বড় কারণ। একটি পরিসংখ্যানে দেখা গেছে যে, জীবনীশক্তি ধ্বংসকারী ইয়াবা সেবনকারীরা খুব অল্প সময়ের মধ্যেই মানসিক বিকারগ্রস্ত হয়ে পড়ছেন এবং যৌনশক্তি হারিয়ে ফেলেছেন চিরতরে। মাদকাসক্তি প্রতিরোধের কার্যকর উপায় হচ্ছে- ১.মাদকদ্রব্য ও মাদকাসক্তির বিরুদ্ধে সামাজিক সচেতনতা গড়ে তোলা। ২. মাদকদ্রব্যের অনুপ্রবেশ সম্পূর্ণ বন্ধ করা। ৩.মাদক ব্যবসার সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িতদের গ্রেফতার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা। ৪. বেকারদের কর্মসংস্থান। ৫. স্কুল-কলেজে সাধারণ শিক্ষার পাশাপাশি মাদকাসক্তির কুফল সম্পর্কে শিক্ষা প্রদান এবং সাংস্কৃতিক ও খেলাধুলা কার্যক্রমকে বাধ্যতামূলক করা। ৬. মাদকাসক্তদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা। মাদকদ্রব্য অপব্যবহারের আইন ও শাস্তির বিধান হেরোইন, ফেনসিডিল, আফিম, মরফিন, নেশার, ইনজেকশন, গাঁজা, ভাং, মদ, তাড়ি, ঘুমের ওষুধ ইত্যাদিরও উৎপাদন, চোরাচালান সংগ্রহ, সংরক্ষণ, বহন-পরিবহন, ক্রয়-বিক্রয় ও ব্যবহার মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে নিষিদ্ধ ও মারাত্মক অপরাধ। এসব অপরাধ দ্রুত বিচার আদালতে বিচার্য এবং এ ক্ষেত্রে সাধারণত জামিন দেয়া হয় না। মাদক অপরাধের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ড। মাদকবিরোধী অভিযান ও সরকারী চাকরিতে প্রবেশের আগে মাদক পরীক্ষা বর্তমানে দেশে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে মাদকবিরোধী অভিযান চলছে। মাদক নির্মূলে গ্রহণ করা হয়েছে জিরো টলারেন্স, ক্রসফায়ারে তিন শতাধিক চোরাচালানী ও ব্যবসায়ীর মৃত্যুর খবরও আছে। এখন থেকে সরকারী চাকরিতে ঢোকার আগে প্রার্থীদের ডোপ টেস্ট বা মাদক পরীক্ষা করা হবে। যাদের ডোপ টেস্ট পরীক্ষার ফলাফল পজিটিভ হবে, তিনি চাকরির জন্য অযোগ্য হিসেবে বিবেচিত হবেন। লেখক : একুশে পদকপ্রাপ্ত এবং শব্দসৈনিক (স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র) প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, মানস (মাদকদ্রব্য ও নেশা নিরোধ সংস্থা) উপদেষ্টা : জাতীয় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ উপদেষ্টা কমিটি [email protected]
×