ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

শোকাবহ পঁচাত্তর ॥ জাতিকে অমলিন করে দেয়

প্রকাশিত: ১১:৪৬, ৯ আগস্ট ২০১৯

শোকাবহ পঁচাত্তর ॥ জাতিকে অমলিন করে দেয়

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম না হলে বাংলাদেশের সৃষ্টি হতো না। তাই তো শিক্ষাবিদ মোবাশ্বের আলীর ভাষায়, বঙ্গবন্ধুকে কেবল একটি স্বাধীন দেশের স্রষ্টা বলা হয় না বরং সমকালীন রাজনীতির কাব্য নির্মাতা এবং ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণকে বাঙালীর জন্য ম্যাগনাকার্টা এবং সামনে এগিয়ে যাওয়ার জন্য পথনির্দেশক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। দেশ আজ যে উন্নয়নের পথ ধারায় সংযুক্ত তা বঙ্গবন্ধুর মর্মন্তুদ মৃত্যু না ঘটলে অনেক আগেই সম্ভব হতো। পাকিস্তানী ও সা¤্রাজ্যবাদী শক্তির দোসর জিয়া-মোশতাক-তাহের উদ্দিন ঠাকুর-মাহবুব আলম চাষীসহ ডালিম-রশীদরা বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের নির্মমভাবে হত্যা করেছিল। কখনও বঙ্গবন্ধু ভাবেননি যাদের জন্য তিনি তাঁর জীবন-যৌবন উৎসর্গ করেছেন, দেশমাতৃকাকে ভালবেসেছেন তারা তাঁকে হত্যা করতে পারে। তিনি যে সমস্ত আমলা-সেনাপতি-ব্যবসায়ীসহ যাদের বিভিন্ন উচ্চপদে আসীন করেছিলেন, তাদের একটি মহলই এ চক্রান্তে লিপ্ত ছিল। কেবল যে যুদ্ধাপরাধী ও দুর্বিনীত শ্রেণী ছিল তা নয়, কচুরিপানার মতো একদল বামপন্থী স্বাধীনতা অর্জনের শুরু থেকেই সমস্যাকে প্রকট করে তুলেছিল। তারা তাদের বক্তব্য-বিবৃতিতে আচরণগত সমস্যাকে জটিল থেকে জটিলতর করে তুলেছিল। এদের অনেকেই বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে নানা ধরনের অপকর্ম করেছে। কেউ কেউ আবার জিয়ার দলে সুবিধা আদায়ের জন্য যোগ দিয়েছে। আসলে ‘এনিমেল ফার্ম’-এর পশুগুলোর মতোই পাশবিকতায় এরা ভরপুর ছিল। আবার কেউ বা পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে আওয়ামী লীগার থেকে বড় আওয়ামী লীগার হতে চেয়েছে। মিথ্যা গল্পের খোলসে নানা বাহারি রং পঁচাত্তর পূর্বে যেমন করেছে এখনও তেমনি করে যাচ্ছে। এ সমস্ত গিরগিটির মতো রং বদলানোদের সমাজে কখনও কোন অসুবিধা হয় না। এদের কারণে সমাজে এক ধরনের অস্থিরতা বিরাজ করে। এ জন্য বলা হয় ‘এ্যা ট্রেইটর ইজ অলওয়েজ ইজ ট্রেইটর।’ অথচ এরা এখনও বিদ্যমান সামনে কাউয়ার মতো আওয়ামী লীগার সেজে বসে আছে মুখে বড় বড় কথা। তলে তলে বিএনপি-জামায়াতের চেয়েও নরাধম হয়ে উঠছে। এদের কেউ না কেউ, বিভিন্ন সময়ে ক্ষমতার কাছাকাছি ছিল, কিন্তু ইনডেমনিটি বিল নিয়ে কখনও কোন কথা বলেনি। তিরিশ বছরের অধিককাল লেগেছে ঘৃণ্য ইনডেমনিটি বিলটি বাতিল হতে। তবে বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের সদস্যদের হত্যার ব্যাপারে আদালতে রায় দীর্ঘদিন পর হলেও হয়েছে। তবে যারা বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে নানা মিথ্যা অপপ্রচার করেছেন, তাদের কোন তালিকা হয়নি। এমনকি যারা বঙ্গবন্ধুর মর্মন্তুদ মৃত্যুর পরও তার বিরুদ্ধে ও তার পরিবারের বিরুদ্ধে নানামুখী কুৎসা রটনা করেছেন তারা কিন্তু এখনও সমাজে বহাল তবিয়তে ক্ষমতাতন্ত্রের কাছাকাছি আছে। এদের বিরুদ্ধে আসলে কোন বিচার না হওয়ায়, কিংবা ন্যূনতম পক্ষে চিহ্নিত না করা যাওয়ায় এরা ধরাকে সরা জ্ঞান করে থাকে। সম্প্রতি দেশের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিবিসি বাংলা সার্ভিসে সাক্ষাতকার দেন। এতে তিনি উল্লেখ করেন যে, তার বাবা-মা-ভাইদের সব হারালেন, খুনীদের বিচার না করে ইনডেমনিটি দেয়া হলো অর্থাৎ অপরাধকে প্রশ্রয় দেয়া হয় এবং তিনি আক্ষেপ করে আরও বলেন যে, তাকে বিচার পেতে পঁয়ত্রিশ বছর পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছে। আসলে জিয়া যে অন্যায় করেছিল, ধারাবাহিকভাবে পরবর্তী সরকাররা সেটি বহাল রেখেছিল। তখনও এক শ্রেণীর বামপন্থী এদের দোসরে পরিণত হয়েছিল। বাম দলের অনেকের ধারণা তাদের জ্ঞান-গরিমা অন্যদের তুলনায় অনেক উচ্চমার্গে। ফলে দেখা যায় বাচ-বিছার না করে পরাশ্রয়ী জীবের মতো বিভিন্ন সরকারের কাঁধে সওয়ার হতে। এদের সবচেয়ে বড় পটুতা হচ্ছে মিথ্যা বলায়, মিথ্যা অপবাধ দেয়ায় এবং নানা ধরনের অসৎ কাজ করে অবলীলায় মিথ্যা বলায়। এরা ধরাকে সরা জ্ঞান করে থাকে। আর করবেই না কেনÑ এদের অনেকেই আবার বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী পালনে এখন ব্যস্ত রয়েছেÑ অবস্থা দাঁড়িয়েছে মায়ের চেয়ে মাসীর দরদ বেশি। গুজব এরা তিয়াত্তরে শুরু করেছিল আর এখন বিএনপি-জামায়াতসহ স্বার্থান্বেষী মহল ক্রমান্বয়ে ডালপালা বিস্তার করে জনমনে নানা ভয়-ভীতির সঞ্চার করছে। সরকার সাধ্যমতো মানুষের উন্নয়নকে বঙ্গবন্ধুর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে এগিয়ে নিতে সহায়তা করছে। কিন্তু নানামুখী গুজব আসলে কোন না কোনভাবে ঘুষের মধ্যে ভীতির সঞ্চার করছে। এটি হয়ে উঠেছে এক ধরনের সাইকোলজিক্যাল ম্যানিয়া। এই ম্যানিয়ার কারণে মানুষের অন্তরে বিষবাষ্প ঢুকছে- যা সামাজিক অস্থিরতাকে বিনষ্ট করছে। এক সময় যারা শেখ কামাল সাহেবের বিরুদ্ধে মিথ্যা অপপ্রচারে লিপ্ত হয়েছিল, তাদের সম্পর্কে কি ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে সেটি খতিয়ে দেখা দরকারÑ এ কারণে যে, এরা এখনও কিন্তু থেমে নেই। আসলে গুজব রটনাকারীদের একাংশের যদি বিচার হতো তবে কিন্তু নিত্য নতুন কলা-কৌশল অবলম্বনের সুযোগ পেত না। আর দেশ থেকে স্বেচ্ছায় পালিয়ে গিয়ে বিদেশ বিভূইয়ে বসে মিথ্যার বেসাতী আর অর্থের পাহাড়ে থেকে এ দেশে ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র করার সাহস পেত না। ডেঙ্গু একটি বৈশ্বিক সমস্যা। এটি সমাধানের জন্য গাজীপুরের মেয়র নিজ অর্থ খরচে বিদেশ থেকে ওষুধ এনে তার সিটি কর্পোরেশনে যে কর্মসূচী গ্রহণ করেছে তা অত্যন্ত প্রশংসনীয়। আশা করা যায়, গাজীপুরের মেয়রের কাছ থেকে ঢাকার দুই মেয়র এ ব্যাপারে শিক্ষা নিয়ে জনগণের পাশে দাঁড়াবেন। পাশাপাশি দেশের প্রত্যেকটি মানুষকে তার নিজস্ব গৃহকোণ অফিসের দফতর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। কেবল সরকারের মুখাপেক্ষী থাকলে চলবে না, কিংবা সিটি কর্পোরেশন। এটি আমজনতা যে কাউকে এডিস মশা আক্রান্ত করতে পারে। যারা তাদের প্রিয়জনকে হারিয়েছেন, তারাই কেবল দুঃখ বুঝতে পারে। এদিকে কিছু কিছু হাসপাতাল, ডায়াগনস্টিক সেন্টার আর নার্সিং হোম ডেঙ্গু নিয়ে তেলেসমাতি কারবার বা ব্যবসা বাণিজ্যের আয়োজন করেছে। সরকারের বেঁধে দেয়া ফি না রাখার জন্য ডেঙ্গু টেস্টের কিটস নেই বলে অনেকে দাবি করে। আসলে নাগরিক সমাজ কিন্তু এক ধরনের নির্লিপ্ততায় বিদ্যমান। ডেঙ্গু নিয়ে সচেতনতা দরকার স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে সঠিক করণীয় সম্পর্কে দিকনির্দেশনা দেয়া বাঞ্ছনীয়। সঙ্গে সঙ্গে অবশ্যই সরকারী হোক কিংবা বেসরকারী হোক হাসপাতালগুলো পরিষ্কার আছে কিনা, কিংবা পরিষ্কার না থাকলে পরিষ্কার করার ব্যবস্থা করতে হবে ওই এলাকার সিটি কর্পোরেশনকে। চিকিৎসক এবং নার্সরা যাতে সুস্থ থাকে সেটিও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে দেখভাল করতে হবে। ডেঙ্গুর সমস্যা নিয়ে নেত্রীর নির্দেশে প্রশংসনীয় কাজ করছেন ওবায়দুল কাদের। জনগণের প্রত্যাশা এটুকুই অন্তত তাদের কাছে ওবায়দুল কাদেরের মতো কিংবা গাজীপুরের মেয়রের মতো মানুষেরা থাকুক। কি ঘৃণ্য রাজনীতি বিএনপিওয়ালারা একেক সময়ে ডেঙ্গু নিয়ে উল্টাপাল্টা বলছেন। অথচ তারা ডেঙ্গু সমস্যা সমাধানে সহায়তার হাত বাড়াচ্ছে না। পত্রিকান্তরে প্রকাশিত রিপোর্টে দেখা যায়, ট্রাফিক পুলিশ বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। যাদের লাইসেন্স বা কাগজপত্র নেই তাদের না ধরে বরং মিথ্যা মামলা দেয়া হচ্ছে। ট্রাফিক পুলিশদের একটু রাশ টানা দরকার। যখন দুর্ঘটনা ঘটে তখন খুঁজে পাওয়া যায় না। কিন্তু মামলা দিলে তখন তারা ছাড়াও তাদের সাপোর্টে আগের থেকে রেডি করা লোক পাওয়া যায়। আগস্ট মাস একটি দুঃখজনক অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত। যে ব্যক্তি তার দেশের সাধারণ মানুষের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন, তার শিশুপুত্রসহ হত্যা করতে দ্বিধা করেনি। তবে এখন বাতাসে শকুনেরা ঘুরে বেড়াচ্ছে। দেশের মঙ্গল ওই তারা চায় না। এরা খালেদার আমলে সুবিধা নিয়েছেন, আবার বর্তমান সরকারের আমলেও সুবিধা নিচ্ছে। এদের দেখে সাধারণ মানুষ হিসেবে আমরা দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়ি। দুঃখ লাগে, যখন বিরাশি থেকে ঊননব্বই সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগ কর্মী হিসেবে শিবিরের উৎপাত সহ্য করতে হয়েছে; জাসদ-বাসদের ছাত্র সংগঠনের পাল্টাপাল্টি সুবিধাবাদী অবস্থান; ছাত্র ইউনিয়নের লেজুড়বৃত্তি আজ মনে হয় আমাদের জীবনের মধ্যে মিথ্যার প্রহেলিকা ঢেকে গেছে। ভাল করলেও কোন ধরনের প্রশংসা না করে পেছন থেকে টেনে ধরার লোকের অভাব হয় না। এটি আজ মজ্জাগত হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ বৃত্তি ভাঙতে হলে যারা ক্ষমতার অপব্যবহার করে থাকেÑ তাদের চিহ্নিত করে সরিয়ে দেয়া দরকার। একুশে আগস্টে জননেত্রীর ওপর যে গ্রেনেড হামলা হয়েছিল সেটি নিছক দেশী চক্রান্ত নয়। এটি একটি বহুমাত্রিক চক্রান্তের ফসল ছিল। সম্প্রতি তিনি বলেছেন, বঙ্গবন্ধুর আদর্শ দিয়ে উনার রক্তের শেষ বিন্দু দিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনা করবেন। বাস্তবিক তিনি তা করে চলেছেন। তার কারণেই রাষ্ট্রের উন্নতি। পঁচাত্তরের শোকাবহ দিন বাঙালীর ভাগ্যাকাশে পৈশাচিকতা ও নির্মমতাকে একই সূত্রে গেঁথেছে। সুবিধাবাদী বিএনপি-জামায়াত ও হাইব্রিডদের কারণে আজ সামাজিক পরিম-লে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। যারা বকধার্মিক তাদের চিহ্নিত করা দরকার। আশার কথা, বাঙালী আজ উন্নয়নের সড়কে আছে। সমাজে ও রাষ্ট্রে সব কালে, সব দেশে সমস্যা আছে, সমস্যা থাকবে। এ সমস্যা ধামাচাপা না দিয়ে বরং যারা সমস্যা মিথ্যার ওপর ভর করে তৈরি করবে তাদের চিহ্নিত করে ইতিহাসের আঁস্তাকুড়ে নিক্ষেপ করা হোক। বঙ্গবন্ধুর হত্যার সঙ্গে পরোক্ষভাবে জড়িতদের তালিকা করা হোক। লেখক : শিক্ষাবিদ ও অর্থনীতিবদ [email protected]
×