ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

শাহরিয়ার কবির

কাশ্মীর কোন পথে

প্রকাশিত: ০৯:০৯, ১৮ আগস্ট ২০১৯

কাশ্মীর কোন পথে

॥ ছয় ॥ তিরিশ বছর ধরে জঙ্গী মৌলবাদী ও সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের দাবানলে দাউ দাউ করে জ্বলছে কাশ্মীরের ধর্মনিরপেক্ষ মানবতার ঐতিহ্য। গত শতাব্দীর মধ্যভাগে, এমনকি আশির দশকেও কাশ্মীরের সমাজ ও রাজনীতি এ রকম ছিল না। যতবার কাশ্মীর গিয়েছি এ নিয়ে কাশ্মীরী বন্ধুদের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। বন্ধুদের অনেকে দিল্লীতে থাকেন, যাদের একজন অধ্যাপক রিয়াজ পাঞ্জাবী। যখন প্রামাণ্যচিত্রের শুটিং করতে যেতাম তখন শ্রীনগরের এক প্রোডাকশন হাউস থেকে ক্যামেরা, লাইট ইত্যাদি ভাড়া করতাম। আমার ক্যামেরাম্যান ছিল রশীদ আর তার সহকারী আলী। সহকারী হলেও দু’জন ছিল মাণিকজোড়, আমি ডাকতাম রশীদ আলী। বয়সে আমার অনেক ছোট ছিল, আমাকে সম্বোধন করতো ‘স্যারজী’ বলে। শুধু ‘স্যার’ বলাটা ওদের কাছে বেয়াদবী মনে হতো, সম্ভ্রম প্রকাশের জন্য ‘স্যার’-এর সঙ্গে ‘জী’ যোগ করত। প্রখর সৌজন্যবোধও কাশ্মীরী সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্য। শুটিংয়ের ফাঁকে ওদের সঙ্গে নানা বিষয় নিয়ে গল্প হতো। যে কাশ্মীরে ১৯৮৯ সাল থেকে হিন্দুদের মেরেকেটে, ঘরবাড়িতে আগুন দিয়ে ভিটেছাড়া করা হয়েছে, সেই কাশ্মীরের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অনেক কথা রশীদদের কাছে শুনেছি। ওরা দু’জনই মিলিট্যান্টদের বিরুদ্ধেÑ সন্ত্রাসের কারণে ওদের জীবন-জীবিকা দুই-ই বিধ্বস্ত। রশীদ একদিন বলছিল, কাশ্মীরে মিলিট্যান্সি আসার আগে আমাদের অনেক হিন্দু বন্ধু ছিল। স্কুল-কলেজের বেশিরভাগ শিক্ষক ছিলেন হিন্দু, যাদের পণ্ডিত বলা হয়, বর্ণ পরিচয়ে যারা কুলীন ব্রাহ্মণ। আমরা প্রায়ই হিন্দু শিক্ষকদের বাড়ি যেতাম। তাদের কারও বাড়ির বিয়ে বা কোন সামাজিক অনুষ্ঠানে আমরা সবার সঙ্গে পাশাপাশি বসে খেয়েছি। অনেক সময় খাবার পরিবেশনের কাজও করেছি সানন্দে। ভারতের সবখানে আপনি জাত-পাত দেখতে পাবেন। বিহারে তো শুনেছি অভিজাত ঠাকুররা নিম্নবর্ণের হিন্দুদের পুড়িয়ে মারে জাত-পাত না মানার কারণে। কাশ্মীরে কখনও জাত-পাতের সমস্যা ছিল না। ১৯৪৬ সালে সাম্প্রদায়িক দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে দেশভাগের আগে ভারতবর্ষজুড়ে হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাঁধানো হয়েছিল। হিন্দু-মুসলিম দুই প্রধান ধর্মীয় সম্প্রদায়ের অনুসারীরা, যারা ভারতবর্ষের সাম্প্রদায়িক বিভাজনের পক্ষে ছিল, সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দল ও সংগঠনগুলোর প্ররোচনায় এই নৃশংস দাঙ্গায় অংশগ্রহণ করেছে। তখন কাশ্মীর ছিল একমাত্র ব্যতিক্রম। কাশ্মীর সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের আবাস হলেও হিন্দু জনসংখ্যা কম ছিল না। মুসলিম কনফারেন্সের মতো সাম্প্রদায়িক সংগঠনও ছিল, যারা হিন্দু ডোগরা রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে জিহাদের ডাক দিয়েছিল গত শতাব্দীর তিরিশের দশকে। অথচ ’৪৬ সালে কাশ্মীরে সাম্প্রদায়িক সংঘাতের একটি ঘটনাও ঘটেনি। যে কারণে মহাত্মা গান্ধী তখন বলেছিলেন, ‘ধর্মনিরপেক্ষ ভারতের জন্য একমাত্র আশার আলো হচ্ছে কাশ্মীর।’ কাশ্মীরের হিন্দুদের মতো মুসলমান, শিখ, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান সব ধর্মের মানুষ শত শত বছর ধরে শান্তি ও সম্প্রীতির সঙ্গে বাস করেছেন, কারও সঙ্গে কারও কখনও কোনও সাম্প্রদায়িক বিরোধ ছিল না। কাশ্মীরে মুসলমানদের ভেতর অসাম্প্রদায়িক মানবিক চেতনা সঞ্চারিত করেছেন সুফীসাধক হযরত শেখ নূরউদ্দিন ওয়ালি (১৩৭৭-১৪৪০ খৃ:), হিন্দু ভক্তরা তাঁকে সম্বোধন করেন ‘নুন্দ ঋষি’ বলে। কথিত আছে জন্মের পর নূরউদ্দিন ওয়ালি মাতৃদুগ্ধ পান করেননি। তাঁকে স্তনদান করেছেন তাঁরই প্রতিবেশী এক হিন্দু শৈব সন্ন্যাসিনী, যার নাম লালেশ্বরী। মুসলমানরা তাঁকে শ্রদ্ধার সঙ্গে সম্বোধন করে ‘লাল দেদ’ বা ‘লাল্লা আরিফা’ নামে। কাশ্মীরের হিন্দুরা এখনও লালেশ্বরীর লেখা ভজন গায়। লালেশ্বরীর ভজন ও কাব্যে আধ্যাত্মিকতার পাশাপাশি মানুষকে ভালবাসার কথাও আছে। নূরউদ্দিন ওয়ালি কাশ্মীরে শান্তি ও উদারতার ইসলাম প্রচার করেছেন। লালেশ্বরীর আধ্যাত্মিক রচনা তাঁকে প্রচ-ভাবে অনুপ্রাণিত করেছিল। যে কারণে তাঁর প্রচারিত ইসলামে শান্তি ও সহমর্মিতার পাশাপাশি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির কথা বলা হয়েছে। তাঁর সম্পর্কে কাশ্মীরে একটি জনশ্রুতি রয়েছে। বলা হয়, মৃত্যুর পূর্বে তিনি ভক্ত ও গুণগ্রাহীদের ডেকেছিলেন। তিনি তাদের বলেছিলেন, তোমরা জান আমার ধর্ম মা ছিলেন লালেশ্বরী। তাঁর দুধ পান করে আমি বড় হয়েছি। তোমাদের আমি নির্দেশ দিয়ে যাচ্ছিÑ তোমরা আমার ধর্ম মায়ের দুধের ঋণ শোধ করবে। এরপরই তাঁর মৃত্যু হয়। তাঁর ভক্তরা কিছুটা হতবুদ্ধি হয়ে গিয়েছিলেনÑ বাবা নূরউদ্দিন ওয়ালির হিন্দু মায়ের ঋণ কীভাবে তারা শোধ করবেন? অনেক ভেবে তারা স্থির করলেন, হিন্দুরা যেহেতু গরুকে দেবতা মানে, গরুর পূজা করে, এখন থেকে তারা কেউ গরুর গোশত খাবেন না। সেই থেকে কাশ্মীরের মুসলমানরা গরুর মাংস খায় না, ভেড়া, ছাগল আর দুম্বার মাংস খায়। একবার রশীদকে নিয়ে রেস্তরাঁয় খেতে গিয়ে গরুর মাংসের কথা বলেছিলাম। রশীদ হেসে আঙ্গুল তুলে দেয়ালে ঝোলানো ছোট একটা বিল বোর্ড দেখিয়েছিল, যেখানে ইংরেজীতে লেখা ‘নো বিফ।’ রশীদ বলেছিল কাশ্মীরের মুসলমানরা বিফ খায় না। তখন গরু খাওয়ার বিরুদ্ধে এখনকার মতো হিন্দু মৌলবাদীদের কোন দৌরাত্ম্য ছিল না। হিন্দু সাধিকা লালেশ্বরীর প্রতি শ্রদ্ধা জানাবার জন্য কাশ্মীরের মুসলমানরা এখনও গরু খায় না। পীর আউলিয়া ও সাধু সন্ন্যাসীদের জীবনের অনেক কথা, অনেক শিক্ষা এভাবেই কাহিনীতে পরিণত হয়, জনশ্রুতি হিসেবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে কথামৃত আকারে প্রচারিত হয়, কখনও তা লোক-সাহিত্যেরও অংশ হয়, যা সমাজে শান্তি, সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্যরে বাতাবরণ নির্মাণ করে। বাবা নূরউদ্দিন ওয়ালির অনেক কথা আমার তরুণ কাশ্মীরী বন্ধু রশীদের কাছে শুনেছি। মিলিট্যান্টদের সম্পর্কে রশীদের ক্রোধের একটি কারণ হচ্ছেÑ তারা ডিনামাইট দিয়ে চারার-এ শরীফে বাবার মাজার ধ্বংস করেছিল। ১৯৯৫ সালের ১১ মে ঈদ-উল আজহার দিন হযরত নূরউদ্দিন ওয়ালির মাজার ধ্বংস করে জঙ্গীরা ঈদের উৎসব উদযাপন করেছে। ধ্বংসের নায়ক মস্তগুল পাকিস্তান ফিরে গেলে তাকে বিশাল সংবর্ধনা দেয়া হয়েছিল। তুরস্কের সুফী কবি জালালউদ্দিন রুমি এবং ইরানের ফেরদৌসী, হাফিজ ও শেখ সাদীর মতো নূরউদ্দিন ওয়ালির কাব্য কাশ্মীরী সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে। একবার পাকিস্তান সফরের সময় রাওয়ালপিন্ডির পুরনো বইয়ে দোকানে হঠাৎ পেয়েছিলাম কাশ্মীরের কবিদের কাব্য সংকলনের একটি ইংরেজি অনুবাদ। লালেশ্বরীর পরেই মরমী কবিদের ভেতর রয়েছেন নূরউদ্দিন ওয়ালি। কাশ্মীরের বিশিষ্ট গবেষক, অধ্যাপক রিয়াজ পাঞ্জাবী জঙ্গীদের হত্যার ফতোয়া পেয়ে শ্রীনগর ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন, যখন লাখ লাখ হিন্দুকে কাশ্মীর ছাড়া করা হয়েছে। রিয়াজ আমাকে বলেছেন, গণতন্ত্রের বৈশিষ্ট্য বলতে গিয়ে একটি বাগ্ধারা আমরা সব সময় ব্যবহার করি, সেটি হচ্ছেÑ ‘বহুত্বের ভেতর একত্ব’ (টহরঃু রহ উরাবৎংরঃু)। সমাজে বহু মত, বহু পথ থাকবে, সব কিছু মিলিয়েই সমাজ। এই বাগধারা প্রথম উল্লেখ করেছিলেন নূরউদ্দিন ওয়ালি তাঁর কবিতায়। নূরউদ্দিন ওয়ালি কাশ্মীরকে ফুলের বাগানের সঙ্গে তুলনা করেছেন। বাগান সুন্দর হয় যখন অনেক রকমের ফুল থাকে। সব ফুল যদি এক রঙের হতো, কিংবা গাছের পাতার মতো সবুজ হতো তাহলে বাগান কখনও সুন্দর হতো না। কাশ্মীরের এই বৈশিষ্ট্যকে বলা হয় ‘কাশ্মীরীয়াৎ’, যা গত তিরিশ বছরে ধ্বংস করেছে জঙ্গী মৌলবাদ। এ বিষয়ে নয়াদিল্লীতে আলোচনা হয়েছে ইসলামিক সেন্টারের সভাপতি বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ মওলানা ওয়াহিদউদ্দীন খানের সঙ্গে। ইসলাম ও জিহাদের ওপর তাঁর শতাধিক গ্রন্থ রয়েছে। তিনি বলেছেন, যারা জিহাদের কথা বলছে তারা কোরান হাদিসের অ আ ক খ পর্যন্ত জানে না। ইসলামের বিধান অনুযায়ী একটি রাষ্ট্র এবং একটি বৈধ সরকারই কেবল জিহাদ ঘোষণার ক্ষমতা রাখে। কোনও ব্যক্তি বা বেসরকারী বাহিনী কখনও জিহাদ ঘোষণা করতে পারে না। জিহাদের নামে কাশ্মীরে যা হচ্ছে তাকে জিহাদ না বলে সন্ত্রাস বলাই সমীচীন। বিষয়টি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি বলেছেন, ইসলামের সকল আচার আচরণের কিছু পূর্বশর্ত বা পূর্বপ্রস্তুতি রয়েছে। যেমন আপনি বিনা অজুতে কিংবা কাবামুখী না হয়ে নামাজ পড়তে পারেন না, মহররম মাসে রোজা রাখতে পারেন না, ঢাকায় বসে হজ করতে পারেন না। তেমনি কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠী জিহাদ বলে যুদ্ধ করলেই সেটা জিহাদ হয় না। নামাজ একা পড়া যায়, জিহাদ একা করা যায় না। জিহাদ ঘোষণার এখতিয়ার একমাত্র রাষ্ট্রের। পাকিস্তান ইচ্ছা করলে ভারতের বিরুদ্ধে জিহাদ করতে পারে, তবে এটা করতে হবে প্রকাশ্য ঘোষণার দ্বারা। শ্রীনগরে দেখেছি পাকিস্তান থেকে আসা জঙ্গী মৌলবাদীদের জিহাদী তৎপরতা এবং সীমান্তের ছায়াযুদ্ধ সেখানকার নাগরিক জীবনকে কিভাবে বিপর্যস্ত করেছে। ডাল হ্রদের শিকারার মাঝিদের অভিযোগÑ সন্ত্রাসের কারণে বাইরের পর্যটক আসা অনেক কমে গেছে। একই ধরনের অভিযোগ বিভিন্ন বুটিক আর হস্তশিল্পের দোকানিদেরও। কাশ্মীরের হস্তশিল্পের খ্যাতি শুধু ভারতে সীমাবদ্ধ নয়। ইউরোপ আমেরিকার পর্যটকরা হুমড়ি খেয়ে পড়ে কাশ্মীরী কার্পেট আর শীতবস্ত্রের জন্য। ইউরোপের বাজারে চামড়ার যে জ্যাকেটের দাম বাংলাদেশী টাকায় পনেরো/ষোলো হাজার, কাশ্মীরে তার দাম বেশি হলে দেড় হাজার। গরম শালের কথা বললে পশমিনা আর তুষের ভেতর জামেয়ারের কাজ নিউইয়র্কের শৌখিন বুটিক শপে তিন/চার লাখ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। শ্রীনগরে যখনই গিয়েছি, দেখেছি দোকানিরা পশরা সাজিয়ে বসে আছে, ক্রেতা নেই। জঙ্গীদের দৌরাত্ম্যে সিনেমা হলও বন্ধ। শ্রীনগরে বিনোদনের কোন কিছুই নজরে পড়েনি। ছায়াযুদ্ধের ছায়া চোখে পড়েছে শ্রীনগরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে, সামরিক ও আধাসামরিক বাহিনীর অবস্থানে। শ্রীনগরকে দ্বিখ-িত করে রেখেছে ঝিলাম নদী। নদীর ওপর অনেক সেতু রয়েছে। প্রত্যেক সেতুর দুই প্রান্তে বালির বস্তা ঘেরা সতর্ক সেনাপ্রহরা। শ্রীনগর বিমান বন্দরেও যথেষ্ট কড়াকড়ি চোখে পড়েছে, বিশেষ করে বিদেশীদের ক্ষেত্রে। সংবিধানের ৩৭০ ধারা এবং জঙ্গীবাদী সন্ত্রাস কাশ্মীরকে ভারতের মূলধারা থেকে বিচ্ছিন্ন করে যুক্তরাষ্ট্রের নেটিভ আমেরিকানদের ‘রিজার্ভেশন’-এর মতো এক ধরনের বন্দিশালায় পরিণত করেছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি যত আশাবাদই ব্যক্ত করুন- ৩৭০ ধারা বিলুপ্তির পাশাপাশি কাশ্মীরে জঙ্গী মৌলবাদী সন্ত্রাস বন্ধ না হলে এই বন্দীদশা থেকে কাশ্মীরের মুক্তি নেই। (ক্রমশ.)
×