ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

শাহরিয়ার কবির

কাশ্মীর কোন্ পথে

প্রকাশিত: ০৮:২৭, ১৯ আগস্ট ২০১৯

 কাশ্মীর কোন্ পথে

॥ সাত ॥ ভারতের পার্লামেন্টে ৩৭০ ধারা বাতিলের পর বিরোধী মহল থেকে অনেক সমালোচনা হয়েছে। কারফিউ তুলে নিলেও শ্রীনগরের অবস্থা কতদিনে স্বাভাবিক হবে জানি না। গণমাধ্যমে শ্রীনগরে বিক্ষোভের পাশাপাশি জম্মু ও লাদাখে ৩৭০ ধারা বাতিলের জন্য উল্লসিত মানুষদের মিষ্টি বিতরণ করতেও দেখেছি। মেহবুবা মুফতি ও হুরিয়াত কনফারেন্সের নেতারা এবং পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানও কাশ্মীরে মুসলিম নিধন ও গণহত্যার আশঙ্কা করছেন। যে পাকিস্তান ’৭১-এ বাংলাদেশে স্মরণকালের নৃশংস গণহত্যা করেছে, যা এখনও করছে বেলুচিস্তানে- সে পাকিস্তান কাশ্মীরে গণহত্যার আশঙ্কা করছে- এটি কোণঠাসা হওয়া জামায়াতি জিহাদীদের উদ্দীপ্ত করতে পারে। বাস্তবে এমনটি ঘটা সম্ভব নয়। ভারতের বিরোধী রাজনৈতিক দল, সামাজিক সংগঠন এবং মানবাধিকার কর্মীরা, সর্বোপরি ভারতের গণমাধ্যম মানবাধিকারের প্রশ্নে দক্ষিণ এশিয়ার যে কোন দেশের তুলনায় বেশি সংবেদনশীল। গণহত্যার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক জনমতও অতীতের যে কোনও সময়ের তুলনায় সোচ্চার। পাকিস্তান জঙ্গী উৎপাদন, জঙ্গী বিপণন এবং জঙ্গী রফতানির নীতি থেকে সরে না এলে এই উপমহাদেশ কখনও সন্ত্রাসমুক্ত হতে পারবে না। কাশ্মীরের ক্ষেত্রে এটি আরও অধিক প্রযোজ্য। মেহবুবা মুফতিরা কাশ্মীরের মুসলমানদের জন্য মায়াকান্না করছেন। যে জঙ্গী মৌলবাদী সন্ত্রাস কাশ্মীরের লাখ লাখ মুসলমানের জীবন-জীবিকা ধ্বংস করেছে সেই জঙ্গীবাদ দমনের জন্য তারা ক্ষমতায় থেকেও কিছু করেননি। কাশ্মীরের শ্রীনগরে যারা গত তিরিশ বছরে গিয়েছেন এবং ডাল লেকের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ছাড়াও শহরের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখেছেন, তারা নিশ্চয়ই লক্ষ্য করেছেন, বহু বাড়ি পরিত্যক্ত পড়ে আছে। বেশির ভাগই কাঠের দোতালা তিন তলা, বছরের পর বছর রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে জীর্ণ, বিধ্বস্ত। এসব বাড়ি কাশ্মীরের হিন্দুদের। যে কাশ্মীর শত শত বছর ধরে হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতির এক উজ্জ্বল উদাহরণ ছিল, সেখানে এখন কোন হিন্দু নেই। রাতারাতি সবাইকে শ্রীনগর ছাড়তে বাধ্য করেছে জঙ্গী মৌলবাদী সন্ত্রাসীরা। কাশ্মীরের সাধারণ মুসলমান আশির দশকের আগে ইসলামের নামে এ ধরনের জঙ্গী সন্ত্রাস কখনও দেখেনি। কাশ্মীরের রাস্তায় পাকিস্তান থেকে আসা মওদুদিবাদী জঙ্গীরা স্লোগান দিয়েছে- ‘ইয়াহাঁকে জায়গা, নিজামে মুস্তফা’, ‘পাকিস্তান সে রিশতা কেয়া, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ ইত্যাদি, ঠিক যেমনটি দেয়া হতো ’৭১-এ মুক্তিযুদ্ধকালে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী কবলিত বাংলাদেশে। গত বছর ‘আইএসআইএস’-এর কালো পতাকা উড়িয়ে শ্রীনগরে জঙ্গীরা মিছিল করেছে। পাকিস্তানকে ইসলামের সমার্থক বানিয়ে স্বাধীনতার নামে কাশ্মীরকে পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত করার জন্য ১৯৮৯ সাল থেকে তথাকথিত মুজাহিদীনরা বহুমাত্রিক রণনীতি গ্রহণ করেছিল, যার প্রথমটি ছিল কাশ্মীরের বহুত্ববাদী সমাজ ও সংস্কৃতি ধ্বংস করা। কাশ্মীরকে একটি মনোলিথিক, শরিয়াভিত্তিক মুসলিম রাজ্য বানাবার জন্য আফগান ফেরত তালেবানরা বিভিন্ন নামে কাশ্মীরে অনুপ্রবেশ করেছে, সমাজ ও সংস্কৃতির মৌলবাদীকরণ ও পাকিস্তানীকরণ করেছে। কাশ্মীর থেকে হিন্দু বিতাড়ন ছিল তাদের রণকৌশলের প্রথম ধাপ। ১৯৮৯-৯০ সালে বিচ্ছিন্নতাবাদী হুরিয়াত কনফারেন্সের সঙ্গে যুক্ত কয়েকটি সংগঠনের সহযোগিতায় পাকিস্তান থেকে আসা তথাকথিত মুজাহিদীনরা যে সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস সৃষ্টি করেছিল তার শিকার কাশ্মীরের সাড়ে তিন লাখ নিরীহ শান্তিপ্রিয় মানুষ প্রাণভয়ে পালিয়ে এসেছিলেন জম্মুতে। জম্মুতে হাজার হাজার শরণার্থী শিবির বানানো হয়েছিল রাতের অন্ধকারে এক বস্ত্রে প্রায় কপর্দহীন অবস্থায় চলে আসা এসব বিপণœ মানুষদের আশ্রয় দেয়ার জন্য, ঠিক যেমনটি ঘটেছিল ’৭১-এ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর গণহত্যাযজ্ঞের সূচনাপর্বে বাঙালিদের ক্ষেত্রে। প্রথমবার জম্মু এসে হোটেলে ব্যাগ রেখে সোজা চলে গিয়েছিলাম শরণার্থীদের মুট্ঠি ক্যাম্পে। অনেক শরণার্থী শিবির আছে জম্মু শহরের বারো থেকে পঁচিশ কিলোমিটারের ভেতর। সকালটা কাটিয়েছি মুট্ঠি ক্যাম্পের ফেজ ওয়ান ও ফেজ টুতে ক্যাম্পের বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে। দুপুরের পর গিয়েছি আরও দূরের পুরখু ক্যাম্প ও মিশ্রিওয়ালা ক্যাম্পে। প্রতি ফেজ-এ পাঁচশ থেকে এক হাজার মানুষের বাস। তখন দেখেছি ক্যাম্প মানে বারো ফুট বাই বারো অথবা চৌদ্দ ফুট একটা ঘর, যেখানে পাঁচ থেকে দশ সদস্যের গোটা পরিবার থাকে। রান্নার ব্যবস্থাও সেখানে। তবে কেউ কেউ নিজেদের উদ্যোগে ঘরের পাশে রান্নার জন্য এক চিলতে ছাপড়া তুলে নিয়েছেন। একটা ঘরের সঙ্গে আরেকটা ঘর, আরেকটা পরিবার। শৌচাগার ও পানীয় জলের ব্যবস্থা অত্যন্ত অপ্রতুল। তখন তাদের আয়ের উৎস ছিল পরিবার প্রতি পঁচিশ শ’ টাকা মাসিক সরকারী ভাতা। বাড়তি আয়ের জন্য কেউ ছোট মুদি দোকান খুলেছেন, কেউ কম বেতনে গৃহশিক্ষকতার কাজ জুটিয়ে নিয়েছেন। মুট্ঠি ক্যাম্পের ফেজ টুতে কথা হচ্ছিল কুকুজী পণ্ডিতের সঙ্গে। বয়স বললেন তিরিশ, দেখে মনে হয় চল্লিশের ওপরে। চেহারায় অনাহার আর অনিয়মের ছাপ। চোখে পুরু লেন্সের চশমা, ইতিহাসে এম এ পাশ করে আট বছর ধরে চাকরির চেষ্টা করছেন। বললেন, আশির ওপর দরখাস্ত করেছি প্রথম শ্রেণী থেকে শুরু করে চতুর্থ শ্রেণীর চাকরির জন্য, যা আজ পর্যন্ত পাইনি। কুকুজী বললেন, শ্রীনগরে আমাদের বাড়ি ছিল, কারবার ছিল, নিরাপদ আনন্দ ও শান্তিপূর্ণ জীবন ছিল। কী চমৎকার আবহাওয়া! গরম কালেও তাপমাত্রা কদাচিৎ তিরিশ বত্রিশের ওপর ওঠে। অথচ এখানে থাকতে হচ্ছে এই নরকে। তাপমাত্রা বাইরে চল্লিশ হলে ঘরের ভেতরে পঞ্চাশ ডিগ্রীর কম হবে না। কী ঘটেছিল তখন? কেন সাড়ে তিন লাখ শান্তিপ্রিয় নিরীহ মানুষকে এভাবে উদ্বাস্তু হতে হয়েছিল? এসব জানবার জন্য কথা বলেছি মুট্ঠি ক্যাম্পের সভাপতি পণ্ডিত কেশবনাথ রানা, পণ্ডিত প্রেমশঙ্কর, কুকুজী পণ্ডিত, বৃন্দা ও সরোজিনী; পুরখু ক্যাম্পের সভাপতি ভূষণলাল ভাট, চুনিলাল রায়না এবং কিষেণলালের সঙ্গে এবং মিশ্রিওয়ালা ক্যাম্পে হরিভূষণ, অমরনাথ, গোপাল, লক্ষণ সিনহাসহ বিভিন্ন বয়সের নারী-পুরুষের সঙ্গে। পুরখু ক্যাম্পে একজন মুসলমান শরণার্থীর দেখাও পেয়েছিলাম, যার নাম বশীর আহমেদ মীর। এদের সবার অভিজ্ঞতা প্রায় একই রকম। জঙ্গীরা ’৮৯ থেকে গ্রামে গ্রামে প্রচার করছিল কাশ্মীরে তারা কোনও হিন্দু রাখবে না। তিন বছরের ওপর সকল হিন্দু পুরুষকে হত্যা করা হবে, হিন্দু নারীদের রেখে দেয়া হবে তাদের গর্ভে সন্তান উৎপাদনের জন্য। এরপর শুরু হয় হত্যাকাণ্ড। শ্রীনগরের বিশিষ্ট হিন্দু- যারা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, বিচারক, প্রকৌশলী, লেখক ও আইনজীবী- তালিকা প্রস্তুত করে এক এক করে হত্যা শুরু হয়। আতঙ্কিত এবং নির্বিরোধী হিন্দু পণ্ডিতরা এরপর উপত্যকা ছাড়তে শুরু করেন। শুধু হিন্দু নয়, চাঁদা বা আশ্রয় দিতে অস্বীকার করায় কিংবা জঙ্গীদের সমালোচনা করায় বহু মুসলমানকেও কাশ্মীর ছাড়তে হয়েছে। যে সাড়ে তিন লাখ শরণার্থী তখন জম্মুতে এসেছিলেন তাদের ভেতর পঞ্চাশ হাজারই মুসলমান। পুরখু ক্যাম্পের সভাপতি ভূষণলাল ভাটের ঘরে ঢুকে বিস্মিত হয়েছি। দেয়ালে হিন্দুদের দেব-দেবীর ছবির পাশে যীশু খৃষ্ট, ভগবান বুদ্ধ আর কাবা শরীফের ছবি। এ নিয়ে প্রশ্ন করলে ভূষণলাল বললেন, ‘হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান- সব ধর্মেরই সার কথা হচ্ছে মানুষের সেবা করা। সবার ওপরে মানুষ সত্য। শ্রীনগরে যখন আমি শিক্ষকতা করতাম তখন এই শিক্ষাই দিতাম আমার ছাত্রদের। কাশ্মীরী এই হিন্দু পণ্ডিতের কথা শুনে চমৎকৃত হয়েছিলাম। জঙ্গীদের সন্ত্রাসী তৎপরতার জন্য তিনি ইসলাম ধর্মকে দায়ী করেননি, যদিও ক্যাম্পের অনেকে বলেছেন, ‘মুসলমানরা সব সময় আমাদের ওপর জুলুম করেছে।’ মুজাহিদীনদের প্রতি সহানুভূতিশীল যাদের সঙ্গে শ্রীনগরে কথা হয়েছে তারা ফিরিস্তি দিয়েছেন ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনী জঙ্গী সন্দেহে কিভাবে নিরীহ মুসলমানদের হত্যা করেছে, নারী নির্যাতন করেছে, সাধারণ মানুষকে হয়রানি করেছে কিংবা মানসিক অত্যাচার করেছে। কিন্তু এ প্রশ্নের জবাব তারা কেউ দিতে পারেননি- এর জন্য কাশ্মীরের নির্বিরোধী শান্তিপ্রিয় হিন্দু পণ্ডিতদের কেন নিগ্রহ, নির্যাতন ও হত্যার শিকার হতে হবে। মুট্ঠি ক্যাম্পের মধ্যবয়সী বৃন্দা চিৎকার করে বলেছেন, ‘আমরা ওদের কোন ক্ষতিটা করেছিলাম আপনি বলুন। শত শত বছর ধরে আমরা আমাদের জমিতে ছিলাম, পূর্বপুরুষদের ভিটায় ছিলাম। আজ কেন এই নরকে আমাদের থাকতে হচ্ছে? আমাদের শিক্ষিত যুবক ছেলেদের কোনও কাজ নেই। আমাদের সামনে কোনও ভবিষ্যত নেই। কেন এই দুর্ভোগ বছরের পর বছর আমাদের পোহাতে হবে?’ বৃন্দা আমার কাছে জবাব চেয়েছিলেন। এর কোনও জবাব আমার কাছে ছিল না। পুরখু ক্যাম্পের পণ্ডিত কিষেণলাল বলেছেন, শিক্ষাগত যোগ্যতা যতই থাক না কেন শরণার্থী যুবকদের জন্য জম্মুতে কোনও কাজ নেই। বছরের পর বছর বেকার এই যুবকরা চরম হতাশা থেকে মাদকাসক্ত হচ্ছে, কেউ কেউ সমাজবিরোধী কাজে যোগ দিয়েছে। আমাদের গোটা একটা প্রজন্ম ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। ক্যাম্পের অনেকে আলোচনার কথায় বিরক্ত হয়েছেন- ‘অনেক ইন্টারভিউ দিয়েছি। কাগজে অনেক ছাপা হয়েছে। মিলিট্যান্টদের দৌরাত্ম্যও কমেনি, আমাদের দুর্ভোগও কমেনি।’ আবার বাংলাদেশের সাংবাদিক শুনে অনেকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে এগিয়ে এসেছেন। তারা ’৭১-এর বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের কথা শুনেছেন। তারা জানেন বাঙালী কিভাবে পরাজিত করেছে বিশাল পাকিস্তানী ফৌজ আর তাদের মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক দোসরদের। কাশ্মীরের মুসলমানদের কেউ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সমর্থন করেননি। যাদের ঘাড়ে জিন্নাহর সাম্প্রদায়িক দ্বিজাতিতত্ত্বের ভূত সওয়ার ছিল তারা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে পাকিস্তান ভাঙার ভারতীয় চক্রান্ত হিসেবে দেখেছেন। ভূষণলালের সঙ্গে যখন কথা বলছিলাম তখন শরণার্থী শিবিরের নানা বয়সীরা আমাদের ঘিরে বসেছিল। ভূষণলাল আমার পরিচয় দিয়ে বলেছিলেন, ‘বাঙালি বহুত বাহাদুর আওয়াম হ্যায়।’ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলো কাশ্মীরে ভারতীয় সেনাবাহিনীর মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় যত সোচ্চার- কাশ্মীরের তিন লাখ পণ্ডিতের জীবনের ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয় সম্পর্কে কখনও সোচ্চার হয়নি। সংবিধানের ৩৭০ ধারা বাতিলের পর কাশ্মীরের হিন্দুরা আবার নিজ বাসভূমে ফিরে যেতে পারবেন কি-না, কাশ্মীরের সরকার ও জনগণ সে পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারবে কি-না এ নিয়ে এখনও সংশয় আছে।
×