ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

২৩ জুলাই, ১৯৭১

এই রক্তস্নানের কি কোন শেষ নেই?

প্রকাশিত: ০৯:৪১, ২৩ জুলাই ২০১৯

 এই রক্তস্নানের কি কোন শেষ নেই?

শাহাব উদ্দিন মাহমুদ ॥ ১৯৭১ সালের ২৩ জুলাই দিনটি ছিল শুক্রবার। এই দিন লে. মাহবুবের নির্দেশে মুক্তিবাহিনীর ১৫ জনের একটি কমান্ডো প্লাটুন পাকসেনাদের মিয়া বাজার ক্যাম্পের ওপর অতর্কিত আক্রমণ চালায়। এক ঘণ্টাব্যাপী যুদ্ধে ২০ জন পাকসেনা নিহত ও ১০ জন আহত হয়। সফল অভিযান শেষে মুক্তিযোদ্ধারা নিরাপদে নিজ ঘাঁটিতে ফিরে আসে। কসবায় মুক্তিবাহিনীর একটি এ্যামবুশ দল কল্যাণ সাগরের কাছে পাকসেনাদের একটি বড় দলকে আক্রমণ করে। এই আক্রমণে ২০ জন পাকসেনা ও ১ জন দালাল নিহত হয় এবং ৮ জন আহত হয়। ২-৩ ঘণ্টা যুদ্ধের পর পাকসেনারা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় এবং মুক্তিযোদ্ধারা অবস্থান ত্যাগ করে নিজ ঘাঁটিতে চলে আসে। মুক্তিবাহিনীর একটি গেরিলা দল কুড়িগ্রামে পাকবাহিনীর বড়খাতা ঘাঁটি আক্রমণ করে। এতে উভয় পক্ষের মধ্যে তুমুল যুদ্ধ হয়। এ যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর সিপাহী আনোয়ার হোসেন ইপিআর শহীদ হন। কমান্ডার আব্দুল হকের নেতৃত্বে ৪১ জন মুক্তিযোদ্ধা শম্ভুগঞ্জ-ফুলপুর-হালুয়াঘাট রাস্তার ওপর নির্মিত নাগলা ব্রিজ ধ্বংস করে। রাত ১২টার সময় মুক্তিযোদ্ধারা নাগলা ব্রিজের কাছে গিয়ে ফায়ার করার সঙ্গে সঙ্গে ব্রিজ পাহারারত রাজাকাররা পালিয়ে যায়। মুক্তিযোদ্ধারা নির্বিঘ্নে নাগলা ব্রিজ ধ্বংস করে । দুপুর ১২টায় সিদ্ধিরগঞ্জের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈদ্যুতিক লাইন সফলভাবে ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। গেরিলারা প্রথমেই শত্রুদের স্থাপিত ৪৫টি এ্যান্টি পার্সোনাল মাইন নিষ্ক্রিয় করে দেয়, যার মধ্যে ১২টা ছিল বড় মাইন। ডেমোক্র্যাট দলীয় সিনেটের স্টুয়ার্ট সিমিংটন মার্কিন সিনেটে প্রশাসনের বিরুদ্ধে ইচ্ছাকৃতভাবে পাকিস্তানে অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহ বন্ধ না করার অভিযোগ করেন। তিনি বলেন, পাকিস্তানে যে অস্ত্র প্রেরণ শুরু হয়েছে তা আইনসঙ্গত অধিকার বলেই বন্ধ করা যেত। কিন্তু প্রশাসন ইচ্ছা করেই সে সিদ্ধান্ত নেননি। মুসলিম লীগ নেতা কাজী কাদের বলেন, ‘পাকিস্তান চিরদিন অবিভাজ্য থাকবে, কোন শক্তি নেই পাকিস্তানকে বিভক্ত করে। শেখ মুজিব পাকিস্তানকে বিভক্ত করতে চেয়েছিল। তাই মুসলিম লীগ সব সময়ই আওয়ামী লীগের বিরোধিতা করেছে। পাকিস্তানের মাটিতে শেখ মুজিবের ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি টিকবে না। ’ সিয়েরা লিওনের ফ্রিটাউন থেকে প্রকাশিত ‘মেইল’ পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠা জুড়ে এক দীর্ঘ রিপোর্ট বের হয়। বাংলাদেশের লাখ লাখ শরণার্থী সম্পর্কে লিখতে গিয়ে সংবাদদাতা সোম সোর্ট লেখেন, পশ্চিম পাকিস্তানীদের বর্বরতা ক্রমে বেড়েই চলেছে, যুদ্ধ যত দীর্ঘস্থায়ী হবে বাংলাদেশে ধ্বংস ও মৃত্যু তত বেড়ে যাবে। পৃথিবীর সকল দেশের মানুষই তো এখন এখানকার ঘটনাবলীর অল্প বিস্তর জানতে পেরেছে কিন্তু তবু আমরা আমাদের নিজ নিজ দেশের সরকারকে পাকিস্তানের ওপর চাপ সৃষ্টিতে বাধ্য করতে পারছি না কেন? এই রক্তস্নানের কি কোন শেষ নেই? নিউইয়র্কের ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল একটি বিভক্ত দেশ শিরোনামে এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, ধর্ম, বর্ণ ও দারিদ্র্য নির্বিশেষে পূর্ব পাকিস্তানের যুদ্ধ দ্বিধাচ্ছন্ন, কোন আসন্ন সমাধান এ মুহূর্তে আশা করা যাচ্ছে না, নাগরিকরা কোন রকমে বেঁচে আছেন, বাঙালীরা সামরিক শাসনে নিগৃহীত হচ্ছে, অথচ কি সমস্যা, সে প্রশ্নের কোন উত্তর নেই। পূর্ব পাকিস্তানের একটি শহরে, একজন ডাক্তার তার রাস্তার পাশের চেম্বারে বসেন রোজই, মাঝে মাঝে রোগীর আশায় বাইরে তাকান, যেখনে এখন ধুলাবালি, লুটপাট হওয়া দোকান আর ঘরবাড়ির কিছু অংশ পরে আছে কেবল। মাঝে মাঝে রাস্তায় ইউনিসেফের চিহ্ন আঁকা, কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানী সেনা বোঝাই কিছু গাড়ি রাস্তায় টহল দেয়, এ ছাড়া গোটা রাস্তায় কোন জনমানুষের দেখা নেই। ডাক্তার নিজেও এখনও পর্যন্ত চেম্বারে বসে আছেন, কারণ তাকে এমনটাই নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তার পরিবার শহরের বাইরে কোথাও লুকিয়ে আছে। তিনি ফিসফিস করে কথা বলেন, কেননা, রাস্তার যে কোন পথিক গুপ্তচর হতে পারে। রাতের বেলা যখন আর্মিরা বিভিন্ন বাড়ির দরজার কড়া নাড়ে, তিনি ভয়ে থাকেন যে যে কোন দিন তার নামও ওই তালিকায় থাকতে পারে। নগরে এখন কি হচ্ছে, রাস্তায় পড়ে থাকা পচা-গলা দেহাবশেষ, ঘরে ঘরে আগুন, লুটপাট, ধর্ষণ আর চলতে থাকা সন্ত্রাসের কথা ডাক্তার বলছিলেন, ফিসফিসে গলায়। ‘আমরা সত্যি কথা বলতে ভয় পাই। যারা সত্যি বলে, তারা শাস্তি পায়, আর একমাত্র শাস্তি হচ্ছে মত্যু’, তিনি বললেন। এই ডাক্তার একজন প্রাক্তন সেনা কর্মকর্তা হওয়ার কারণেই তার প্রাক্তন সহকর্মীদের জন্য আরও বেশি চিন্তিত আছেন। কিন্তু তার আসল অপরাধ, এমন একটি ভূখন্ডে জন্মগ্রহণ করা, যা বাঙালীদের ভূখ- হিসেবে পরিচিত এবং তা পাকিস্তানের একটি অংশও বটে। এখন এই ভূখন্ড কেবলি মৃত্যু আর ভীতির এক রাজ্য। চার মাসের কম সময় ধরে পূর্ব পাকিস্তানে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়েছে, কিন্তু এতদিনে এই যুদ্ধের কারণ মোটামুটি জানা হয়ে গেছে। এই যুদ্ধের ভৌগোলিক, ঐতিহাসিক উৎস, কারণ- সবই যেন ধুয়ে গেছে রক্তের বন্যায়। ২৫ মার্চ থেকে এখন পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তানে ঠিক কত মানুষ মারা গেছে তার কোন সঠিক হিসাব নেই। পশ্চিমা কূটনৈতিকরা বলছেন সংখ্যাটি কমপক্ষে ২ লাখ থেকে সর্বোচ্ছ ১০ লাখ। এটি ছিল বাঙালীদের করা একটি রাজনৈতিক আন্দোলন, যার মূলে ছিল পশ্চিম পাকিস্তানীদের প্রায় দুই শতক ধরে চালিয়ে যাওয়া অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক শোষণের বিরোধিতা। মার্চে তা আরও প্রকট আকার ধারণ করে, যখন বাঙালী আওয়ামী লীগ দল নির্বাচনে জয় লাভ করে এবং পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের একটি সম্ভাবনা দেখা দেয়। কিন্তু ২৫ মার্চ রাতে, বাঙালীরা স্বাধীনতার দাবি করছে এই ভয়ে, পাকিস্তানী আর্মি পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকার ওপর হামলা করে। বাঙালী ছাত্রদের তারা হত্যা করে, রাজনীতিবিদদের গ্রেফতার করে এবং আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। আতঙ্কিত বাঙালী শাসিত হচ্ছে সেনা বাহিনী ও কঠোর সামরিক দমন আইনের আওতায়। পশ্চিম পাকিস্তানী কর্তৃপক্ষ বলেই যাচ্ছেন যে সবকিছু স্বাভাবিক অবস্থায় আছে। কিন্তু আর্থিক অবস্থা চরমভাবে বিপর্যস্ত, কলকারখানাগুলো অচল, স্কুল বন্ধ, রাস্তাঘাট বেশিরভাগই ফাকা, শহরবাসীরা বেশিরভাগই শহর ছেড়ে চলে গেছে। লাখ লাখ বাঙালী, বিশেষ করে হিন্দু ও মধ্যবিত্ত মুসলিম পরিবার গ্রামে লুকিয়ে আছেন। এখনও প্রতিদিন ৫০ হাজার শরণার্থী পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নিচ্ছে। বাঙালীদের প্রবল সমর্থনপুষ্ট মুক্তি বাহিনী বা বাঙালী গেরিলা বাহিনী প্রতিনিয়তই সেনাদের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হচ্ছে। দারিদ্র্য, অবহেলা, আর হতাশার ফলে এমন যুদ্ধের সূচনা করেছিল কঙ্গো আর আলজিরিয়াতেও। মানুষ শুধু রাজনৈতিক কারণে না, ধর্ম ও বর্ণের নামেও হত্যা করছে পরস্পরকে। মুসলিম দর্শন অনুযায়ী চোখের বদলে চোখ কিংবা দাতের বদলে দাতের মতো প্রাচীন ধারণাও এমন গোষ্ঠীবদ্ধ অনুতাপের কারণ বলা যায়। সেনাবাহিনী হত্যা করছে বাঙালীকে, প্রায় ২০ লাখ সংখ্যালঘু অবাঙালী সেনাবাহিনীকে সমর্থন করে। সুতরাং বাঙালীরা হত্যা করছে বিহারীদের। প্রায় ১ কোটি সংখ্যালঘু হিন্দু নিশ্চিতভাবেই সেনাবাহিনীর হাতে বলি হচ্ছে। এমনকি কিছু বাঙালী মুসলিমও এই হত্যাযজ্ঞে সানন্দে যোগদান করছে। এই বিক্ষিপ্ত গোলযোগের সুযোগ নিয়ে অনেক গ্রাম, বাহিনী বা ব্যক্তি আর্থিক লাভের আশায় বা ব্যক্তিগত প্রতিহিংসায় আক্রমণ করছে একে অপরকে। এ তথ্যগুলো পূর্ব পাকিস্তানের ভেতর থেকে ঘুরে এসেছেন, এমন ব্যক্তিদের কাছ থেকেই শোনা। এই ডাক্তারের মতোই, বাঙালীরা মুছে ফেলছেন তাদের পূর্ব পরিচয় বা শহরে বসবাসের ঠিকানা। বাঙালীরা সাংবাদিকদের সঙ্গেও কথা বলেন না প্রাণ হারানোর ভয়ে। বেশিরভাগই মুখ খোলেন না, এমনকি অপরিচিতের কাছে সাহস করে ভিক্ষার আবেদন করে না কোন ভিক্ষুকও। স্বাভাবিকভাবে বিশ্বের অন্যতম দরাজ কণ্ঠের এই বাঙালীরা, এখন বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ভাব আদান প্রদান করেন চোখের চাহনির মাধ্যমে, ভীতসন্ত্রস্ত বাঙালী চোখে চোখ রেখে কথা বলে না- অন্যদিকে তাকিয়ে থাকে, লজ্জায় অবনত চাহনি মিশে থাকে মাটির সঙ্গে, আর নয়ত চুপিচুপি ইশারাতেই তারা প্রকাশ করতে চান নিজেদের অনুভূতি। ... জনাব ম্যাকগভার্ন সিনেটে পূর্ব পাকিস্তান পরিস্থিতি নিয়ে প্রদত্ত বক্তব্যে বলেন, জনাব প্রেসিডেন্ট, পূর্ব পাকিস্তানের রক্তক্ষয় ও দমনের বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে আমাদের ওয়াকিফহাল হওয়া উচিত। গত বছরের ঘূর্ণিঝড় বিপর্যয়ে বিধ্বস্ত এই ভূমি এখন আনুষ্ঠানিক সহিংসতার শিকার হয়েছে। বর্তমান বিশৃঙ্খল রাষ্ট্র পূর্ব পাকিস্তান যেখানে অধিকাংশ জনগণ গ্রামাঞ্চলে আত্মগোপন করে রয়েছে এবং ৭০ লাখেরও বেশি মানুষ দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছে, সেখানে দুর্ভিক্ষের সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। এই মুহূর্তে আর্থিক সহায়তা অব্যহত রাখা নয়, বরং বাঙালীদের জন্য রেড ক্রস বা অন্য কোন আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের তত্ত্বাবধানে চিকিৎসা সরঞ্জাম, শস্য এবং অন্য খাদ্যসামগ্রী সরবরাহ করার উদ্যোগ গ্রহণ করাই হবে সর্বাপেক্ষা উপযুক্ত আমেরিকান পদক্ষেপ। উদ্বাস্তুদের এই সুবৃহৎ ঢলের কারণে নিশ্চিতভাবে ভারতের সম্পদ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ভাসমান বাঙালীদের সহায়তায় ভারতের এই মানবিক কার্যক্রমের প্রতি আমাদের সমর্থন প্রসারিত করা উচিত। ভারতীয়দের জন্য খাবার ও চিকিৎসা চালান এবং বরাদ্দকৃত শরণার্থী ত্রাণ তহবিল অনুমোদন করা উচিত যাতে তারা যেই গভীর সঙ্কটের মুখোমুখি তা মোকাবেলা করতে পারে। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত ইংরেজী অনুষ্ঠান ওয়ার্ল্ড প্রেস রিভিউ অন বাংলাদেশে বলা হয়, ২৫ মার্চ রাতে সেনাবাহিনী এসে বঙ্গবন্ধুর বাড়ি ঘিরে ফেলে গুলি চালানো শুরু করেছিল। নৈতিক শক্তির বলে বলীয়ান শেখ মুজিব বেলকনিতে বেরিয়ে এসেছিলেন এবং আর্মি অফিসারকে বলেছিলেন তাকে গ্রেফতার করে এই অর্থহীন গুলিবর্ষণ থামাতে। পাকিস্তান এখানে আরও একটি ধ্বংসযজ্ঞ চালাবে যখন তারা বুঝতে পারবে যে তারা আর বাংলাদেশকে আয়ত্তে রাখতে পারবে না। প্রচুর অর্থ-সৈন্য খরচ করে তারা কোনমতে বাংলাদেশের শহরগুলোকে নিয়ন্ত্রণে রেখেছে। কিন্তু উত্তরোত্তর আগ্রাসী হয়ে ওঠা মুক্তিবাহিনী সেটাকেও দুঃসহ করে তুলছে। লেখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক [email protected]
×