ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

কমবে রফতানি আয়

চামড়া সংগ্রহের লক্ষ্য অর্জিত হয়নি

প্রকাশিত: ০৯:২৬, ১৮ আগস্ট ২০১৯

চামড়া সংগ্রহের লক্ষ্য অর্জিত হয়নি

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ কোরবানির ৩০ শতাংশ চামড়া নষ্টের কারণে সংগ্রহের নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা পূরণ না হওয়ায় রফতানি আয় কমে যাবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলেন, এ বছর মৌসুমি ব্যবসায়ীদের দাম না পাওয়ায় চামড়া রাস্তায় ফেলে, নদীতে ভাসিয়ে ও মাটির নিচে চাপা দিতে দেখা গেছে। পোস্তার ব্যবসায়ীরা (আড়তদার) কোরবানি উপলক্ষে ৩৫ লাখ পশুর চামড়া সংগ্রহের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছিলেন। কিন্তু চামড়া সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ না হওয়ায় রফতানি আয়েও প্রভাব পড়বে। ব্যাপক দরপতনের পর পর্যাপ্ত পুঁজি না থাকায় ও নষ্ট হওয়ায় তা পূরণ করতে পারেননি আড়তদাররা। নষ্ট চামড়াগুলো যথাসময়ে লবণ দিয়ে রাখলে আড়তদাররা তা নিতে পারতেন, যা পরে কাঁচামাল হিসেবে ট্যানারিগুলোতে আসত। সেখানে প্রক্রিয়াজাতের পর রফতানি করে বৈদেশিক মুদ্রা আয় হতো। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, চামড়া নষ্ট হওয়ার কারণ খুঁজতে মাঠে নেমেছে গোয়েন্দা সংস্থা। এছাড়া আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, চামড়া সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িতদের অপরাধের মাত্রা অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে। পোস্তার ব্যবসায়ীরা জানান, এখানে কাঁচা চামড়া কেনা শেষ। এখন ট্যানারি মালিকের অপেক্ষায়। তবে এ বছর ঈদের পর পোস্তার চিরচেনা রূপ দেখা যায়নি। সাধারণত কোরবানির ঈদের দিন দুপুর থেকে পোস্তায় কাঁচা চামড়া প্রবেশ করে। কিন্তু এ বছর ছিল তার উল্টো চিত্র। মৌসুমি ব্যবসায়ীরা খুব কমসংখ্যক চামড়া পোস্তায় নিয়ে এসেছেন। যাও নিয়ে এসেছেন তা দাম না পেয়ে কেউ ফেলে দিয়েছেন। আবার কেউ আড়তদারদের বলেছেন টাকা পড়ে দিন এখন চামড়া রাখুন। অনেকেই গাড়িবোঝাই চামড়া পোস্তায় না এনে রাস্তাতেই ফেলে দিয়েছেন। এ কারণে এবার আড়তদারদের লক্ষ্য অনুযায়ী চামড়া সংগ্রহ করতে পারেননি। এ বছর ৩০ শতাংশ চামড়া নষ্ট হয়েছে। এসব চামড়ার উপযুক্ত মূল্য পেলে কাঁচামাল হিসেবে আড়তে, পরে ট্যানারিতে চলে আসত। এরপর প্রক্রিয়াজাত হয়ে বিদেশে রফতানি হতো। অর্জিত হতো বৈদেশিক মুদ্রা। কিন্তু তা না হওয়ায় এবার এ খাতে বৈদেশিক মুদ্রার আয় কমবে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ হাইড এ্যান্ড স্কিন মার্চেন্ট এ্যাসোসিয়েশনের (বিএইচএসএমএ) সভাপতি হাজী মোঃ দেলোয়ার হোসেন বলেন, আমরা এবার কোরবানি উপলক্ষে ৩৫ লাখ পশুর চামড়া সংগ্রহের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছিলাম। কিন্তু তা পূরণ করতে পারিনি। বিভিন্ন কারণে ৩০ শতাংশ চামড়া নষ্ট হয়ে গেছে। আমাদের কাছে টাকা না থাকায় কিনতে পারিনি। যেহেতু চামড়া সংগ্রহ কম হয়েছে তাই রফতানিও কম হবে, আয়ও কমে যাবে। তিনি বলেন, সরকার রফতানির যে ঘোষণা দিয়েছে তা আরও আগে দিলে একপিস চামড়া কোথাও নষ্ট হতো না। দাম না পেয়ে হতাশা থেকে চামড়া ফেলে দেয়া হয়েছে। অথচ এটি জাতীয় সম্পদ। এই সম্পদ রক্ষা করা সবার দায়িত্ব। ট্যানারি মালিকরা কাঁচা চামড়া রফতানির সরকারী সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার দাবি করেছে। কোনভাবেই তাদের দাবি গ্রহণযোগ্য নয়। কাঁচা চামড়ার ন্যায্যদাম নিশ্চিত করতে হলে অবশ্যই তা রফতানির সুযোগ দিতে হবে বলে জানান তিনি। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, কোরবানির ৩০ শতাংশ চামড়া নষ্ট হওয়ার কারণ খুঁজতে মাঠে নেমেছে গোয়েন্দা সংস্থা। পাশাপাশি এখাতে ব্যাংকের দেয়া ৭শ’ কোটি টাকার ঋণ কিভাবে ব্যবহার হয়েছে তা খতিয়ে দেখছে ব্যাংকগুলো। এজন্য ঢাকার কাঁচা চামড়ার আড়ত থেকে সরকার নির্ধারিত দামে চামড়া কেনা হচ্ছে কিনা তা যাচাইয়ে বাজার মনিটরিংসহ মাঠে থাকবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এছাড়া কাঁচা চামড়া রফতানির সরকারী সিদ্ধান্তের বাস্তবায়ন চান পাইকারি ব্যবসায়ী ও আড়ত মালিকরা। অন্যদিকে ট্যানারি শিল্পের উদ্যোক্তারা সরকারী সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার আহ্বান জানিয়েছেন। এদিকে চামড়া বাজারের বিপর্যয় দেখে ১৪ আগস্ট বিকেলে ট্যানারি মালিকদের সঙ্গে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মফিজুল ইসলাম জরুরী বৈঠক করেন। বৈঠক শেষে তিনি জানান, কাঁচা চামড়া কেনার বিষয়ে দাম ও সময় নিয়ে তাদের মধ্যে দীর্ঘ আলোচনা হয়। চামড়া আমাদের জাতীয় সম্পদ। এটি মাটিতে পুঁতে ফেলা, রাস্তায় বা ডাস্টবিনে ফেলে দেয়া ঠিক হয়নি। আমরা বিষয়টি নিয়ে কাজ করছি। ট্যানারি মালিকদের সঙ্গে প্রতিনিয়ত কথা বলছি। নিশ্চয়ই সামনে এ নিয়ে আর কোন সমস্যা হবে না। প্রথমে কাঁচা চামড়া রফতানি করব এবং পরে লবণযুক্ত চামড়া রফতানির অনুমোদন দেয়া হবে। জানা গেছে, সারাদেশে এ বছর প্রায় সোয়া কোটি গবাদি পশু কোরবানি হয়েছে। মৎস্য, পশু ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, দেশের মোট চাহিদার ৬০ শতাংশ চামড়া সংগ্রহ হয় কোরবানির ঈদে। এ বছর কমপক্ষে ১ কোটি ১৮ লাখ পশুর চামড়া কেনা-বেচা হওয়ার কথা। এছাড়া ৬ হাজার ৫৬৩টি অন্য পশু। তবে দেশীয় পশুর বাইরেও এবার স্বল্প পরিমাণ গবাদি পশু মিয়ানমার, ভুটান, নেপাল ও ভারত থেকে এসেছে। সবমিলিয়ে রেকর্ডসংখ্যক কোরবানি হয়েছে এ বছর। অর্থাৎ গত কয়েকবছরে চামড়ার উৎপাদন প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে দেশে। রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর হিসাবে, চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রফতানি খাতে আয় ৯ হাজার ২৯১ কোটি টাকা (১০৯.৩০ কোটি মার্কিন ডলার) লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, কাঁচামাল সঙ্কটের কারণে লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হবে না। এবার ঢাকায় প্রতিবর্গফুট গরুর চামড়া ৪৫-৫০ এবং ঢাকার বাইরে ৩৫-৪০ টাকায় বিক্রি হবে। এছাড়া সারাদেশে প্রতিবর্গফুট খাসির চামড়া ১৮-২০ এবং বকরির চামড়া ১৩-১৫ টাকায় বেচাকেনার ঘোষণা দিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। বিশ্বের কোন দেশে এত কমদামে আর চামড়া বিক্রি হয় না। কিন্তু এই কমদামও এবার কার্যকর করেননি এ শিল্পের উদ্যোক্তারা। ফলে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে কোটি কোটি টাকার চামড়া নষ্ট করে ফেলা হয়েছে। দাম না পেয়ে চামড়া রাস্তায় ফেলে দিয়েছেন মৌসুমি ব্যবসায়ীরা। এমনকি ডাস্টবিন ও ময়লার ভাগারে চামড়া ফেলে দেয়াসহ ও মাটিতে পুঁতে রাখার মতো ঘটনা ঘটেছে। এদিকে শনিবার থেকে ট্যানারি মালিকরা চামড়া সংগ্রহের ঘোষণা দিলেও, বকেয়া টাকা না পেলে চামড়া না দেয়ার কথা জানিয়েছে আড়তদাররা। চামড়ার আড়তদাররা জানিয়েছেন, সরকারের সঙ্গে রবিবার (১৮ আহস্ট) বৈঠকের পর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিবেন তারা। আড়তদাররা আরও জানান, বিগত ৫০ বছরে এবারই প্রথম চামড়ার এতটা দরপতন। তারা বলছেন, মাঠপর্যায়ে কেনার পর প্রক্রিয়াজাতকরণের খরচই দিতে চা"েছ না ট্যানারি মালিকরা। এতে বড় লোকসানের মুখে আড়তদাররা।
×