ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ঢাবিতে ক্লাস পরীক্ষা বর্জন

সঙ্কট সমাধানে ডাকসু রাষ্ট্রপতির দ্বারস্থ হচ্ছে ॥ সাত কলেজ অধিভুক্তি

প্রকাশিত: ১০:২২, ২৩ জুলাই ২০১৯

 সঙ্কট সমাধানে ডাকসু   রাষ্ট্রপতির দ্বারস্থ হচ্ছে ॥ সাত কলেজ অধিভুক্তি

বিশ্ববিদ্যালয় রিপোর্টার ॥ একদিকে শিক্ষাজীবন রক্ষায় সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের আন্দোলন অন্যদিকে অধিভুক্তি বাতিলের দাবিতে চলছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়(ঢাবি) শিক্ষার্থীদের লাগাতার আন্দোলন। সাত কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্তি থেকে বাতিলের দাবিতে টানা দুদিন সকল ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন করে একাডেমিক ও প্রশাসনিক ভবনে তালা লাগিয়ে দিয়েছেন ঢাবি শিক্ষার্থীরা। উপাচার্যও দেশে নেই, শিক্ষা মন্ত্রণালয়েরও উদ্যোগ নেই। দেশে নেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও। এমন অবস্থায় সঙ্কট উত্তরণে রাষ্ট্রপতির শরণাপন্ন হচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু)। ঢাবির উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ সামাদ সাত কলেজের অধিভুক্তি বাতিলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের অপারগতার কথা জানিয়ে বলেছেন, শিক্ষার্থীদের যৌক্তিক দাবির প্রতি সমর্থন ও সহানুভূতি রয়েছে। কিন্তু অধিভুক্তি থেকে সাত কলেজ বাতিলের ক্ষমতা আমাদের নেই। শিক্ষার্থীদের প্রশাসনিক ভবনে তালা ও ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন অনেক কার্যক্রম ব্যাহত করছে। সমস্যা সমাধানে ডাকসু নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করেছি। তারা আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলবে। আশা করি, শিক্ষার্থীরা ক্লাসে ফিরবে এবং বাকি সিদ্ধান্ত উপাচার্য চীন থেকে ফিরলে নেয়া হবে। তিনি বলেন, অধিভুক্তি বাতিলের এখতিয়ার আমাদের নেই। এটা সম্পূর্ণ সরকারের সিদ্ধান্ত। আমরা যেটা পারি সেটা হচ্ছে এটাকে নতুন করে সাজাতে এবং শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে। যাতে আমাদের শিক্ষার্থীদের স্বাভাবিক কাজে কোন প্রকার ব্যাঘাত না ঘটে। সাত কলেজের সমন্বয়ক ও বিজনেস ফ্যাকাল্টির ডিন অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত বলেছেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ব্যবস্থার সঙ্গে ওই সাত কলেজের শিক্ষা পরিচালনার কোন সম্পৃক্ততা থাকবে না। ঢাবি শিক্ষার্থীদের শিক্ষায়ও কোন ব্যাঘাত হবে না। সোমবার সকালেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজধানীর সাত কলেজের অধিভুক্তি বাতিলের দাবিতে দ্বিতীয় দিনের মতো বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল একাডেমিক ও প্রশাসনিক ভবনে তালা লাগিয়ে বিক্ষোভ করেছে শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবন, কলাভবন, ব্যবসায় অনুষদ, সমাজবিজ্ঞান অনুষদ, মোকাররম ভবন, মোতাহার হোসেন ভবনসহ অন্যান্য এ্যাকাডেমিক ভবনের প্রধান ফটকে তালা ঝুলিয়ে দেয়। ফলে প্রথমদিনের মতো কোন শিক্ষক-শিক্ষার্থী ক্লাস-পরীক্ষায় অংশ নিতে পারেনি। আন্দোলনকারীদের মুখপাত্র ব্যবস্থাপনা বিভাগের শিক্ষার্থী মোঃ শাকিল মিয়া বলেন, যতদিন পর্যন্ত উপাচার্য অধিভুক্তি বাতিলের লিখিত সিদ্ধান্ত না জানান ততদিন পর্যন্ত ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীরা আন্দোলন চালিয়ে যাবে। আমরা মনে করি, সাত কলেজের অধিভুক্তি বাতিল করলেই সব সমস্যার সমাধান হবে। তা না হওয়া পর্যন্ত আমাদের আন্দোলন চলবে। এক পর্যায়ে সাত কলেজ অধিভুক্তি আন্দোলনে পূর্ণ সমর্থন জানিয়ে এ বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার আশ্বাস দিয়েছে ডাকসু। ডাকসুর এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে শিক্ষার্থীদের ক্লাসে ফেরার আহ্বান জানানো হয়েছে। ডাকসুর ভিপি নুরুল হক ও জিএস গোলাম রাব্বানী স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, নির্বাচিত ছাত্র প্রতিনিধি হিসেবে ডাকসু শিক্ষার্থীদের চলমান আন্দোলনে পূর্ণ সমর্থন জ্ঞাপন করছে। কিন্তু উপাচার্য দেশের বাইরে থাকায় এই মুহূর্তে সাত কলেজ নিয়ে কার্যকর ও ফলপ্রসূ সিদ্ধান্ত নেয়া সম্ভব হচ্ছে না। বুধবার তিনি দেশে ফিরেলে ডাকসু বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আলোচনা করে কার্যকর পদক্ষেপ নেবে। এদিকে সাত কলেজ অধিভুক্তি সমস্যা সমাধানে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাতের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে ডাকসু। রবিবার সন্ধ্যায় এ বিষয়ে ডাকসুর সভায় উপস্থিত থাকা কয়েক সদস্য জনকণ্ঠকে এ বিষয়টি নিশ্চিত করে। তবে এখনও শিডিউল ঠিক করা সম্ভব হয়নি বলে জানান তারা। সোমবার শিক্ষার্থীদের আন্দোলন চলাকালে সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সামনে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে সংহতি জানিয়ে এ কথা জানান ডাকসুর সদস্য রকিকুল ইসলাম ঐতিহ্য। তিনি বলেন, আজকালের মধ্যেই শিডিউল পেলে এ সাক্ষাত হতে পারে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক ড. আখতারুজ্জামান দেশের বাইরে রয়েছেন। শিক্ষামন্ত্রীও অসুস্থ। ফলে সাত কলেজ নিয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার কেউ নেই। রকিকুল ইসলাম ঐতিহ্য আরও বলেন, এ বিষয়ে ডাকসুতে বৈঠক হয়েছে। সেখানে রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদের সঙ্গে সাক্ষাতের কথা উঠেছে। ডাকসুর জিএস গোলাম রাব্বানী সিডিউল নেয়ার চেষ্টা করেছেন। তবে মেলেনি। আজকালের মধ্যেই সাক্ষাত হতে পারে। এর আগে সাত কলেজ অধিভুক্তি বাতিলের দাবিতে গত বুধ ও বৃহস্পতিবার রাজধানীর শাহবাগ মোড় অবরোধ করে বিক্ষোভ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। তবে প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোন ধরনের আশ্বাস না পেয়ে রবিবার সকালেই তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল প্রশাসনিক ও একাডেমিক ভবনে তালা ঝুলিয়ে বিক্ষোভ করেন। কার্যত সাত কলেজ বাতিলের দাবিতে দুদিন ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক সকল কার্যক্রম ও ক্লাস-পরীক্ষা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। রবিবার সাত কলেজ সমস্যা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ কর্তাব্যক্তি ও ডাকসু নেতৃবৃন্দ আলোচনায় বসেন। ব্রিফিং এ উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ সামাদ বলেন, সাত কলেজ অধিভুক্তি বাতিলে বিশ্ববিদ্যালয়ের এখতিয়ার নেই। শিক্ষার্থীদের যৌক্তিক দাবির প্রতি প্রশাসনের সমর্থন রয়েছে। আমরা দাবিগুলো পূরণে সাধ্যমতো চেষ্টা করব। কিন্তু ঢাবি শিক্ষার্থীদের এমন দাবির কারণ কী? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সাবরিনা সুলতানা বলছেন, অনেক সময় আমাদের সিডিউল ক্লাস হয় না। শিক্ষকরা সাত কলেজে ভাইভা নিতে যান, তাদের পরীক্ষার খাতা দেখেন। আমাদের বিভাগের একজন শিক্ষক সাত কলেজের পরীক্ষা কমিটির সদস্য ছিলেন। তাই আমাদের যে কয়টি ক্লাস নেয়ার কথা ছিল সেগুলো নিতে পারেননি। এখন আমরা সিলেবাস শেষ না করে তো পরীক্ষা দিতে পারছি না। এদিকে ঢাকা ইংরেজী বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক নীলিমা আখতার বর্তমানে অস্ট্রেলিয়ায় পিএইচডি করছেন। তিনি ফেসবুকে এ বিষয়ে নিজের অবস্থান তুলে ধরে একটি পোস্ট দিয়েছেন। নীলিমা আখতার লিখেছেন, ‘সাত কলেজ নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা আবার রাস্তায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামর্থ্য এবং উদ্দেশ্যের সঙ্গে সাত কলেজ যায় না। আমাদের নিজেদের ছাত্রদের কতটুকু দিতে পারছি আমরা? পাবলিক প্রতিষ্ঠানের অনেক সীমাবদ্ধতা। নিজেদের চল্লিশ হাজার ছাত্রকে ভাল শিক্ষা দেয়াই কঠিন, তার উপর সাত কলেজের পৌনে দুই লাখ ছাত্রের তত্ত্বাবধান। এটা কি আমাদের পক্ষে সম্ভব, না আমাদের করার কথা? সবচেয়ে যোগ্যদের জীবনের জন্য, সমাজের জন্য, দেশ গঠনের জন্য তৈরি হতে সাহায্য করা আমাদের কাজ। আর কাজ গবেষণা।’ অন্যদিকে গত শনিবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে নীলক্ষেতে সড়কে অবস্থান নেন শিক্ষার্থীরা। দুপুর পর্যন্ত চলে তাদের আন্দোলন। এরপর তিনদফা দাবি ঘোষণা করে আগামী সাত দিনের মধ্যে তা বাস্তবায়ন করতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে আল্টিমেটাম দেন সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা। দাবিগুলো হচ্ছে- নিহত ছাত্রী মিতুর একাডেমিক ও পরীক্ষার সকল কাগজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কলেজ কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করতে হবে, সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে মিতুর আত্মহত্যার কারণ উদঘাটন করতে হবে ও কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে এবং আর যাতে কেউ এমন হতাশাগ্রস্ত না হয় সে জন্য সাত কলেজ শিক্ষার্থীদের সকল দাবি দ্রুত বাস্তবায়ন করতে হবে। ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থী মুশফিকুর রহমান বলছিলেন, একদিকে তারা যেমন সেশনজটে পড়ছেন অন্যদিকে তাদের পরীক্ষার খাতা সঠিকভাবে মূল্যায়ন করা হচ্ছে না। এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আমাদের সঙ্গে একটা তামাশা শুরু করছে। আমাদের কলেজে কেমিস্ট্রি ডিপার্টমেন্টের সবাই ফেল করেছে , একজন পাস করেছে। একটা ক্লাসে সবাই বাজে ছাত্র কীভাবে হয়? তিনি আরও বলছিলেন তারা (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক) আমাদের ঠিকমত মূল্যায়ন করে করে না। আমাদের খাতা ফেল করে দেয়। আমার সঙ্গে যে বন্ধুরা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনের কলেজে ছিল, তারা এখন বের হয়ে যাচ্ছে অথচ আমাদের কোন অগ্রগতি নেই। শিক্ষার্থীরা বলছেন, একই প্রশাসনিক কর্মকর্তা এবং শিক্ষকদের এই বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থীর ক্লাস, পরীক্ষা সম্পন্ন করা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের জন্য অসম্ভব হয়ে পড়ছে। আর তার দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে শিক্ষার্থীদের। শিক্ষার্থীরা আরও বলছেন, সাত কলেজের দুই-আড়াই লাখ শিক্ষার্থীর শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ প্রস্তুত ছিল না। জনবল সঙ্কটের কারণে কোন কাজ সঠিকভাবে করা যাচ্ছে না। সাত কলেজের কার্যক্রম দেখাশোনার জন্য নেই কোন শাখা। বিগতদিনে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের ফলে বিষয়টি দেখভাল করতে দুই কর্মকর্তাকে দায়িত্ব দেয়া হয়। সব মিলিয়ে সাত কলেজের কার্যক্রম দেখভালের জন্য লোকবল মাত্র চারজন।
×