স্টাফ রিপোর্টার ॥ রাজধানীর বাড্ডায় ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনিতে তাসলিমা বেগম রেণুকে (৪২) পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় চার যুবককে গ্রেফতার করা হয়েছে। এদের মধ্যে তিনজনকে চারদিনের রিমান্ড নিয়েছে পুলিশ। আর গ্রেফতারকৃত জাফর (২৫) আদালতে দোষ স্বীকার করে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দী দিয়েছে। তবে এখনও গণপিটুনিতে নেতৃত্বদানকারী বখাটে যুবক হৃদয় ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়েছে। বাড্ডার থানার ওসি রফিকুল ইসলাম জানান, সোমবার সকালে বাচ্চু (২৫) নামে এক যুবককে গ্রেফতার করা হয়। এর আগে রবিবার মধ্যরাতে বাপ্পী, শাহীন ও জাফর নামে আরও তিনজনকে গ্রেফতার করা হয়। পরে চারজনের বিরুদ্ধে সাত দিনের রিমান্ডের আবেদন করে আদালতে পাঠানো হয়। তবে গণপিটুনির ঘটনার নেতৃত্বদানকারী হৃদয় নামে যুবককে এখনও আটক করা যায়নি। আদালতে পুলিশের সাধারণ নিবন্ধন কর্মকর্তা এসআই লিয়াকত আলী জানান, সোমবার দুপুরে বাড্ডায় গণপিটুনিতে নিহত তাসলিম বেগম রেণু হত্যার ঘটনায় গ্রেফতারকৃত চারজনের জাফর নামে একজন বিচারকের কাছে দোষ স্বীকার করে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দী দেন। বাকি তিনজনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ৭ দিনের হেফাজতের আবেদন করা হলে ঢাকার মহানগর হাকিম ধীমান চন্দ্র মণ্ডল ৪ দিনের হেফাজতে নেয়ার আদেশ দেন। রিমান্ডকৃতরা হচ্ছেÑ বরগুনার তালতলী উপজেলার গাবতলী হাওলারদার বাড়ির বাসিন্দা শাহীন (৩১), ময়মনসিংহের ধোবাউড়া উপজেলার দরশা গ্রামের বাসিন্দা বাচ্চু মিয়া (২৮) ও উত্তর বাড্ডা কাঁচাবাজারের ফারুকের মুদি দোকানের কর্মী বাপ্পী (২১)।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, গত কয়েকদিনে কয়েকটি পিটিয়ে হত্যার ঘটনার পর শনিবার সকালে রাজধানীর উত্তর বাড্ডার সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তাসলিমা বেগম রেণুকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। পিটুনি থেকে বাঁচার জন্য তাসলিমা করজোড়ে বারবার বলছিলেন আমি আমার ছেলেমেয়ে এখানে ভর্তি করতে এসেছি। আপনারা আমাকে মারবেন না। তসলিমার এহেন আর্তনাদ কেউ আমলে নেয়নি। বখাটে যুবকরা তার কথা কর্ণপাত করেননি। তবে তাদের বলতে শোনা গেছে- শালিকে শেষ করে দেয়। আর যেন জীবনে এখানে না আসে। পিটুনিতে এক সময় তাসলিমা নিস্তেজ হয়ে পড়ে। পরে হাসপাতালে নিলে তার মৃত্যু হয়। পরে রবিবার রাতে লক্ষ্মীপুর জেলার রায়পুর উপজেলার উত্তর সোনাপুর গ্রামে পারিবারিক কবরস্থানে বাবার কবরের পাশে তাসলিমা রেণুকে দাফন করা হয়। এ ঘটনায় করা হত্যা মামলায় চারজনকে গ্রেফতার করা হয়। ওসি রফিকুল ইসলাম জানান, তসলিমা বেগম রেণুকে পেটানোর ঘটনায় মূল আসামি হিসেবে হৃদয় নামে একজনকে শনাক্ত করেছে পুলিশ। তাকে গ্রেফতার অভিযান চলছে। ওসি জানান, হৃদয় উত্তর বাড্ডায় তার বাবা হানিফ আলীর সবজির দোকানে কাজ করেন। পড়াশোনাও করেননি। এলাকায় আগে থেকে বখে যাওয়া যুবক হিসাবে পরিচিত হৃদয়। গণপিটুনির ভিডিওতে দেখা যায়, বাড্ডার অল্প কয়েকজন যুবকই তাছলিমাকে মারছে। বাকিরা দেখছে। আবার কেউ কেউ মোবাইলে ভিডিও করছে। লাঠিপেটার পর উপর্যুপরি লাথি দেয়া হয়। তাসলিমা নিস্তেজ হয়ে পড়ে থাকলেও তাকে কাঠের দণ্ড দিয়ে পেটাতে থাকে ছবির যুবকটি। তার হাত-পা, বুকের ওপর পেটানো হয়। হাতে খোঁচানো হয়।
তাসলিমা খুনের ঘটনায় তার বোনের ছেলে নাসির উদ্দিন টিটো বাদী হয়ে অজ্ঞাত পরিচয়ের ৪০০/৫০০ জনকে আসামি করে মামলা করেন। সম্প্রতি পদ্মা সেতু নির্মাণ কাজে ‘মানুষের মাথা লাগবে’ বলে সম্প্রতি ফেসবুকে গুজব ছড়ানো হয়, যাতে বিভ্রান্ত না হতে দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছিল সরকার। গুজব ছড়ানোর অভিযোগে কয়েকজনকে গ্রেফতার করা হয়। এর মধ্যে বৃহস্পতিবার নেত্রকোনা শহরে এক যুবকের ব্যাগ তল্লাশি করে ‘শিশুর মাথা’ পাওয়ার পর তাকে পিটিয়ে হত্যা করে এলাকাবাসী। এ ঘটনার পর দেশের বিভিন্ন স্থানে ছেলেধরা সন্দেহে আক্রমণের ঘটনা ঘটছে। এর মধ্যেই শনিবার লক্ষ্মীপুরের বাসিন্দা তসলিমাকে পিটিয়ে মারা হয়। এ ঘটনায় তার বোনের ছেলে নাসির উদ্দিন টিটো বাদী হয়ে অজ্ঞাত পরিচয়ের ৪০০/৫০০ জনকে আসামি করে মামলা করেন। সোমবার মাদারীপুরে একই ঘটনা ঘটে। নিহতের স্বজনরা জানিয়েছেন, লেখাপড়া শেষ করে তাসলিমা বেগম রেণু চাকরি করেছিলেন আড়ং, ব্র্যাকের মতো প্রতিষ্ঠানে। পড়িয়েছিলেন স্কুলেও। বিবাহ বিচ্ছেদের পর ঘরেই কাটাচ্ছিলেন সময়। ঘটনার দিন স্কুলে সন্তানদের ভর্তির খোঁজ নিতে গিয়েছিলেন তাসলিমা বেগম। সেখানে তাকে ছেলেধরা গুজবে গণপিটুনি দেয়া হয়।
মানববন্ধন ॥ রাজধানীর বাড্ডায় তাসলিমা বেগম রেণু নামের নারীকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় জড়িতদের গ্রেফতার ও বিচারের দাবি জানিয়েছেন সরকারী তিতুমীর কলেজের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। সোমবার দুপুরে রাজধানীর মহাখালীর ওয়্যারলেস গেটের কাছে কলেজের প্রধান ফটকে আয়োজিত মানববন্ধনে এ দাবি জানানো হয়। রেণু ওই কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী। মানববন্ধনে কলেজের অধ্যক্ষ আশরাফ হোসেন জানান, দেশের সহজ সরল মানুষকে অবৈজ্ঞানিক কথাবার্তায় উত্তেজিত করা হচ্ছে। এর খেসারত দিতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে। একদিকে জনজীবন অতীষ্ঠ করার চেষ্টা চলছে, অন্যদিকে উন্নয়নকে প্রশ্নবিদ্ধ করার চক্রান্ত চলছে। তিনি বলেন, যারা সরকারের সাফল্য ও উন্নয়ন কর্মকাণ্ড সহ্য করতে পারছে না তারাই এমন গুজব ছড়িয়ে দেশটাকে অস্থিতিশীল করছে। পদ্মা সেতু নির্মাণের শুরু থেকেই নানা ষড়যন্ত্র চলছিল; এখনও তা চলমান আছে। কর্মসূচীতে তিতুমীর কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি রিপন মিয়া ও সাধারণ সম্পাদক মাহমুদুল হক জুয়েল মোড়ল, বিভিন্ন গণমাধ্যমে কর্মরত তিতুমীর কলেজের সাবেক ও বর্তমান শিক্ষার্থী ও বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষার্থীরা অংশ নেন।
নেতৃত্বদানকারী হৃদয় আটক হয়নি
বাড্ডায় গণপিটুনিতে রেণু হত্যায় চার যুবক গ্রেফতার
আরো পড়ুন
শীর্ষ সংবাদ: