ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

নাজনীন বেগম

কিশোরদের অপরাধপ্রবণতা

প্রকাশিত: ০৯:৪০, ২৩ জুলাই ২০১৯

 কিশোরদের অপরাধপ্রবণতা

বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল একটি দেশ অগ্রগতির অব্যাহত ধারায় এগিয়ে সেটা যেমন দৃশ্যমান পাশাপাশি সামাজিক অবক্ষয়ও কোন্ মাত্রায় পৌঁছে যাচ্ছে তাও বিশেষভাবে লক্ষণীয়। যেমন সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে আমাদের কোমলমতি কিশোর সমাজ। সংবাদ মাধ্যমে প্রতিনিয়তই কিশোর অপরাধের যে পরিমাণ সহিংস চিত্র প্রদর্শিত হচ্ছে তাতে দেশের ভাবী প্রজন্মের জীবন গড়ার ক্ষেত্রটিই না অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে যায়। এটা অবধারিত সত্য যে, সমাজবহির্ভূত অপকর্ম সংঘটিত হয় স্বল্পসংখ্যক কিন্তু তার বিষবাষ্প এত ছড়ানো ছিটানো যে পুরো পারিপার্শ্বিক সুস্থ আবহকে ঠেলে দেয় বিপর্যয়ের আবর্তে। শঙ্কা এবং বিপদ এখানে, যথার্থ প্রতিকার যদি চিহ্নিত করতে আরও ভুল করা হয়, তাতে সমস্যার সুরাহা তো হবেই না, বরং লাগামহীন হয়ে ভয়ঙ্কর রূপ নেবে। অপরাধপ্রবণতা কিংবা সামাজিক ব্যবহার বিধির বিচ্যুতি নতুন কোন প্রত্যয় নয়। সৃষ্টির আদিকাল থেকে এমন সামাজিক অসংহতিকে মোকাবেলা করেই সভ্যতা সূর্যকে ছিনিয়ে আনতে হয়েছে। শক্তিশালী ব্যক্তিসত্তার কাছে দুর্বলের পরাজয় মানুষ দেখে আসছে। আর সেখানে সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন যদি অশনি সঙ্কেতের মতো ভয়াবহ রূপ নেয় তার গতি প্রকৃতি যে বিধ্বংসী হবে, সেটা বলাই বাহুল্য। অপরাধ সমাজের নানা স্তরে তার কালো থাবা বিস্তার করছে। কিন্তু কিশোররা কেন এত বেশি জড়িয়ে পড়ছে, সেটাও ভাববার বিষয়। কিশোর আর বয়োসন্ধিকাল ওতপ্রোতভাবে জড়িত। যা কোন অপ্রাপ্তবয়স্ক প্রজন্মের জন্য এক নতুন এবং দুঃসহ অভিজ্ঞতা পাড়ি দেয়া। সেখানে পারিবারিক দায়-দায়িত্ব কতখানি তার সন্তানটিকে ছায়া দিতে পারে, সেটা মা, বাবা কিংবা অভিভবাককে গভীর উপলব্ধিতে সচেতন হওয়া একান্ত আবশ্যক। উঠতি বয়সের ছেলেমেয়েরা পারিবারিক স্নেহ বন্ধনে তাদের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সময়গুলো পার করে। বয়োসন্ধিকাল উঠতি কিশোরদের গন্তব্য নির্ধারণেও বিরাট ভূমিকা রাখে। শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তনের এমন অনিবার্য পর্বটি যেমন সন্তানদের, একইভাবে পিতা মাতাকে উদ্বিগ্ন আর শঙ্কিত অবস্থার মধ্যে ফেলে দেয়। বাবা-মা নিজেই এক সময়ের এমন পর্যায়টি পার করার স্মৃতিকে নতুনভাবে স্মরণ চেতনায় আনতে সচেষ্ট হয়। এই দুঃসহ ক্রান্তিকাল উদীয়মান কিশোর আর তরুণদের যেভাবে মোহাবিষ্ট করে রাখে, যার ভাল-মন্দ উভয়ই সংশ্লিষ্টদের দোলাচলে নিয়ে যায়। ন্যায়-অন্যায়বোধ, স্বপ্নাচ্ছন্ন আকাক্সিক্ষত প্রত্যাশা, সমাজের নতুন সময়ের আহ্বান, ঐতিহাসিক জগতের অনুপ্রেরণা সব মিলিয়ে নতুন প্রজন্ম গন্তব্য স্থির করতে হিমশিম খায়। এমন শঙ্কিত অবস্থা সব কালে সব যুগে ছিল। মহাকবি গ্যেটে বলেছিলেন, আমার বয়স যখন আঠারো মনে হতো পুরো জার্মানি তখন ১৮তে পা দিল। গ্যেটের সঙ্গে একই ভাব সম্পদে উদ্বুদ্ধ হয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই কবির বর্ণাঢ্য বচন পুনরুক্তি করেছিলেন। আর বিপ্লবী কবি সুকান্ত আঠারো বছর নিয়ে ছন্দোবদ্ধ কবিতায় সবাইকে চমক লাগিয়ে দিলেন। সুতরাং বয়সের এমন স্পর্শকাতর পালাক্রমে বিভিন্ন যুগে ও কালে কবি-সাহিত্যিক থেকে শুরু করে অতি সাধারণ কিশোর-কিশোরীরাও মোহাচ্ছন্ন আবেশে নিজেদের তাড়িত করেছে। এ এক স্বাভাবিক জীবন প্রক্রিয়া যেখানে কৈশোরের যুগ সন্ধিক্ষণ ভাবের সাগরে নিমজ্জিত হয়। ভাল-মন্দের বিচার বুদ্ধিতে নিজের ওপর আস্থা এত বেশি থাকে যে, চারপাশের নিকটজনের সাহচর্য কিংবা পরামর্শকে গুরুত্বহীন ভেবে নেয়। রঙিন পৃথিবীর ঝলমলে আলোকিত জগত তার সমস্ত আবেদন নিয়ে ভাল-খারাপ যাই হোক কেন উদীয়মান কিশোরকে হাতছানি দিতে থাকে। আর সমাজ ব্যবস্থার গভীরে যদি ভয়ঙ্কর অপসংস্কার গ্রথিত থাকে, তাহলে তেমন সর্বগ্রাসী দুর্যোগে নিজেদের সমর্পণ করা অনেকটা সহজ হয়ে যায়। বর্তমানে বাংলাদেশে খুন, জখম, ধর্ষণ, ছিনতাই ও রাহাজানির মতো ঘৃণ্য অপকর্মগুলো ক্রমান্বয়ে বেড়েই চলেছে। শুধু তাই নয়, পরিসংখ্যানের তথ্যে উঠে আসছে কিশোররাও এই জঘন্য অপরাধের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পৃক্ত। মাদকের মতো সর্বনাশা প্রকোপ থেকেও রেহাই পাচ্ছে না নতুন প্রজন্ম। ক্ষমতাবানদের নিয়ন্ত্রিত চারপাশের অন্ধকার বলয় যেভাবে তার অশুভ ছায়ায় তরুণ প্রজন্মের জীবনকে বিভীষিকাময় করে তুলছে, তার থেকে পরিত্রাণ পাওয়া অনেক জরুরী। সমাজের আদি এবং অকৃত্রিক প্রতিষ্ঠান পরিবার যতই ক্ষুদ্র হোক না কেন আধুনিক তরুণ সমাজের সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবন গড়ার ক্ষেত্রে সব থেকে বেশি ভূমিকা রাখে। বাবা-মা-ভাই-বোনকে নিয়ে যে ছোট্ট সংগঠনটি সভ্যতার সূচনা লগ্ন থেকে মায়া-মমতার গ্রন্থিতে সবাইকে আঁকড়ে ধরে, তার চেনা বলয় আজও তার মর্যাদা হারায়নি বলেই মনে হয়। তবে সামাজিক বিচ্যুতি কিংবা বিপন্নতার শিকার হওয়া কোন কিশোর যদি কোন কারণে বিভ্রান্তিতে পড়ে, তাহলে পরিবারকেই সবার আগে সচেতন দায়বদ্ধতায় তৎপর হতে হবে। অনেক পারিবারিক বিরূপ আবহে সন্তানের বিপথে চলে যাওয়া, এমন নজিরও কম নেই। সমাজের কিছু নেতিবাচক কর্মকা- অপরাধের যে জাল বিস্তার করে সেখানে নিজেকে সমর্পণ করা যত সহজ অবোধ বয়সে, তার চেয়ে কঠিন সেই চক্রব্যূহকে ভেদ করে সুস্থ সামাজিক পথ স্থির করা। তেমন ক্রান্তিকালে সন্তানকে বটবৃক্ষের মতো ছায়া দিতে হবে বাবা-মাকে। বয়সের পালাক্রমে তার ভাল আর মন্দ লাগাই শুধু নয় পছন্দ-অপছন্দের মাত্রায় ভেতরের ক্ষমতাকেও বিবেচনায় আনতে হবে। একজন অবোধ বালক কিংবা বালিকা ছবি আঁকতে পছন্দ করে, সঙ্গীতের মূর্ছনা তাকে মুগ্ধতার জায়গায় নিয়ে যায়, সেসব স্পর্শকারত বিষয়কে অত্যন্ত সতর্কভাবে উপলব্ধিতে আনতে হবে। বর্তমানে যে শিক্ষাকার্যক্রম কোমলমতি শিশু-কিশোরদের নাভিশ্বাস ওঠার পর্যায়ে নিয়ে এসেছে, তাতেও সন্তানদের এক প্রকার হয়রানির শিকার হতে হয়। সময় অসময়ে ক্লাস আর কোচিংয়ে ছুটে চলাই নয়, জিপিএ-৫ এর জন্য প্রাণান্ত প্রচেষ্টা সত্যিই এক অভাবনীয় দুর্ভোগ। এমন সব সামাজিক দুরন্ত আবহকে মোকাবেলা করতে করতে ক্লান্ত, অবসন্ন কিশোর-কিশোরীরা হাঁফ ছেড়ে বাঁচতে চায়। জ্ঞানার্জনের বিষয়টি স্বতঃস্ফূর্ত এবং আনন্দের। সেখানে পরীক্ষা নামক নিরানন্দ ব্যাপারটি যখন আরও কষ্টদায়ক হয়ে ওঠে, তখন লেখাপড়া কেমন হয় জানি না, সন্তানটি মানসিক সুস্থতাকে নির্বিঘ্নে পার করতে পারে না। সব সময় নম্বর আর পরীক্ষায় মেধা ও মননের সহজ বিকাশের পরিক্রমাও যখন বিপত্তির কবলে পড়ে, তখন সত্যিই কোন শিশু-কিশোর স্বাভাবিক পথনির্দেশনা আমলে নিতে চায় না। অন্য পথে ভিন্ন উপায় খোঁজাটা বিচিত্র কিছু নয়। শিক্ষা কার্যক্রমের নিয়ম পদ্ধতি পাল্টানো এত সহজ নয়। বরং পারিবারিক চাপ থেকে সন্তানদের জীবনকে আরও স্বচ্ছন্দ্য গতিতে চালিত করা আয়ত্তের মধ্যেই থাকে। সময়ের পরিবর্তনে নতুন অনেক যুক্ত হলেও সন্তানদের ওপর থেকে অতিরিক্ত চাপ কমানো মা-বাবাই পারেন। সন্তানের লেখাপড়ার দিকে বিশেষ নজর দিয়েও ফলাফলের জন্য বেশি উদ্বিগ্ন না হওয়াই শ্রেয়। পরীক্ষার রেজাল্ট যাই আসুক না কেন, নিজের মনের খুশিতে লেখাপড়াকে ভালবেসে যা করতে পারবে তাতেই সন্তুষ্ট থাকা সমীচীন। শিশু-কিশোর বয়সের পড়ালেখার চাইতেও বেশি গুরুত্বপূর্ণ উচ্চ শিক্ষায় নিজেদের সাবলীলভাবে যুক্ত করা। সততা ও আদর্শ নিষ্ঠতায় জীবনের লক্ষ্য তৈরি করে ভাবী প্রজন্ম নিজেরাই ঠিক করবে কোথায় তাদের গন্তব্য। এটুকু স্বাধীনতা তাদের অভিভাবকরাও পেয়েছেন। নতুন প্রজন্মকেও তাই দিয়ে এগোনোর পথ নির্বিঘ্ন করতে হবে। ব্যস্ত মা-বাবা প্রয়োজনীয় সময়টুকু দিয়ে সন্তানকে উদ্বুব্ধ করে নির্দেশনা দেবেন ঠিকই, সেখানে তার পছন্দ-অপছন্দকে গুরুত্ব দেয়াও যৌক্তিক দাবি। সন্তান ভুল করলে অবশ্যই তা শোধরানোর দায়িত্বও পিতা-মাতার। বিরূপ সামাজিক পরিবেশ থেকে সযত্ন সুরক্ষায় তাকে আগলে রাখতে বাবা-মায়ের বিকল্প নেই। বর্তমানে কেন কিশোররা বিভিন্ন অপকর্মে সংযুক্ত হয়ে সমাজবহির্ভূত কার্যকলাপে জড়িয়ে পড়ছে, সেটা খতিয়ে দেখার সময়কে আর অবহেলায় হারালে চলবে না। প্রত্যেক সন্তানের নিজস্ব ব্যক্তিত্ব বিকাশ যেভাবে হয়, সেখানেই অপরাধ সংক্রান্ত ব্যাপারগুলোও দানা বাঁধতে থাকে। এরই প্রেক্ষিতে সন্তানের দেখভাল করা মা-বাবার বিশেষ কর্তব্যের মধ্যেই পড়ে। এ ক্ষেত্রে শুধু সমাজ নয়, বাবা-মাকেও দিতে হবে সুস্থ জীবনের দিক নির্দেশনা। লেখক : সাংবাদিক
×