ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

আবিদ রহমান

মেঘ-বরফের রাজ্যে

প্রকাশিত: ০৯:১৫, ১৬ আগস্ট ২০১৯

মেঘ-বরফের রাজ্যে

(২৬ জুলাইয়ের পর) ইচ্ছেটা হঠাৎ করেই উদয় হলো। গত বছর ভারতের প্রজাতন্ত্র দিবসে (১৫ আগস্ট) আমি আর আমার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু মেঘালয় গিয়েছিলাম। ভাবলাম এবার দার্জিলিং গেলে কেমন হয়? দার্জিলিংয়ে বসন্তকাল মার্চ থেকে মে মাস পর্যন্ত। তাই ৫ এপ্রিল সস্ত্রীক ঢাকার কল্যাণপুর থেকে মানিক এক্সপ্রেস (এসি)-এ বুড়িমারির উদ্দেশে যাত্রা শুরু করলাম রাত ৯টায়। ভাড়া পড়ল জনপ্রতি ৯০০ টাকা। সকাল সাড়ে ৭টায় আমরা বুড়িমারি স্থলবন্দরে পৌঁছলাম। পৌঁছেই আমাদের পাসপোর্ট জমা দিয়ে দিলাম মানিক এক্সপ্রেসের কর্মচারীদের কাছে। তারা জনপ্রতি ২৫০ টাকা বিনিময়ে বাংলাদেশ ইমিগ্রেশনের সকল কাজ সম্পন্ন করে দেয়। এটা কিভাবে করে? এর ভেতরের গল্পটা আর নাই বা বললাম। আমরা সেখানে ফ্রেশ হয়ে হোটেলে নাস্তা করলাম। সকাল ৯টায় ইমিগ্রেশন অফিস খোলার পর শুধু ছবি তোলার কাজটা লাইন ধরে সারতে হলো। ব্যাস, বাংলাদেশ বর্ডারের কার্যক্রমের ইতি। এবার হেঁটে ভারতীয় ইমিগ্রেশনে ঢুকলাম। সেখানেও যথারীতি দালালের দৌরাত্ম্য। ইমিগ্রেশনের যাবতীয় কাজ জনপ্রতি ১০০ রুপীতে করে নিলাম। দুই বর্ডারের কার্যক্রম শেষ হলো। আমাদের প্রথম কাজ ছিল ঘড়ির সময় ৩০ মিনিট পেছানো। তাই করলাম। এবার যেতে হবে শিলিগুড়ি। রিজার্ভ ট্যাক্সিতে মোটামুটি ১,২০০-১,৫০০ রুপী, শেয়ারে গেলে জনপ্রতি ২৫০ রুপী আর ১০ সিটের জিপে জনপ্রতি ভাড়া পড়ে ১৫০ রুপী। আমাদের ট্যাক্সি শিলিগুড়ির উদ্দেশে যাত্রা শুরু করল ১২টায়। পৌঁছাতে লাগবে মোটামুটি ৩ ঘণ্টার মতো। মাঝপথে আসতেই শুরু হলো তুমুল বৃষ্টি। দারুণ! দার্জিলিংয়ের ফ্লেভার শিলিগুড়িতেই পাওয়া গেল। এই বৃষ্টি মাথায় নিয়েই আমরা শিলিগুড়ির দার্জিলিং জিপস্ট্যান্ডে পৌঁছলাম দুপুর ৩টার দিকে। আমাদের বড় একটা ব্যাকপ্যাক আর একটা লাগেজ আছে। দু’টোই তুলে দিলাম জিপের ছাদে। বৃষ্টি থেকে মালামাল বাঁচাতে পলিথিন দিয়ে দেয়া হলো। এবার জিপ ছুটতে শুরু করল দার্জিলিংয়ের উদ্দেশে। ভাড়া জনপ্রতি ২০০ রুপী। জিপ মিনিট চল্লিশ যাবার পরই দূরে চোখে পড়লো সুউচ্চ পাহাড়। এই পাহাড়ের গা বেয়েই আমাদের জিপ উপরে উঠতে শুরু করল। পাহাড়ী রাস্তা যথেষ্ট মসৃণ ও আঁকাবাঁকা। ভয়ের ব্যাপারটা ঘটল তখন যখন দেখলাম বাঁপাশে কোন রেলিং বা প্রাচীর নেই। প্রায় আধঘণ্টা পর আবিষ্কার করলাম নিচের দিকে তাকালে ভয়ে গায়ে কাটা দিচ্ছে। আমাদের গাড়ি মোটামুটি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২,৫০০ ফুট উপর দিয়ে পাহাড় বেয়ে উঠছে। শত শত বাঁক এই পাহাড়গুলোতে। গাড়ি উপরে উঠছে তো উঠছেই, ছুটছে তো ছুটছেই; যেন কোন বিরাম নেই। ৩০ বা ৪০ মিনিট পরপর আমরা সমতল কোন একটি শহরে পৌঁছে যাচ্ছি আর তখনই মনে হচ্ছে এটাই বুঝি আমার স্বপ্নের দার্জিলিং। আশা ভঙ্গ হয় তখনই যখন সেই শহরগুলোকেও পিছু ফেলে আমাদের গাড়ি ছুটে যায় সামনের দিকে। যা হোক যখন আমরা দার্জিলিং এ পৌঁছলাম তখন সন্ধ্যা হবে হবে অবস্থা। ক্ষুধায় পেট চো-চো করছে। বৃষ্টি সেই যে পিছু নিল আর কিন্তু থামেনি এক দ-ের জন্যও। সুতরাং আমরা তাড়াতাড়ি আমাদের বাক্স-পেটরা নিয়ে ছাতার নিচে মাথাগুঁজে একটি মুসলিম হোটেল খুঁজতে বের হলাম। একজনকে জিজ্ঞেস করতেই বলল, আপনারা বড় মসজিদের কাছে মুসলিম হোটেল পাবেন। তাই করলাম, ফলাফলও হলো শুভ। চকবাজার থেকে হেঁটে প্রায় ৫/৬ মিনিটের পথ উপরে উঠতেই আমরা মসজিদটির সন্ধান পেলাম। মসজিদের কাছেই দুটি মুসলিম হোটেল। একটি ছোট আর আরেকটি বড়। আমরা বড়টাতে ঢুকে পেটচুক্তি গরুর মাংস দিয়ে ভাত খেলাম। হোটেলের নাম ইসলামিয়া রেস্টুরেন্ট। গরুর মাংস ৬০ রুপী। যথেষ্ট সুস্বাদু কিন্তু অনেক ঝাল। মুসলিম হোটেলের পাশেই একটি আবাসিক হোটেল পেলাম। নাম হোটেল ক্রিস্টাল প্যালেস (লামা রোডে অবস্থিত)। সেখানে দিনপ্রতি ১,৫০০ রুপীতে একটা রুম নিলাম। হোটেলে ডকুমেন্ট হিসেবে প্রত্যেকের পাসপোর্ট আর ভিসার ফটোকপি রাখল। সুন্দর ছিমছাম রুম। ইন্টারনেট, গীজার, টিভিসহ যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা আছে। দার্জিলিং এ রাত ৮টার পর সব দোকানপাট বন্ধ হয়ে যায়। তাই ক্লান্ত শরীরে আর হোটেল থেকে বের হলাম না। লম্বা জার্নির পর লম্বা একটা ঘুম দেয়াটাই শ্রেয় মনে হলো। পরদিন সকাল ৭টায় ঘুম ভাঙল। জানালায় ভারি পর্দা ছিল। পর্দা সরাতেই মুখ দিয়ে একটি কথাই বেরিয়ে এলো আর তাহলো ‘ওয়াও!! অসাধারণ’। রোদ্রজ্জ্বল আবহাওয়া। পাহাড়ের প্রতিটি ধাপে ধাপে বাড়ি আর হোটেল। ধাপগুলো শেষ হবার পর প্রায় ৭,০০০ ফুট গভীর খাদ। পুরু ঘনত্বের সাদা সাদা মেঘগুলো ভাসছে খাদের ওপর যত্রতত্রভাবে যা হোটেলের উচ্চতা থেকেও অনেকটা নিচে। মনে হচ্ছে হোটেল থেকে নেমে ৩০-৪০ মিনিট নিচে নামলেই মেঘ ছুঁতে পারব। এমন ভিউ কিন্তু সব হোটেল থেকে দেখা যায় না বা হোটেলের সব রুম থেকেও দেখা যায় না। আমি সৌভাগ্যবান ছিলাম, তাই প্রকৃতি আমাকে নিরাশ করেনি। যাক, তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে আবার ইসলামিয়া রেস্টুরেন্টে নাস্তা সারলাম পরটা, ডিম আর চা দিয়ে। এবার গন্তব্য চকবাজার মোড় ট্যাক্সিস্ট্যান্ড। দরদাম করে সাইট সিয়িং এর জন্য ট্যাক্সি নিলাম ১,৫০০ রুপীতে। প্রথমে গেলাম ঘুম রেলস্টেশন ও ঘুম রেলওয়ে মিউজিয়াম। এই স্টেশন ইউনেস্কো ওয়ার্ড হেরিটেজের একটি অংশ, যা পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু রেলস্টেশন (৭,৭০৪ ফুট)। রেলস্টেশনের অদূরেই ঘুম মনেস্ট্রি। এটি একটি বৌদ্ধ মঠ। এটির জনপ্রিয় নাম হল ইগা চেওলিং মঠ। এটি ঘুম শহরে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৮,০০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত। মঠে মৈত্রেয় বুদ্ধের একটি ১৫ ফুট লম্বা মূর্তি আছে। ১৮৭৫ সালে লামা শেরাব গ্যাতসো এই মঠ স্থাপন করেন। ঘুম শহরের তিনটি মঠের মধ্যে এটি বৃহত্তর। সেখান থেকে গেলাম দালি মনেস্ট্রি বা উৎঁশ ঞযঁঢ়ঃবহ ঝধহমধম ঈযড়বষরহম গড়হধংঃবৎু. খুবই সুন্দর। তারপর সেখান থেকে সরাসরি পদ্মজা নাইডু হিমালয়ান জুওলজিক্যাল পার্ক। পার্কের প্রবেশ পথেই অনেকগুলো দোকান সাজানো আছে। সেখানে বিভিন্ন ধরনের পণ্যের পসরা সাজিয়ে বসে থাকে দোকানিরা। শীতের শাল, জ্যাকেট, ট্রেডিশনাল ছুড়ি, পেইন্টিংসহ নানা জিনিস এখান থেকে দরদাম করে কেনা যায়। পার্কের প্রবেশমূল্য সার্কভুক্ত দেশের জন্য জনপ্রতি ৬০ টাকা। এই পার্কের ভেতর প্রবেশ করলেই প্রথমে পড়বে চিড়িয়াখানা। অনেক ছোট একটা চিড়িয়াখানা কিন্তু সমৃদ্ধ। রয়েল বেঙ্গল টাইগার থেকে শুরু করে কালো বাঘ, চিতা বাঘ, স্নো লেপার্ড, হিমালয়ান উলফ, বিলুপ্তপ্রায় লাল পা-াসহ ম্যাকাও পাখিও রয়েছে এখানে। এর পাশেই রয়েছে জাদুঘর। সুন্দর ও ছিমছাম। চিড়িয়াখানা থেকে বের হলেই চোখে পড়বে হিমালয়ান মাউন্টেনিয়ারিং ইনস্টিটিউট। এখানে নিয়মিত এডভেঞ্চার, বেসিক এবং উন্নত মাউন্টেনিয়ারিং কোর্সগুলো পরিচালনা করা হয়। জুওলজিক্যাল পার্ক থেকে বের হয়ে গেলাম রঞ্জিত ভ্যালি প্যাসেঞ্জার রোপওয়ে’তে (ক্যাবল কার)। সিঙ্গলা চা বাগানের প্রায় ৫০০ ফুট উপর দিয়ে ক্যাবল কারটি অপরপ্রান্ত সিঙ্গলা বাজারে পৌঁছতে প্রায় ২০ মিনিট সময় লাগে। অর্থাৎ আসা-যাওয়াসহ প্রায় ৪০ মিনিট। ক্যাবল কার থেকে নিচের সবুজ চা বাগান আর দূরের সুবিস্তীর্ণ পাহাড়ের রাশি আর মেঘমালার মনোরম দৃশ্য যে কাউকে মুগ্ধ করতে বাধ্য। এর বিনিময়ে জনপ্রতি খরচ হবে মাত্র ২০০ রুপী। তবে এটিতে চড়তে প্রায় দুই থেকে আড়াই ঘণ্টার দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। এই লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে বোরিং না হয়ে এখানকার মোমো আর পাপড়ি চাট খেয়ে নেয়া যায়। মোমো ৮ পিছ ৬০ রুপী আর পাপড়ি চাট প্লেটপ্রতি ৪০ রুপী। তারপরের গন্তব্য ছিল তেনজিং রক। এটা উল্লেখ করার মতো কিছু না। সেখান থেকে গেলাম ভারতের বিখ্যাত হ্যাপি ভ্যালি টি স্টেট-এ। সবগুলো স্পট দেখে বিকেল ৪:৩০ মিনিটে ড্রাইভার আমাদের চক বাজারের দার্জিলিং মল এ নামিয়ে দিল। এই স্থানকেই দার্জিলিংয়ের হার্ট বলা হয়। প্রচুর পর্যটকের সমাগম হয় বিকেলটাতে। এখানে একটি ‘ওপেন এয়ার থিয়েটার’ রয়েছে। যে কেউ নাম এন্ট্রি করে স্টেজে গিয়ে নাচ, গান, আবৃত্তি বা অন্য যে কোন পারফরম্যান্স করতে পারে, তাও সম্পূর্ণ বিনামূল্যে। এই থিয়েটারের আয়োজক দার্জিলিং পুলিশ কর্তৃপক্ষ। ভাল একটি পদক্ষেপই বলা যায়। মল এর কাছেই রয়েছে কম খরচে রেডিমেট পোশাকের মার্কেট। একটি হলো নিউ মহাকাল মার্কেট আর আরেকটি হলো মল মার্কেট। ঘণ্টা দু’য়েক সেখানে ঘোরাঘুরি করে চলে গেলাম চকবাজার এর কেএফসি’তে। সেখানে বার্গার, ফ্রেঞ্চ ফ্রাই আর কোক দিয়ে রাতের হালকা ডিনার সেরে হোটেলে ফিরে এসে হোটেল মালিককে বললাম যে আমরা আগামীকাল টাইগার হিলে যাব, ব্যবস্থা করুন। তিনি একটি জিপ ড্রাইভারকে ফোন দিয়ে আমাদের কনফার্ম করলেন এবং বললেন ভোর সাড়ে ৪টায় হোটেলের সামনে থাকবেন। জিপ আপনাদের তুলে নিয়ে যাবে। এজন্য দিতে হবে জনপ্রতি ২০০ রুপী। তাই করলাম। ভোরে হোটেলের সামনে থেকে জিপে উঠলাম। জিপে আমরা ১০ জন ছিলাম। অন্ধকারে হেডলাইট জ্বালিয়ে ছুটে চলল জিপ। (সমাপ্ত)
×