ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

ট্যানারিতে চামড়া বিক্রি করার ঘোষণা আড়তমালিকদের

প্রকাশিত: ০৭:৫০, ১৮ আগস্ট ২০১৯

ট্যানারিতে চামড়া বিক্রি করার ঘোষণা আড়তমালিকদের

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ বকেয়া আদায়ের কঠোর সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসে ট্যানারি মালিকদের কাছে চামড়া বিক্রি করার ঘোষণা দিয়েছে আড়তমালিকরা। এছাড়া বকেয়া আদায়ে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। আগামী ২২ আগষ্ট দুপক্ষের মধ্যে আলোচনা করে এর একটি ফায়সালা করে দিবে এফবিসিসিআই। চামড়ার দাম কমে যাওয়ায় বিচার বিভাগীয় তদন্ত চেয়ে হাইকোর্টে রিট করা হয়েছে। রবিবার বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে সরকার, ট্যানারি মালিক, আড়তদার ও কাঁচা চামড়া সংশ্লিষ্টদের ত্রিপক্ষীয় বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ওই বৈঠক শেষে ট্যানারি মালিকদের কাছে চামড়া বেচার ঘোষণা দেয়া হয়। এছাড়া বকেয়া আদায়সহ বেশকিছু গুরুত্ব সিদ্ধান্ত এসেছে ত্রিপক্ষীয় বৈঠকে। বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, শিল্পমন্ত্রী নুরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন, বাংলাদেশ হাইড এ্যান্ড স্কিন মার্চেন্ট এ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি হাজী মো. দেলোয়ার হোসেন, বাংলাদেশ ট্যানার্স এ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএ) সাধারণ সম্পাদক মো. সাখাওয়াত উল্লাহ, বাণিজ্য সচিব মো. মফিজুল ইসলাম, শিল্পসচিব, এফবিসিসিআইয়ের সহসভাপতি মো. সিদ্দিকুর রহমানসহ মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট উর্ধতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। উল্লেখ, শনিবার থেকে আড়তদাররা নির্ধারিত দামে ট্যানারিতে চামড়া বিক্রি করার ঘোষণা দিলেও হঠাৎ বকেয়া আদায়ে বেঁকে বসেন তারা। ফলে শনিবার আড়তগুলো থেকে চামড়া কেনাবেচা শুরু না হওয়ায় নতুন জটিলতার সৃষ্টি হয়। এই পরিস্থিতি রবিবারের বৈঠকে বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত আসে। চামড়া শিল্পের উদ্যোক্তাদের কাছ থেকে বকেয়া আদায়ে তাদের কাছে কাঁচা চামড়া বিক্রি বন্ধ রাখার ঘোষণা দেয়ার একদিন পর সে অবস্থান থেকে সরে আসেন আড়তদাররা। বৈঠক শেষে বাংলাদেশ হাইড অ্যান্ড স্কিন মার্চেন্ট এ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মো. দেলোয়ার হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত রবিবার থেকেই চামড়া বিক্রি শুরু করা হবে। বকেয়া আদায়ের বিষয়ে তিনি বলেন, “মাননীয় মন্ত্রী ও উপদেষ্টা মহোদয় এফবিসিসিআইকে দায়িত্ব দিয়েছেন। আগামী ২২ অগাস্ট এফবিসিসিআইয়ের উদ্যেগে এ নিয়ে আলোচনা হবে দুই পক্ষের মধ্যে। সেখান থেকেই ফয়সালা করে দেবে।” প্রসঙ্গত, ন্যায্যদাম না পেয়ে কোরবানির ঈদের দিন বিক্রি করতে না পেরে মৌসুমী ব্যবসায়ীরা লাখ লাখ পিসের বেশি কাঁচা চামড়া ফেলে দেন। ওই দিনই কাঁচা চামড়ার উপযুক্ত মূল্য নিশ্চিত করতে রফতানির সুযোগ দেয়ার কথা জানায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এরপর সরকারের অনুরোধে ট্যানারি মালিকরাও শনিবার থেকে কাঁচা চামড়া কেনার কথা বলেন। কিন্তু শনিবার আড়তদাররা ট্যানারি মালিকদের কাছে বকেয়া ‘শত শত কোটি টাকা’র সুরাহা না হওয়া পর্যন্ত কাঁচা চামড়া বিক্রি বন্ধ রাখার ঘোষণা দেয়ায় সঙ্কট নতুন মাত্রা পায়। এমন প্রেক্ষাপটে রবিবার চামড়া সঙ্কটের সমাধানে বৈঠকে ট্যানারি মালিক ও আড়তদারসহ ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দকে নিয়ে বৈঠকের উদ্যোগ নেয় সরকার। বৈঠকের শুরুতে বাণিজ্য সচিব মো. মফিজুল ইসলাম বলেন, ২০ তারিখ থেকে চামড়া কেনার কথা বলেছিলো ট্যানার্স এ্যাসোসিয়েশেন। ফরিয়া ও আড়তদারদের মধ্যে একটি গ্যাপ রয়েছে বলে ধারণা ছিল। মাঠ পর্যায়ে বলা হল চামড়া সংরক্ষণের জন্য। এ পরিস্থিতিতে ট্যানার্স এ্যাসোসিয়েশন ক্রয়ের কথা বলে, তারা কিছু কিছু ক্রয় করেছে তবে তারা সেরকম ভাবে কিনেননি। ইতোমধ্যে চামড়া রফতানির ঘোষণা দিয়েছি। এ পরিস্থিতিতে কি করা যায় পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে। ওই সময় শিল্পমন্ত্রী বলেন এ বিষয়ে দায়দায়িত্ব এড়াতে পারি না। চামড়া শিল্প অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, চামড়া শিল্প নীতি হচ্ছে। বর্তমানে যে বিশেষ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে তা নিয়ে বৈঠক করা হবে। একটি স্থায়ী সমাধানে নিতে চাই। তিনি বলেন, চামড়া শিল্প নিয়ে সুদুরপ্রসারী পরিকল্পনাও চলছে। আলোচনা শেষে সিদ্ধান্ত জানানো হবে। ওই বৈঠকে সালমান এফ রহমান বলেন, আমরা আশাবাদী, খোলামেলা আলাপের মাধ্যমে সমস্যা সমাধান পাব। আমি মনে করি যে কথাটা শিল্পমন্ত্রী বলেছেন, চামড়া শিল্প গার্মেন্টেসর পর গুরুত্বপূর্ণ খাত। ভবিষ্যতে চামড়া শিল্পটা মেইন সেক্টর হিসেবে ডেভলপ করার চেষ্টা করা হবে। বর্তমানে যে সমস্যা তা কীভাবে সমাধান করা যায় এবং ভবিষ্যতে কী করা যায় বা আবার সম্মুখীন না হই তার সাজেশন নেয়া হবে। সমস্যা সমাধানে চেষ্টা করা হচ্ছে। দশ হাজার পিস চামড়া নষ্ট হয়েছে দাবি শিল্পমন্ত্রীর ॥ এক কোটি চমড়ার মধ্যে এ বছর ১০ হাজার পিস চামড়া নষ্ট হয়েছে বলে জানিয়েছেন শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন। তিনি বলেন যা নগণ্য ব্যাপার’। গরমের কারণে ১০ হাজার পিস চামড়া নষ্ট হয়েছে বলেও মন্তব্য এই মন্ত্রীর। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে সরকার, ট্যানারি মালিক, আড়তদার ও কাঁচা চামড়া সংশ্লিষ্টদের ত্রিপক্ষীয় বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের এ কথা বললেন মন্ত্রী। শিল্পমন্ত্রী বলেন, একটি দেশ যখন সম্ভাবনার দিকে আগায়, তা ব্যাহত করতে একটা চক্র কাজ করে। বিভিন্ন জেলা থেকে আগত প্রতিনিধিরা জানিয়েছেন, এক কোটি চামড়ার মধ্যে প্রতি বছর শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ চামড়া নষ্ট হয়। এবার যেহেতু গরম পড়েছে, সেজন্যই ১০ হাজার পিস চামড়া নষ্ট হতে পারে। চামড়ার দাম কমে যাওয়ায় হাইকোর্টে রিট ॥ ঈদুল আজহায় পশুর চামড়ার দর কমে যাওয়ার ঘটনায় বিচার বিভাগীয় তদন্ত চেয়ে হাইকোর্টে রিট করা হয়েছে। একইসঙ্গে চামড়ার দর কমার জন্য বিবাদীদের নিষ্ক্রিয়তা কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না- তার কারণ জানাতে রুল জারির আর্জি রয়েছে রিটে। কিন্ত রবিবার রিট আবেদন শুনানির জন্য নিয়ে গেলে দুটি বেঞ্চই রিট আবেদন শুনতে অপারগতা প্রকাশ করে। রবিবার হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় জনস্বার্থে রিট আবেদনটি করেন সুপ্রীমকোর্টের আইনজীবী ব্যারিষ্টার মহিউদ্দিন মো: হানিফ (ফরহাদ)।ওই রিট নিয়ে হাইকোর্টের পৃথক দুটি বেঞ্চে শুনানির জন্য গেলে তাতে সাড়া দেননি হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট বেঞ্চ। পরে রিটকারী আইনজীবী মহিউদ্দিন হানিফ (ফরহাদ) সাংবাদিকদের বলেন , আজকে(রবিবার) দুটি বেঞ্চে রিট আবেদনটি উপস্থাপন করা হলে আদালত শুনানি নিতে অপারগতা প্রকাশ করেন। সোমবার অন্য একটি বেঞ্চে উপস্থাপন করা হবে। তিনি আরো জানান , সিন্ডিকেট ও একশ্রেনীর অসাধু ব্যবসায়ীর কারণে চামড়ার অস্বাভাবিক দরপতন হয়েছে বলে গণমাধ্যমে খবর এসেছে। চামড়াজাত পণ্য দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রফতানি খাত, যার প্রধান কাঁচামাল হচ্ছে কাঁচা চামড়া। এ অবস্থায় এ শিল্প হুমকির মুখে পড়েছে। এ ঘটনায় জড়িত ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে শাস্তিমুলক ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশনা চাওয়া হয়েছে রিটে।রিট আবেদনে চামড়ার অপ্রত্যাশিত দরপতন রোধে বিবাদীদের নিষ্ক্রিয়তা ও ব্যর্থতা কেন অবৈধ হবে না, দরপতনের কারণ খুঁজতে একটি জুডিশিয়াল (বিচারিক) তদন্ত করতে কেন নির্দেশ দেয়া হবে না, দরপতনের সঙ্গে দায়ীদের ব্যবসায়িক নিবন্ধন কেন বাতিল করা হবে না মর্মে রুল জারির আর্জি জানানো হয়। সরকারের নজরদারি নেই, ব্যবসায়ীদের কারসাজি’ শিরোনামে খবর প্রকাশ করা হয় একটি পত্রিকায়। অপর একটি পত্রিকায় ‘গরিবের হকে সিন্ডিকেটের থাবা’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রভাবশালী সংঘবদ্ধ চক্রের কারণে এবার ‘গরিবের হক’ কোরবানির পশুর চামড়ার বাজারে বড় ধস নেমেছে। বাড়তি মুনাফার লোভে ট্যানারির মালিকদের বেশির ভাগই সিন্ডিকেট করে কোরবানির পশুর চামড়া কিনছে না। অল্প যা বিক্রি হয়েছে, তা সরকারের বেঁধে দেওয়া দামের চেয়ে অনেক কমে, নামমাত্র মূল্যে। এতে চামড়া সংগ্রহকারীরা বিপাকে পড়েছে। চামড়া পচে যাচ্ছে। দুর্গন্ধে নিরুপায় হয়ে অনেকে সংগৃহীত চামড়া রাস্তায় বা নদীতে ফেলে দিচ্ছে। মাটির নিচেও পুঁতে ফেলছে অনেকে। ঈদের পরের দিন মঙ্গলবার থেকে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোডের ফতুল্লার জালকুড়ির ক্রিকেট স্টেডিয়ামের পাশের রাস্তায় কয়েক হাজার কোরবানি পশুর চামড়া পড়ে থাকতে দেখা যায়। সিলেট সিটি করপোরেশনের বিভিন্ন এলাকায় ফেলে রাখা অন্তত ২০ ট্রাক চামড়া ডাম্পিং স্পটে পুঁতে ফেলা হয়েছে। এছাড়া সিলেটের বিভিন্ন উপজেলায় আরও অন্তত ২৫০টি পশুর চামড়া নদীতে ফেলে দেওয়ার খবর পাওয়া গেছে। সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুর উপজেলার সৈয়দপুর হাফিজিয়া হোসেনিয়া দারুল হাদিস কর্তৃপক্ষ পুঁতে ফেলেছে নষ্ট হয়ে যাওয়া ৯০০ চামড়া। কোথাও মাত্র ৫০ টাকায় গরুর চামড়া বিক্রির ঘটনাও ঘটেছে। আবার, ন্যায্যদামে চামড়া কিনে আড়তদারের কাছ থেকে প্রত্যাশিত দাম না পাওয়ায় বিপাকে পড়েছেন ময়মনসিংহ, নেত্রকোণা, সুনামগঞ্জ, সিলেট, নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রামসহ বেশ কয়েকটি জেলার মৌসুমী ব্যসায়ীরা। ঢাকা ও ঢাকার বাইরের বিভিন্ন এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কোরবানির পশুর যে চামড়া দুই-আড়াই হাজার টাকায় বিক্রি হতো, এবার তা বিক্রি করতে হয়েছে ৫০ থেকে ৩০০ টাকায়। ক্রেতার ঘাটতি থাকায় দাম নির্ধারণ ছাড়াই ট্যানারি মালিক ও ব্যবসায়ীদের কাছে চামড়া দিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছে রাজধানীর মসজিদ ও মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ। কোরবানির চামড়ার এ দশা নিয়ে নগরবাসী, জনপ্রতিনিধি, মৌসুমী ব্যবসায়ী ও মসজিদ-মাদ্রাসার নেতাদের মধ্যে বিরাজ করছে ক্ষোভ। চামড়ার ন্যায্যমূল্য না পাওয়ায় এতিম ও দরিদ্র শিক্ষার্থীদের পড়ালেখায় নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা করছেন অনেকে। নামমাত্র দরে চামড়া বিক্রির চেয়ে তা ফেলে দেওয়া অধিকতর যুক্তিযুক্ত বলে মনে করছেন তারা। রাজধানীর দুই সিটি করপোরেশনের তথ্য অনুযায়ী, উত্তর সিটি করপোরেশন এলাকায় আড়াই লাখের মতো পশু কোরবানি হয়েছে গত সোমবার (১২ আগস্ট)। এছাড়া, মঙ্গল ও বুধবার আরও ৩০ হাজারের মতো পশু কোরবানি হয়েছে। একই সঙ্গে, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকায় দুই লাখের মতো পশু কোরবানি হয়েছে ঈদের দিন। এরপরের দুই দিনে আরও ৫০ হাজারের মতো পশু কোরবানি দেওয়া হয়েছে। তিন বছর আগেও পাঁচ লাখ পশুর চামড়া গড়ে দুই হাজার টাকা দরে বিক্রি করে ১০০ কোটি টাকার বেশি অর্থ পাওয়া যেতো। এ অর্থ মসজিদ, মাদ্রাসা, এতিম ও গরিবদের দান করা হতো। কিন্তু, মৌসুমী ব্যবসায়ীরা এবার রাজধানীতে চামড়াপ্রতি গড়ে ২০০ থেকে ৩০০ টাকার বেশি দিতে রাজি হয়নি। ছাগলের চামড়া ১০ টাকার বেশিতে নিতে চাননি। রাজধানীর কোনো কোনো এলাকায় মৌসুমী ক্রেতাদের না পাওয়ায় দামদর ঠিক না করেই চামড়া আড়তদারদের দিয়ে দেওয়া হয়েছে। ফলে, চামড়া বিক্রি বাবদ কত টাকা আসবে, সে ব্যাপারে কিছুই জানেন না বিক্রেতারা।
×