ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

চামড়া নিয়ে আড়তদার-ট্যানারি মালিক মুখোমুখি

প্রকাশিত: ০৮:৫৩, ১৯ আগস্ট ২০১৯

চামড়া নিয়ে আড়তদার-ট্যানারি মালিক মুখোমুখি

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ কম দামে চামড়া কেনার কৌশল শেষ পর্যন্ত দ্বন্দ্বে রূপান্তরিত হয়েছে ‘সিন্ডিকেট’ হিসেবে পরিচিতি পাওয়া দুই ব্যবসায়ী গ্রুপের মধ্যে। আড়তদারদের জরুরী সভার সিদ্ধান্ত অনুসারে ইতোমধ্যে ট্যানারিতে চামড়া বিক্রি না করার ঘোষণা দিয়েছেন তারা। অবশ্য বাজার সামলাতে সরকারের অনুরোধে ট্যানারি মালিকরা শনিবার থেকে কাঁচা চামড়া কেনার প্রস্তুতি নিলেও আড়তদাররা বিক্রি বন্ধ রাখার ঘোষণা দেয়ায় সঙ্কট নতুন মাত্রা পেয়েছে। ট্যানারি মালিকরা শনিবার যে সামান্য পরিমাণ চামড়া কিনেছেন তা সরাসরি মৌসুমি চামড়া ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে। বাজারে ধস ঠেকাতে ঈদের পরদিনই চামড়া রফতানির কথা বলেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশী। আড়তদাররা জানান, এ নিয়ে ক্রেতার কাছ থেকে সাড়া পাচ্ছেন তারা। কাঁচাচামড়া আড়তদারদের সংগঠন বাংলাদেশ হাইড ্্যােন্ড স্কিন মার্চেন্ট এ্যাসোসিয়েশনের (বিএইচএসএমএ) সভাপতি দেলোয়ার হোসেন শনিবার রাজধানীর লালবাগের পোস্তায় সাংবাদিকদের বলেন, ট্যানারি মালিকদের কাছে আড়তদারদের প্রায় ৪০০ কোটি টাকা পাওনা রয়েছে। এই পরিমাণ টাকা পরিশোধ না করা পর্যন্ত ট্যানারি মালিকদের কাছে আমরা চামড়া বিক্রি করব না। তিনি আরও বলেন, বিগত ২০১২ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত ট্যানারি মালিকদের কাছে যে পাওনা টাকা রয়েছে, তা হাতে না পাওয়া পর্যন্ত নতুন ব্যবসার সিদ্ধান্ত নেব না। আজকের মিটিংয়ে সবাইকে বারণ করা হয়েছে কাঁচা চামড়া বিক্রি করতে। এ প্রতিক্রিয়ায় ট্যানারি মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ ট্যানার্স এ্যাসোসিয়েশনের নেতারা জানান, সরকারের অনুরোধে পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী তারা শনিবার থেকে কাঁচা চামড়া কিনতে তৈরি হলেও আড়তদাররা বিক্রি না করলে তাদের কিছু করার নেই। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ট্যানার্স এ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক সাখাওয়াত উল্লাহ বলেন, মৌসুমি ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে তারা (আড়তদার) যে সব চামড়া কিনে রেখেছেন, সেগুলো এখন তাদের জিনিস। তারা ইচ্ছে করলে আমাদের কাছেও বিক্রি করতে পারেন। আবার অন্য কারও কাছেও তারা বিক্রি করতে পারেন। যার কাছে তারা দাম ভাল পাবেন, তারা তার কাছেই বিক্রি করবেন। এতে কারও কোন সমস্যা হওয়ার কথা নয়। আড়তদারদের সঙ্গে দ্বন্দ্ব প্রসঙ্গে তিনি বলেন, তাদের সঙ্গে আমাদের দ্বন্দ্ব হওয়ার কিছু নেই। তিন-চার বছর আগেও আমরা আড়তদারদের সব টাকা পরিশোধ করে দিতাম। এছাড়া সারা বছর লেনদেন হতো তাদের সঙ্গে। কিন্তু দুই বছর ধরে আমরা তাদের ঠিকমতো টাকা দিতে পারছি না। টাকার সঙ্কটের কারণে এমনটি হয়েছে বলেও মন্তব্য তার। এদিকে চামড়া শিল্প নগরীতে এক অনুষ্ঠানের পর ট্যানারি মালিকদের সংগঠন ট্যানার্স এ্যাসোসিয়েশন সাধারণ সম্পাদক সাখাওয়াত উল্লাহর মন্তব্য, রফতানির লোভে দীর্ঘদিনের সম্পর্ক নষ্ট করছেন আড়তদাররা। তিনি আরও বলেন, পর্যায়ক্রমে বকেয়া পরিশোধ করা হবে। প্রসঙ্গত, চার স্তরে চামড়া কেনাবেচার চেনের সব ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তারকারী হিসেবে কাজ করে ট্যানারি মালিকরা। এরাই চামড়া খাতের বড় ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচিত। সরকারী সুযোগ, সুবিধা ও ব্যাংক ঋণ থেকে শুরু করে সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা পান মূলত তারাই। অথচ আড়তদাররা এসব কোন সুযোগ-সুবিধাই পান না। যদিও কোরবানির সময় নগদ টাকা দিয়ে মৌসুমি ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে চামড়া কিনতে হয় আড়তদারদের। জানা গেছে, কয়েক বছর ধরে এই দুই গ্রুপ অর্থাৎ আড়তদার ও ট্যানারি মালিকরা কৌশলের আশ্রয় নিয়ে বেশ সুবিধা পেয়েছেন। কৌশলের সুযোগ নিয়ে তারা উভয়েই চামড়া প্রতি ৪শ’ থেকে ৫শ’ টাকা করে লাভ করতেন। তবে বেশ কিছু ট্যানারির মালিক দুই বছর ধরে আড়তদারদের টাকা দেয়া বন্ধ করে দেয়ায় জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে। আড়তদারদের দাবি, তারা ট্যানারি মালিকদের কাছে প্রায় ৪০০ কোটি টাকা পাবেন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ট্যানারি মালিকরা গত কয়েক বছর ধরে আড়তদারদের টাকা দেয়া কমিয়ে দেয়ার পরও চামড়া ঠিকমতোই পাচ্ছিলেন। তারা কম দামে চাহিদার চেয়েও বেশি চামড়া সংগ্রহ করতেন। এর ফলে দুই বছর ধরে চামড়ার দামও কমতে থাকে। শুধু তাই নয়, ৩১ বছরের মধ্যে এবারই সবচেয়ে কম দামে বিক্রি হয়েছে পশুর চামড়া। খাত সংশ্লিষ্ট অনেকেই বলছেন, চামড়ার এই বেচা-কেনায় দাম কম বা বেশি যাই হোক না কেন, কখনই লোকসান গুনতে হয় না আড়তদার ও ট্যানারির মালিককে। কিন্তু প্রতিবছরই চামড়া কিনে ঝুঁকিতে পড়েন মৌসুমি ও পাইকারি চামড়া ব্যবসায়ীরা। জানা গেছে, ২০১৮ সালের কোরবানির সময়ও চামড়ার দাম আগের বছরের তুলনায় কমে বিক্রি হয়। ওই সময়ও বিষয়টি নিয়ে ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সরব ছিলেন কোরবানিদাতারা। তবে সরকার এ বিষয়ে কোন পদক্ষেপ না নেয়ায় ক্ষতি হয় শুধু কোরবানিদাতাদের। আর পশুর চামড়ার দাম এবার এতটাই কমেছে যে, কাঁচা চামড়ার দাম না পাওয়ায় কোরবানিদাতাদের অনেকেই ক্ষুব্ধ হয়ে চামড়া মাটিতে পুঁতে দিয়েছেন। মৌসুমি ব্যবসায়ীর অনেকে দাম না পেয়ে কাঁচা চামড়া রাস্তায়ও ফেলে দিয়েছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকসহ বিভিন্ন মাধ্যমে চামড়ার দাম কমে যাওয়ার বিষয়েও ‘চামড়া সিন্ডিকেট’কে দায়ী করে অনেকেই স্ট্যাটাস দিয়েছেন। সবাই যখন ট্যানারি মালিকদের ‘সিন্ডিকেট’ বলে অভিহিত করছেন, তখন কাঁচা চামড়ার দাম কমানোর নেপথ্যে আড়তদারদেরই দায়ী করে গত বুধবার সংবাদ সম্মেলন করে ট্যানারি মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ ট্যানার্স এ্যাসোসিয়েশন। তখন থেকেই আড়তদার ও ট্যানারি মালিকদের দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে চলে আসে।
×