ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

যোগ্য কর্মকর্তাদের সার্ভিস থেকে দেশ হচ্ছে বঞ্চিত, শ্লথ হচ্ছে কাজের গতি

পিরামিড আকৃতি বদলে মাথাভারি আকার নিয়েছে প্রশাসন যন্ত্র

প্রকাশিত: ১০:১৭, ২৩ জুলাই ২০১৯

 পিরামিড আকৃতি বদলে মাথাভারি আকার নিয়েছে প্রশাসন যন্ত্র

তপন বিশ্বাস ॥ পিরামিড আকৃতি পরিবর্তিত হয়ে মাথা ভারি আকার ধারণ করেছে সরকারের প্রশাসন ব্যবস্থা। এতে ব্যাপক সংখ্যক কর্মকর্তাকে পদায়ন করা যাচ্ছে না। অধিকাংশ ক্ষেত্রে ইনসিটো করতে হচ্ছে। অনেক যোগ্য কর্মকর্তার সার্ভিস থেকে বঞ্চিত হচ্ছে দেশ। ক্রমান্বয়ে গতি হারাচ্ছে প্রশাসন যন্ত্র। সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের পরিকল্পনার অভাব, চাহিদা অনুযায়ী পদ সৃষ্টি না করা, শূন্য পদের চেয়ে অধিক সংখ্যক কর্মকর্তাকে পদোন্নতি প্রদানে এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এ অবস্থা শুধু প্রশাসন ক্যাডারের ক্ষেত্রে। অন্যান্য ক্যাডারের কর্মকর্তাকে পদের অতিরিক্ত পদোন্নতি দেয়া হয় না। এবার দাবি উঠেছে যোগ্যতা অর্জন করলে অন্যান্য ক্যাডারকেও একইভাবে পদোন্নতি দেয়ার। প্রশাসনের আকৃতি পরিবর্তিত হয়েছে। উপসচিব থেকে অতিরিক্ত সচিব প্রতি ক্ষেত্রে পদের চেয়ে অনেক বেশি সংখ্যক কর্মকর্তা রয়েছেন। কোন কোন ক্ষেত্রে পদের প্রায় দ্বিগুণ কর্মকর্তা থাকারও নজির সৃষ্টি হয়েছে। বর্তমানে ৮৩৫ উপসচিব পদের বিপরীতে ১ হাজার ৬শ’ ৯০ কর্মকর্তা রয়েছেন। যুগ্ম সচিবের ৪৩০ পদের বিপরীতে কর্মকর্তার সংখ্যা ৮৫০। অতিরিক্ত সচিবের ১২০ পদের বিপরীতে বর্তমানে ৪৮০ কর্মকর্তা রয়েছে। এতে অনেক অতিরিক্ত সচিব এখন যুগ্মসচিব এবং যুগ্মসচিব উপসচিবের দায়িত্ব পালন করছেন। অনেক উপসচিবও সিনিয়র সহকারী সচিবের দায়িত্ব পালন করছেন। প্রশাসনের উপরের দিকে পদের চেয়ে ব্যাপকসংখ্যক কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেয়ায় কাজের গতি শ্লথ হয়ে আসছে। বর্তমানে সিনিয়র সহকারী সচিবের সঙ্কট তৈরি হয়েছে। সচিবালয়সহ বিভিন্ন জেলা প্রশাসক ও বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ে সিনিয়র সহকারী সচিবের পদ শূন্য থাকছে। কর্মকর্তার অভাবে তা পূরণ করা সম্ভব হচ্ছে না। বিভিন্ন অফিসে উপসচিব দিয়ে সিনিয়র সহকারী সচিবের কাজ চালানো হচ্ছে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে মুখে বলা হয় এক, আর কাজের বেলায় মেলে ভিন্ন চিত্র। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট এক যুগ্মসচিব জনকণ্ঠকে বলেন, পছন্দের কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেয়ার লক্ষ্যে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ক্রাইটেরিয়া নির্ধারণ করা হয়ে আসছে। সূত্র জানায়, পদোন্নতি দেয়ার ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীকে সঠিক তথ্য পরিবেশন করা হয় না। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ কর্মকর্তারা সাধারণত তাদের পছন্দের কর্মকর্তাদের তালিকা দেন। এই তালিকা অনুমোদন করতে প্রয়োজনীয় সকল তথ্যও তারা সরবরাহ করে থাকেন। প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে ওই তালিকা যাচাই-বাছাই করা সম্ভব হয় না। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে পছন্দের কর্মকর্তাদের পদোন্নতি দিয়ে আসছেন শীর্ষ কর্মকর্তারা। প্রধানমন্ত্রী নিজেও বিষয়টি একাধিকবার উপলব্ধি করেন পদোন্নতি দিতে গিয়ে। যে কারণে এখন পদোন্নতির ফাইল গেলে প্রধানমন্ত্রী তা দেখতে চান। আগে সঙ্গে সঙ্গে ফাইল অনুমোদন করার নজির থাকলেও এখন তা হচ্ছে না। কোন কোন ক্ষেত্রে এক/দুই সপ্তাহ পরে ফাইল অনুমোদন করেন। এভাবে অপরিকল্পিতভাবে পদোন্নতি দেয়ায় প্রশাসনের মাথাভারি অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ কর্মকর্তারা এখনও সরকারকে উল্লেখযোগ্য কোন পরিকল্পনা দিতে পারেনি। ঘন ঘন বিদেশ গমন আর যোগ্য কর্মকর্তাদের শায়েস্তা করাই যেন এখন বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের মুখ্য কাজে পরিণত হয়েছে। অপছন্দের কর্মকর্তা হলে তদ্বির বা মন্ত্রীর ডিওকেও পাত্তা দেয়া হয় না। আবার পছন্দের কর্মকর্তা অযোগ্য হলেও তাকে বসানো হয় গুরুত্বপূর্ণ পদে। এতে প্রশাসন ক্রমান্বয়ে হয়ে পড়ছে শ্লথ। দেশের সাড়ে ৭ কোটি লোকের প্রশাসন এখন ১৬ কোটি লোকের প্রশাসন হয়েছে। কিন্তু সে হারে পদ বাড়ানো হয়নি। বিশেষ প্রয়োজনে দুই-একটি পদ বাড়ানো হলেও চাহিদার তুলনায় তা অতি নগণ্য। সংস্থাপন মন্ত্রণালয় থেকে আজও এ জাতীয় কোন প্রস্তাব পাঠানো হয়নি। এমনকি উদ্যোগও নেয়া হয়নি। অতীতে প্রশাসনে অপরিকল্পিতভাবে কর্মকর্তা নিয়োগ দেয়া হলেও পরবর্তীতে তা আর সমন্বয়ের উদ্যোগও গ্রহণ করা হয়নি। এদিকে প্রশাসন দলীয়করণ হওয়ায় কর্মকর্তাদের চাপে ব্যাপক হারে পদোন্নতি দেয়া হচ্ছে। এতে পিরামিড আকৃতির প্রশাসন এখন মালভূমির আকার ছাড়িয়ে মাথাভারি প্রশাসনে পরিণত হয়েছে। প্রশাসন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সহকারী সচিব ও সিনিয়র সহকারী সচিব পর্যায়ে বেশি করে পদ সৃষ্টি করে সেখানে কর্মকর্তা নিয়োগ দিতে হবে। একই সঙ্গে চাহিদার কথা বিবেচনায় রেখে শীর্ষ এবং মধ্যম পর্যায়ের পদও বাড়াতে হবে। সূত্র জানায়, বিসিএসের মোট ২৮ ক্যাডারের মধ্যে ২৭ ক্যাডার পদোন্নতি বঞ্চিত থাকছে বছরের পর বছর। প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা অন্যান্য ক্যাডারের চেয়ে অনেক বেশি ক্ষমতাবান। এমনকি অন্যান্য ক্যাডারের পদোন্নতির ক্ষমতাও এই ক্যাডারদের হাতে। এছাড়া সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকেন এই প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারাই। এমনকি প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতির কার্যালয়েও তাদেরই অবাধ বিচরণ এবং বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে তারাই কর্মরত থাকেন। তারা সরকারের সঙ্গে যেভাবে দেন-দরবার করতে পারেন, অন্য ক্যাডারের কর্মকর্তারা তার কিছুই পারেন না। এ প্রসঙ্গে তথ্য ও শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তারা বলেন, আমাদের সব যোগ্য কর্মকর্তাকেও পদোন্নতি দিতে হবে। পদ না থাকলে আমরাও ইনসিটো থাকব। প্রশাসনের ক্ষেত্রে যদি হতে পারে তবে আমাদের ক্ষেত্রে নয় কেন? শিক্ষা ক্যাডারের এক নেতা বলেন, আমাদের ইনসিটো করা বেশি সহজ। এর জন্য আলাদা কোন চেয়ার বা বসার জায়গার প্রয়োজন হয় না।
×