ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ঐতিহাসিক ‘দিব্যক জয়স্তম্ভ’ বিশ্বজিৎ মনি

অনুপম পুরাকীর্তি-হতে পারে আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্র

প্রকাশিত: ১০:১৬, ২৩ জুলাই ২০১৯

অনুপম পুরাকীর্তি-হতে পারে আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্র

নওগাঁর পত্নীতলা উপজেলার ধীবরদীঘির মধ্যস্থানে অবস্থিত ঐতিহাসিক ‘দিব্যক জয়স্তম্ভ’। স্যার আলেক জ্যান্ডার কার্নিংহাম ও স্যার বুকানন হ্যামিলটনের পরিদর্শন করা এই ঐতিহাসিক ধীবরদীঘির ‘দিব্যক জয়স্তম্ভ’ সঠিক উদ্যোগ নিলে দেশের অন্যতম পর্যটন কেন্দ্রে পরিণত হতে পারে। ঐতিহাসিক ধীবরদীঘিতে স্থাপিত প্রাচীন স্থাপত্য পুরাকীর্তির অনুপম নিদর্শন এবং হাজার বছরের বাংলা ও বাঙ্গালীর শৌর্য-বীর্জের প্রতীক হিসেবে কালের ভ্রুকুটি উপেক্ষা করে আজো দ-ায়মান দীঘির মাঝখানে এই ‘বিজয়স্তম্ভ’টি। আর সেটি দেখার জন্য দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে প্রতিদিন শত শত দর্শনার্থী ধীবরদীঘিতে ভিড় করে থাকে। ইতিহাস সমৃদ্ধ বরেন্দ্র ভূমি নওগাঁ জেলার পত্নীতলা উপজেলার ধীবর ইউনিয়নের ধীবর বা ধীবর নামক গ্রামে অবস্থিত এই দিব্যক জয়স্তম্ভ। দীঘিটিকে ঘিরে লোক মুখে অনেক গল্পকাহিনী বা কাল্পনিক কথা প্রচলিত আছে। এই ধীবরদীঘি স্থানীয় জনগণের কাছে কর্মকারের জলাশয় নামে পরিচিত। তথ্য অনুসন্ধানে জানা গেছে, দীঘিটি ৪০/৫০ বিঘা বা অর্ধ বর্গমাইল জমির ওপর অবস্থিত এবং গোলাকার। ধীবরদীঘির মধ্যখানে অবস্থিত আটকোন বিশিষ্ট গ্রানাইট পাথরের এতবড় স্তম্ভ বাংলাদেশে বিরল। এই স্তম্ভের সর্বমোট উচ্চতা ৩১ ফুট ৮ ইঞ্চি। পানির নিচের অংশ ৬ ফুট ৩ ইঞ্চি এবং পানির ওপরের অংশ প্রায় ২৫ ফুট ৫ ইঞ্চি। এর ব্যাস ১০ ফুট ৪ ইঞ্চি। প্রতিটি কোণের পরিধি এক ফুট সাড়ে তিন ইঞ্চি। এই স্তম্ভে কোন লিপি নেই। স্তম্ভের উপরিভাগ খাঁজকাটা অলঙ্করণ দ্বারা সুশোভিত। ধীবরদীঘির মধ্যস্থিত এই দিব্যক জয়স্তম্ভ প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য সম্পর্কে তিনটি পৃথক বিবরণ পাওয়া যায়। এক. দ্বিতীয় মহীপালকে পরাজিত ও হত্যা করার সাফল্যকে স্মরণীয় করার উদ্দেশে দিব্যক এই জয়স্তম্ভ নির্মাণ করান। দীনেশ চন্দ্র সেন ‘বৃহৎ বঙ্গে’ উল্লেখ করেছেন, ‘কৈবর্ত্যরাজ ভীমের খুল্ল পিতামহ দিব্যক দ্বিতীয় মহীপালকে যুদ্ধে পরাজিত ও হত্যা করে বিজয়োল্লাসে যে স্তম্ভ উত্থাপিত করেছিলেন, তা এখনও বৃহত্তর রাজশাহী জেলার কোন এক দীঘির ওপরে মস্তক উত্তোলন করে বিদ্যমান’। দুই. দিব্যকের রাজত্বকালে পাল যুবরাজ রামপাল বরেন্দ্র উদ্ধারের চেষ্টা করে দিব্যকের কাছে পরাজিত হন। দিব্যক এই সাফল্যের স্মৃতি রক্ষার উদ্দেশে দীঘি মধ্যস্থিত এই স্তম্ভটি নির্মাণ করেন। সন্ধ্যাকর নন্দীর রামচরিতের পরিচিতি পর্বে অনুবাদক বিজয় স্তম্ভটি নির্মাণের কারণ সম্পর্কে নিম্ন লিখিত বিবরণ লিপিবদ্ধ করেছেন। ‘পূর্ববঙ্গের ভোজ বর্মার তা¤্রশাসন হতে জানা যায়, দিব্যের বীরত্ব খ্যাতি তৎকালে উপমার বিষয় ছিল। অত্যল্পকালই বরেন্দ্রী দিব্যের রক্ষণাধীন থাকে। পূর্বোদ্ধৃত মনহলি লিপির ১৪ শ’ শ্লোক ও রামচরিতের ১/২৯ শ্লোক একত্র পাঠ করলে জানা যায়, দিব্যের রাজত্বকালে রামপাল (১০৮২-১১২৪) একবার পিতৃরাজ্য উদ্ধারে সচেষ্ট হয়ে ব্যর্থ হন। তৎকালীন দিনাজপুর জেলার (বর্তমানে নওগাঁ) দিবরদীঘি নামক একটি জলাশয় ও তন্মধ্যস্থিত শিলাস্তম্ভ আজও তার স্মৃতি রক্ষা করছে’। তিন. ভীম এই স্তম্ভটি নির্মাণ করেন এবং পিতৃব্য দিব্যকের স্মৃতি রক্ষার্থে স্তম্ভটি তার নামে উৎসর্গ করেন। প্রফেসর শিরিন আখতারের বিবরণে তার সমর্থন পাওয়া যায়। তবে যে উদ্দেশেই এই স্তম্ভটি নির্মিত হোক না কেন, এই দিবরদীঘি ও এর মধ্যস্থিত স্তম্ভটি দিব্যকের স্মৃতি আজও অম্লান করে রেখেছে। জানা গেছে, ১৮৭৯ সালের দিকে স্যার আলেক জ্যান্ডার কার্নিংহাম যখন এই দীঘি পরিদর্শনে আসেন, তখন এর গভীরতা ছিল ১২ ফুট এবং এর প্রত্যেক বাহুর দৈর্ঘ্য ছিল ১২ শ’ ফুট। বিজয় স্তম্ভটির শীর্ষদেশে মূল্যবান বস্তু আছে ভেবে কয়েক যুগ পূর্বে এর শীর্ষদেশের ক্ষতি সাধন করা হয়েছে। কথিত আছে, তারা প্রত্যেকে দীঘিতে ডুবে মারা গেছেন। যুগ যুগ ধরে দখলবাজদের কারণে দিবরদীঘির অনেক সরকারী সম্পত্তি বেদখল হয়েছে। বর্তমানে দিবরদীঘির জলাশয়ের পরিমাণ প্রায় ২০ একর। এ জলাশয় টুকুই সরকারী সম্পত্তি হিসেবে বজায় আছে। মাছ চাষের জন্য লিজ দিয়ে সরকার প্রতি বছর দীঘি থেকে প্রায় ১০ লাখ টাকা রাজস্ব আয় করছে। যুগ যুগ আগে থেকে দীঘির পাড়ে প্রতি বছর চৈত্র মাসে হিন্দু সম্প্রদায়ের বার্নি স্নানের মেলা বসত। এখনও মেলা বসে। সে সঙ্গে ২০০০ সালের দিক থেকে দিবর ইউপির তৎকালীন চেয়ারম্যান শেখ আনিছুর রহমান ও বর্তমান চেয়ারম্যান আব্দুল হামিদ মাস্টার দীঘিতে দর্শনার্থীদের আগমন বাড়াতে প্রতি বছর দুই ঈদের দিন ও তার পরবর্তী সাতদিন সেখানে ঈদের আনন্দ মেলার আয়োজন করে আসছেন। এতে করে মেলার ওই দুই দিনে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে লক্ষাধিক দর্শনার্থীর সমাগম ঘটে। সে সময় দিবর ইউপি চেয়ারম্যান শেখ আনিছুর রহমান ও সাবেক এমপি শামসুজ্জোহা খান জোহার সহযোগিতায় দিবরদীঘি উন্নয়ন প্রকল্প নামে একটি প্রকল্প হাতে নেয়া হয়। এই প্রকল্পের আওতায় দীঘিতে মাটি কাটানো, সাপাহার-নওগাঁ সড়ক থেকে দীঘি পর্যন্ত প্রায় দেড় কিমি রাস্তা পাকাকরণ, দীঘির পাড়ে অতিথি বিশ্রামাগার, মসজিদ, টয়লেট, টিউবওয়েল, একাধিক শেড স্থাপন ও ফুলের বাগান স্থাপন করা হয়। এ ছাড়া সে সময় চেয়ারম্যান শেখ আনিছুর রহমান সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত উদ্যোগে সেখানে একটি মিনি চিড়িয়াখানা স্থাপন করেন। এই মিনি চিড়িয়াখানায় বিভিন্ন প্রজাতির দেশীয় পশু পাখি রাখা হয়েছে। এইসব পশু পাখির খাদ্য চিকিৎসাসহ যাবতীয় খরচ তিনিই তার ব্যক্তিগত তহবিল থেকে খরচ করে থাকেন বলেও জানা গেছে। এসব ব্যয় ভার বহন করতে অনেক সময় তাকে নানা বিড়ম্বনার শিকার হতে হয়েছে। দিবর ইউপির বর্তমান চেয়ারম্যান আব্দুল হামিদ মাস্টার বলেন, বর্তমানে ঐতিহাসিক এই দিবর দীঘিতে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে প্রতিদিন বনভোজন ও ভ্রমণের উদ্দেশে শত শত মানুষের সমাগম ঘটে। প্রতি ঈদের দিন থেকে পরের সাতদিন থেকে দশদিন দীঘির পাড়ে যে মেলা বসে তাতে প্রতিদিন অর্ধ লক্ষাধিক মানুষের আগমন ঘটে। প্রকৃতির অপরূপ নয়নাভিরাম এই দীঘির চতুর্দিকে রাজশাহী সামাজিক বনবিভাগ কর্তৃক বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে রয়েছে কৃত্রিম বন। যা দীঘির সৌন্দর্য বৃদ্ধির পাশাপাশি ছায়া সুশীতল মনোরম পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। দলমত নির্বিশেষে হাজারো মানুষের দাবি হাজার বছরের বাংলা ও বাঙ্গালীর সৌর্য-বীর্যের প্রতীক এবং প্রাচীন পুরাকীর্তির অনুপম নিদর্শন ঐতিহাসিক দিবরদীঘি ও বিজয় স্তম্ভটি রক্ষায় দিবর দীঘিকে দেশের অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা হোক। দীঘি লিজ দিয়ে প্রতি বছর যে রাজস্ব আয় হচ্ছে তা দিয়েই যদি পর্যটকদের থাকা-খাওয়াসহ সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধির কাজে লাগানো হয়, তাহলে সরকারকে আলাদা করে কোন প্রকল্প হাতে না নিলেও দিবর দীঘিতে পর্যটক বাড়বে। এতে সরকারের যেমন রাজস্ব আয় বাড়বে, তেমনি এলাকার মানুষ পাবে সারাবছর নির্মল বিনোদনের মাধ্যম।
×