ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

গোলাবারুদের খেলায় ভাই-বোনের যুগলবন্দীতে একটি সাফল্যের গল্প ...

প্রকাশিত: ০৭:৩৭, ৯ আগস্ট ২০১৯

গোলাবারুদের খেলায় ভাই-বোনের যুগলবন্দীতে একটি সাফল্যের গল্প ...

স্পোর্টস রিপোর্টার ॥ সিরাজগঞ্জের সপ্তদর্শী এক শূটার গার্লের গল্প বলবো আজ। জীবনের প্রথম শূটিং প্রতিযোগিতায় মাত্র দুই মাসের প্রশিক্ষণ নিয়ে সদ্যসমাপ্ত আন্তঃক্লাব শূটিং প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে অভিষেকেই পেয়ে গেছেন নজরকাড়া সাফল্য। জিতেছেন স্বর্ণপদক! আরও ইন্টারেস্টিং ব্যাপার, তিনি যার অধীনে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন, তিনি একজন জাতীয় শূটার সম্পর্কে তার ভাই । বাংলাদেশের শূটিংয়ে একই পরিবারে ভাই-বোন শূটার ... এমনটা বোধকরি বর্তমানে নেই। এ যেন একই বৃন্তে দুটি ফুল। সেই শূটারকন্যার নাম মেহেনাজ চৌধুরী মীম। আর তার ভাইয়ের নামটা পাঠকের নিশ্চয়ই বেশ পরিচিত, শোভন চৌধুরী। মীম ঢাকা রাইফেল ক্লাবের শূটার হিসেবে ভর্তি হন মাস দুয়েক আগে। জনকন্ঠকে তিনি বলেন, ‘ভাইয়াই সব ব্যবস্থা করেন। তিনিও ওই ক্লাবের শূটার। তার কোচিংয়েই আমি এই দুই মাস অনুশীলন করি। নিজের বোন বলে তিনি আমাকে কখনও ছাড় দেননি এতটুকু। ভুল করলে বা খারাপ করলে কষে ধমক দিতেন। তখন খুব মন খারাপ হতো। পরে আমাকে ভাইয়াই আদর করে বুঝিয়ে-শুনিয়ে মানিয়ে নিতেন।’ এ প্রসঙ্গে শোভন বলেন, ‘মাঝে মাঝে ও কাঁদতে কাঁদতে বলতো, আমি শূটিং করবো না, বাড়ি চলে যাব!’ দুই ভাই, এক বোনের মধ্যে মীম সবার ছোট। বড় ভাই আশিক কবীর চৌধুরী এক সময় প্রথম বিভাগ ক্রিকেট লিগে খেলতেন। সদ্যসমাপ্ত আন্তঃক্লাব শূটিং প্রতিযোগিতার ২৪তম আসরে ১০ মিটার এয়ার রাইফেল মহিলা ইভেন্টে স্বর্ণপদক পান মীম। তার স্কোর ছিল ৬০০-এর মধ্যে ৫৬৬ পয়েন্ট, যা দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থানে থাকা প্রতিযোগীর চেয়ে যথাক্রমে ৬ এবং ৭ পয়েন্ট বেশি। চ্যাম্পিয়ন হয়ে স্বর্ণপদক এবং একটি সনদপত্র লাভ করেন তিনি। চ্যাম্পিয়ন হয়ে সিরাজগঞ্জে নিজ এলাকায় যাবার পর এলাকার বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী, এমনকি স্কুল টিচাররাও মীমকে দেখতে তাদের বাড়িতে এসে ভিড় করেন। বলা যায়, নিজ এলাকায় মীম এখন ‘ফেমাস’! এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এটাই আমার জীবনের প্রথম কোন প্রতিযোগিতামূলক শূটিংয়ে অংশ নেয়া। শুরুতে ভীষণ নার্ভাস ছিলাম। ভাইয়া আমাকে সাহস জুগিয়েছেন প্রতিনিয়ত। পরে ধীরে ধীরে ভয়টা চলে যায়।’ মীম আরও যোগ করেন, ‘ভবিষ্যতে শূটিং খেলাটা চালিয়ে যাব, যদি ভাইয়া সবসময় আমার পাশে থাকে। তিনিই আমার আদর্শ। ছোটবেলা থেকেই পত্রিকায় ও টিভিতে ভাইয়ার ছবি-খবর পড়ছি, দেখছি। এজন্য সবসময়ই আমি গর্বিত।’ যদি ভাইয়া পাশে থাকতে না পারে, তাহলে কি খেলবেন না? ‘না, তখনও খেলবো। কেননা খেলাটাকে ভালবেসে ফেলেছি। ভাইয়া পাশে না থাকলেও তার পরামর্শ অন্তত নেব।’ শৈশব থেকেই ভাইয়ের রাইফেল দেখে ইচ্ছে করতো শূটিং করার। শোভনও মীমের আগ্রহ টের পেতেন। এবং তার রাইফেলটা তাকে ধরতে দিতেন। তখন থেকেই রাইফেলে হাত দেয়া শুরু। ‘ভাইয়া আমাকে রাইফেল ধরা শেখান। তখন ক্লাস থ্রিতে পড়ি। প্রথমে রাইফেল ভারী বলে হাতে বেশিক্ষণ রাখতে পারতাম না, পরে ধীরে ধীরে হাতের মাসল শক্ত হয়ে গেলে রাইফেলের ওজন কোন সমস্যা হয়নি। এভাবেই শৈশব থেকেই নিজের অজান্তেই শূটার হওয়ার ট্রেনিং নেয়া শুরু করেছিলাম! আসলে আমার যতটা আগ্রহ ছিল শূটার হবার, ভাইয়ের তার চেয়ে বেশি আগ্রহ ছিল আমার শূটার হবার ক্ষেত্রে। বাবা চৌধুরী খলিলুর রহমান এবং মা মাহফুজা চৌধুরীরও কোন আপত্তি ছিল না এ ব্যাপারে।’ মীমের ভাষ্য। সিরাজগঞ্জে মীমের জন্ম ২০০২ সালের ২৫ এপ্রিল। সিরাজগঞ্জ মহিলা কলেজে উচ্চ মাধ্যমিকে পড়ছেন মানবিক বিষয় নিয়ে। মেয়েবেলায় স্কুলে দৌড় এবং লং জাম্প খেলতেন নিয়মিত। খেলা দুটিতে দু’বার করে ফার্স্ট প্রাইজও পেয়েছেন। এছাড়াও ভাল ক্ল্যাসিক ড্যান্সও করতেন। স্কুলের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে নেচেছেন। যখনই মন খারাপ হয়, তখন মন ভাল করতে অভিনব পদ্ধতি অবলম্বন করেন। দরজা বন্ধ করে একা একা খানিকটা নেচে নেন, আর মন ভাল হয়ে যায় নিমিষেই! ট্যুরিস্ট হিসেবে দেশের বাইরে ২০১৮ সালে ভারতের চেন্নাইয়ে গিয়েছিলেন মীম। এখন চান শূটার হিসেবে দেশের বাইরে ঘুরতে। ভবিষ্যত লক্ষ্য? ‘জাতীয় দলের হয়ে খেলা এবং অলিম্পিকে অংশ নেয়া। এজন্য যতটা পরিশ্রম করতে হয়, করবো।’ মীমের জবাব। শোভন চৌধুরী। সুদর্শন এই শূটার যখন ক্লাস ফোরে পড়তেন, তখন বাবার এয়ারগান দিয়ে পাখি শিকার করতেন। পরে বিকেএসপিতে ক্রিকেটার হিসেবে ভর্তি হতে গিয়ে শূটিংয়ের কথা জানতে পারেন। ছোটবেলায় পাখি শিকারে তার ভাল নিশানা ছিল। সেটার ওপর ভরসা করেই শূটিংয়ে পরীক্ষা দিয়ে টিকে যান। মীমের মতোই সুদর্শন শোভনের জন্ম এপ্রিলেই (১৬ এপ্রিল), তবে নয় বছরের বড় তিনি। জাতীয় শূটিং প্রতিযোগিতায় আগমন ২০০৭ সাল। এ পর্যন্ত জিতেছেন ৩ স্বর্ণ, ৫ রৌপ্য ও ৩ তাম্রপদক। ক্লাব পর্যায়ে বিভাগীয় পর্যায়ে অর্জন ১ স্বর্ণ। আর আন্তর্জাতিক শূটিংয়ে তার অর্জন ১ স্বর্ণ, ২ রৌপ্য ও ৩ তাম্রপদক। বোন-শূটার মীম সম্পর্কে শোভনের মন্তব্য, ‘ঢাকা রাইফেল ক্লাবে দুই মাসের ট্রেনিং করালেও আসলে মীম আরও ছোট থেকেই শূটিং শুরু করেছিল। খেলাটির প্রতি ওর প্রচণ্ড আগ্রহ আছে। এটাই আসল। দ্রুত শিখতে পারে। বাড়তি অনুশীলনও করে। মীমের শূটিং রাইফেল, জ্যাকেট ও অন্যান্য সব ক্রীড়া সরঞ্জাম আমি নিজের টাকাতেই ওকে কিনে দিই। আন্তঃক্লাব প্রতিযোগিতায় ও যখন অংশ নেয়, তখন সত্যি বলতে কি, ওকে নিয়ে আমি মোটেও কোন আশা করিনি। মোটামুটি ভাল খেলে, খুব বেশি হলে ব্রোঞ্জ জিততে পারে, এমনটাই ভেবেছিলাম। কিন্তু ও যখন গোল্ড জিতলো, তখন ভীষণ অবাক হয়েছি। কারণ এতটা আশা করিনি।’ শোভন আরও যোগ করেন, ‘এই প্রতিযোগিতায় আমি দু’বার অংশ নিয়েছিলাম। কিন্তু কোনবারই একটি পদকও পাইনি। একবার চতুর্থ ও একবার পঞ্চম হয়েছিলাম। আর ও প্রথমবার অংশ নিয়েই আমাকে ছাড়িয়ে গেছে, স্বর্ণ জিতেছে। দারুণ খুশি হয়েছি। পারফরম্যান্সের এই ধারাবাহিকতা যদি ধরে রাখতে পারে, তাহলে ও নিঃসন্দেহে আগামীতে অনেক দ্রুতই অনেক দূর যাবে।’
×