ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

আসলামুল হক

মহানায়কের চালিকাশক্তি

প্রকাশিত: ১১:৩৮, ৮ আগস্ট ২০১৯

মহানায়কের  চালিকাশক্তি

‘আপনি শুধু আমার স্বামী হওয়ার জন্য জন্ম নেননি, দেশের কাজ করার জন্যও জন্ম নিয়েছেন, দেশের কাজই আপনার সবচেয়ে বড় কাজ, আপনি নিশ্চিত মনে সেই কাজে যান, আমার জন্য চিন্তা করবেন না।’- এমন সাহসী নারী ইতিহাসে কদাচিৎ মেলে যিনি নিজের এবং পরিবারের আগে স্থান দেন দেশকে, দেশের মানুষকে। সাতচল্লিশ পরবর্তী সময়ে দৃশ্যপটে এমনি এক নারীর আবির্ভাব ঘটে যিনি শুধু সংসার-ধর্মে আটকে থাকেননি বরং এর বাইরে এসে বাংলাদেশ সৃষ্টির ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় অবদান রেখেছেন। পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ সৃষ্টির পুরো সময়টিতে টুঙ্গিপাড়ার শেখ মুজিবকে ‘বঙ্গবন্ধু’ মহীরুহে রূপান্তরিত করা মহীয়সী নারী বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব। বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণী ফজিলাতুন্নেছা মুজিবকে শেখ মুজিবের সহযোদ্ধা বললেও খুব একটা অত্যুক্তি হবে না। তিনি ছিলেন শেখ মুজিবের রাজনীতি ও গৃহাঙ্গনে প্রেরণাদায়িনী এবং শক্তিদায়িনী। বাংলার স্বাধীনতা তথা স্বাধীনতা পূর্ব ইতিহাসে এই মহৎ হৃদয়ের নারীর ত্যাগ ও সংগ্রাম জড়িয়ে আছে। বাঙালীর সুদীর্ঘ স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রতিটি পদক্ষেপে সক্রিয় সহযোগিতা করেছেন বঙ্গবন্ধুর আদর্শ সহধর্মিণী বেগম ফজিলাতুন্নেছা। ছায়ার মতো অনুসরণ করেছেন বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শন ও আদর্শকে বাস্তবায়ন করার জন্য। ৮ আগস্ট ১৯৩০ সাল, শ্রাবণ দুপুরে টুঙ্গিপাড়াতে শেখ জহুরুল হক ও হোসনে আরা বেগমের কোল আলোকিত করে জন্ম নেয় এক কন্যা শিশু। দাদা শেখ আবুল কাশেম নাতনির নাম রাখেন ফজিলাতুন্নেছা। ফুলের মতো গায়ের রং বলে মা ডাকতেন রেণু। অল্প বয়সে মা-বাবা মারা যাওয়ার পর রেণুর বিয়ে হয় তার চাচাত ভাই খোকার সঙ্গে। এই খোকাই আমাদের স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। শাশুড়ি সায়েরা খাতুন পরম মমতায় ফজিলাতুন্নেছাকে নিজের কাছে নিয়ে আসেন এবং তার বেড়ে ওঠা সেখানেই। গোপালগঞ্জের মিশনারি স্কুল থেকে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত পাঠ গ্রহণ করেন রেণু, তারপর গৃহ শিক্ষকের কাছে পাঠ নেন। সাহিত্যের প্রতি প্রবল আগ্রহী রেণু অল্প বয়সেই বিভূতিভূষণ, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শেষ করেন। প্রখর স্মৃতিশক্তির অধিকারী ছিলেন বলেই বঙ্গবন্ধু তাঁকে ‘জীবন্ত ডায়েরি’ বলতেন। বঙ্গবন্ধুর মানবিক গুণাবলীর সবকিছুই ছিল বেগম মুজিবের মাঝে। গরিব ছেলেমেয়ে, এতিম, কন্যাদায়গ্রস্ত পিতা-মাতাকে অর্থ সাহায্য করতেন। দলের নেতাকর্মীদের চিকিৎসার খরচ দিতেন। আবার স্বামীর রাজনীতিতে সব রকম সহায়তা করতেন তিনি। ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে সরাসরি জড়িত শেখ মুজিবের যখনই অতিরিক্ত অর্থের দরকার হতো তখনই নিজের পিতৃ সম্পত্তি থেকে অর্জিত অর্থ বিনা দ্বিধায় প্রেরণ করতেন বেগম মুজিব। বঙ্গমাতা সন্তান প্রতিপালন ও লেখাপড়া করানোর পাশাপাশি বঙ্গবন্ধু গ্রেফতার হলে আইনজীবী নিয়োগ, মামলা চালানোর খরচ, কোর্টে যাওয়া, বাড়িতে দলের সভা পরিচালনা, দলের খরচ যোগানো, রান্না করে নেতাকর্মীদের খাওয়ানো সবকিছু সুনিপুণভাবে সম্পাদন করতেন। মামলার খরচ ও সংগঠনের খরচ যোগাতে নিজের গহনাসহ বিভিন্ন আসবাবপত্র বিক্রি করেছেন তিনি। বঙ্গবন্ধু যখন জেলখানায় থাকতেন তখন বেগম মুজিব সাক্ষাতকারের জন্য যেতেন। মূলত বঙ্গবন্ধুকে বাইরের পরিস্থিতি সম্পর্কে জানানো এবং কারাগার থেকে বঙ্গবন্ধুর প্রয়োজনীয় পরামর্শ ও নির্দেশ নিয়ে আসতেন তিনি। আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগকে সে নির্দেশ জানাতেন এবং সে অনুযায়ী কাজ করতেন। অন্যদিকে কারাগারে সাক্ষাত করে বঙ্গবন্ধুর মনোবল দৃঢ় রাখতেও সহায়তা করতেন তিনি। বঙ্গবন্ধুর নিজের লেখা ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তেও বেগম মুজিবের এই সংগ্রামের কথা উঠে এসেছে। সংসার ও রাজনীতির কর্মময় জীবনের বর্ণনায় বঙ্গবন্ধু বার বার শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের নাম উচ্চারণ করেছেন। ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর আইয়ুব খান সামরিক শাসন জারি করে সংসদ ভেঙ্গে দেয়। ১২ অক্টোবর বঙ্গবন্ধু গ্রেফতার হন। বঙ্গমাতা হঠাৎ করেই যেন এক সীমাহীন কষ্টে পড়ে যান। স্বামী কারাগারে, কেউ বাড়ি ভাড়া দিতে চাইল না। তিন দিনের নোটিশে সন্তানদের নিয়ে বাড়ি ছাড়তে হলেও তিনি অটল থেকেছেন, কখনও মনোবল হারাননি। এ প্রসঙ্গে কন্যা শেখ হাসিনা বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর দীর্ঘ রাজনীতিক জীবন, লড়াই, সংগ্রামে অনেক ঘাত-প্রতিঘাত এসেছে, কিন্তু কখনও মাকে ভেঙ্গে পড়তে দেখিনি। যত কষ্টই হোক আমার বাবাকে কখনই বলেননি যে তুমি রাজনীতি ছেড়ে দাও বা সংসার কর বা খরচ দাও। আব্বা যে পদক্ষেপ নিতেন সেটাকেই সমর্থন করতেন তিনি।’ ১৯৬৬ সালে ঐতিহাসিক ছয় দফা আন্দোলনের সময় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব। ৫-৬ ফেব্রুয়ারি লাহোরে বঙ্গবন্ধু বাঙালীর মুক্তির সনদ ছয় দফা ঘোষণা করেন। ৮ মে নারায়ণগঞ্জে ছয় দফার সমর্থনে জনসভা করে ঘরে ফেরার পর গভীর রাতে গ্রেফতার হন বঙ্গবন্ধু। বঙ্গবন্ধুর ঘোষণা ছিল, ছয় দফা থেকে এক চুলও নড়া যাবে না। বঙ্গবন্ধুর এই নির্দেশ বাস্তবায়নে বঙ্গমাতা ঐতিহাসিক ভূমিকা রাখেন। বাঙালী মুক্তির সনদ ছয় দফা কর্মসূচীভিত্তিক লিফলেট বোরখা পরিহিত অবস্থায় বিভিন্ন স্থানে বিতরণ করতে দেখা গেছে এই নীরব বিপ্লবী কর্মীকে। তিনি যেখানে লিফলেটগুলো রেখে আসতেন সেখান থেকে ছাত্রলীগ কর্মীরা সংগ্রহ করে বিলি করত এই লিফলেট। এভাবেই ছয় দফাকে জনগণের মুক্তির সনদ হিসেবে প্রতিষ্ঠার কাজটি করেছেন বেগম মুজিব। ১৯৬৮ সালে বঙ্গবন্ধুকে প্রধান আসামি করে পঁয়ত্রিশ জন বাঙালী নৌ ও সেনাবাহিনীর সদস্য এবং উচ্চপদস্থ সরকারী কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ এনে মামলা দায়ের করা হয়। এ মামলাকে ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’ নামে অভিহিত করা হয়। বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করা হয়। বঙ্গবন্ধুসহ সকল রাজবন্দীদের মুক্তির দাবিতে বাঙালী রাস্তায় নামে। আগরতলা মামলা দায়ের করার পর তৎকালীন পাকিস্তানী গোয়েন্দা সংস্থা বেগম ফজিলাতুন্নেছাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে গ্রেফতারের হুমকি দেয়। কিন্তু বেগম মুজিব এই হুমকিতে ভয় পাবার মানুষ নন। লাহোরে গোলটেবিল বৈঠকে অংশগ্রহণের জন্য বঙ্গবন্ধুকে প্যারোলে মুক্তি দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এ বিষয়ে শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব জোরালো আপত্তি জানান এবং প্রতিহত করেন। কেননা এই মহীয়সী নারী দেশের সার্বিক আন্দোলনের পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতেন। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাত করে তিনি সকল বিষয় অবহিত করেন। বাঙালীরা ঐক্যবদ্ধ, তাই বেগম মুজিবের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল আগরতলা ষড়যন্ত্র নামে খ্যাত মামলা প্রত্যাহার করতেই হবে। বঙ্গবন্ধু যেন শক্ত থাকেন সে বিষয়ে তিনি পরামর্শ দেন। ওই সময় প্রতিটি বন্দী পরিবারের নিয়মিত খোঁজখবর নেন ও সহযোগিতা করেন, মামলা পরিচালনার জন্য প্রবাসী বাঙালীদের সহায়তায় লন্ডন থেকে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আইনজীবী স্যার টমাস উইলিয়ামকে ঢাকায় নিয়ে আসেন তিনি। বেগম ফজিলাতুন্নেছার গুরুত্বপূর্ণ তথ্যের ভিত্তিতে ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান বেগবান হয়। প্রবল গণঅভ্যুত্থানের মুখে শেখ মুজিবুর রহমান মুক্ত হলেন ২২ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯। পরের দিন ২৩ ফেব্রুয়ারি বাঙালীরা তাদের অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি দিয়ে বরণ করে নেয়। ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’Ñ বাঙালীকে মুক্তির সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার অনুপ্রেরণা যোগায়। কিন্তু কেমন ছিল সেই ভাষণ প্রদানের প্রেক্ষাপট? কি ভূমিকা ছিল সেখানে বঙ্গমাতার? কন্যা শেখ হাসিনার স্মৃতিচারণমূলক এক বক্তব্যে সে সম্পর্কে জানা যায়। জননেত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘মা আব্বাকে বললেন, সমগ্র দেশের মানুষ তোমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। তোমার মনে যে কথা আসে তুমি তাই বলবে। অনেকে অনেক কথা বলতে বলেছে। তোমার কথার ওপর সামনের অগণিত মানুষের ভাগ্য জড়িত।’ মহান মুক্তিযুদ্ধের পুরো নয়টি মাস অসীম সাহস, দৃঢ় মনোবল ও ধৈর্য্য নিয়ে বেগম শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব পরিস্থিতি মোকাবেলা করেছেন। প্রথমে ধানমন্ডি ৩২ নাম্বার বাড়ি থেকে পাশের বাড়িতে সবাইকে নিয়ে আশ্রয় নেন, এভাবে সন্তানদের নিয়ে অসংখ্যবার জায়গা বদল করেও রেহাই পেলেন না। একদিন মগবাজারের বাড়ি থেকে ছেলেমেয়েসহ বঙ্গমাতাকে গ্রেফতার করে ধানম-ির ১৮ নম্বর রোডের একটি বাড়িতে রাখে পাকসেনারা। বন্দী অবস্থায় কন্যা শেখ হাসিনার সন্তান জন্ম নেয়ার সময় তাঁকে একবারের জন্যও ঢাকা মেডিক্যালে যেতে দেয়া হয়নি। ১৬ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধে বাঙালীর বিজয়ের পরদিন ১৭ ডিসেম্বর তার ও পরিবারের অন্য সদস্যদের বন্দিদশার অবসান ঘটে। পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি লাভ করে ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু লন্ডনে যান। সেখান থেকে বেগম মুজিবের সঙ্গে তার প্রথম কথা হয়। ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন। অবসান ঘটে বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছার দীর্ঘ প্রতীক্ষার। এরপর যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ গড়ার কাজেও বঙ্গবন্ধুর পাশে দাঁড়ান তিনি। অনেক বীরাঙ্গনাকে বিয়ে দিয়ে সামাজিকভাবে মর্যাদাসম্পন্ন জীবনদান করেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের কালরাত্রিতে জাতির পিতার হত্যাকারীদের হাতে বেগম মুজিবও নির্মম হত্যাযজ্ঞের শিকার হন। কিন্তু বাঙালীর মুক্তি সংগ্রামে অন্যতম এক প্রেরণাদায়িনী মহীয়সী নারী হিসেবে বেগম শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব ইতিহাসের পাতায় স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। লেখক : সংসদ সদস্য, ঢাকা-১৪
×