ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

উৎসব আমেজে উত্তরের গৃহবধূরা, পিত্রালয়ে আনন্দ আয়োজন

প্রকাশিত: ১০:২৪, ২০ আগস্ট ২০১৯

উৎসব আমেজে উত্তরের গৃহবধূরা, পিত্রালয়ে আনন্দ আয়োজন

তাহমিন হক ববি ॥ উত্তরাঞ্চলের নীলফামারীসহ রংপুর বিভাগের নয় জেলায় শুরু হয়েছে ভাদর কাটানি উৎসব। কোরবানির ঈদের আনন্দ উৎসবের পর আবহমান বাংলার চিরায়ত উৎসবের মতো স্বামীর মঙ্গল কামনায় ১ ভাদ্র শুক্রবার হতে দলে দলে নববধূরা শ্বশুরবাড়ি থেকে নাইওর হিসেবে বাপের বাড়ি চলে এসেছে। তাই বাড়িতে বাড়িতে ভাদর কাটানি উৎসব চলছে। স্বামীর কল্যাণে কমপক্ষে ভাদ্র মাসের প্রথম ৩ থেকে ৭ দিন বাপের বাড়িতে অবস্থান করবেন নববধূ মেয়েরা। কেউ কেউ একমাস কাটিয়ে যাবে। এই এলাকার রীতি অনুযায়ী স্বামীর মুখ দর্শন করবেন না নববধূরা। তবে এর কোন প্রমাণিত ঘটনা না থাকলেও যুগ যুগ ধরে এই এলাকার মানুষ অন্ধ বিশ্বাসে এসব আচার-অনুষ্ঠান পালন করে আসছেন। তাই নববধূরা ভাদ্র মাস শুরুর দুই-একদিন আগেই স্বামীর মঙ্গলের জন্য বাবার বাড়ি চলে যান। এবার কোরবানির ঈদ শেষেই নববধূরা ভাদর কাটানি উৎসবে এখন পিত্রালয়ে আনন্দ উৎসবে মেতেছে। আবার কেউ কেউ আবার এক বছরের বিবাহিত নারীকেও এই প্রথায় রেখেছে। আবার বিয়ের ৩০ বছর কেটেছে এমনও গৃহবধূরা এই প্রথা চালু রেখে বাবার বাড়িতে তিনদিন অবস্থান শেষে স্বামীর বাড়ি ফিরে যায়। স্বামীগৃহ হতে পিতৃগৃহে নেয়াকে নাইওর নেয়া বলে। এরূপ স্থলে সেই কন্যাকে বলা হয় নাইওরী, আর যাত্রাকে বলা হয় নাইওর। আধুনিক যুগে ভাদর কাটানির পক্ষে নিরপেক্ষ তর্ক-যুক্তি নেই। তবুও ভাদর কাটানি উৎসব থেমে নেই। যারা মনে প্রাণে বাঙালীর রীতিনীতি ও প্রথা মেনে চলে মানার চেষ্টা করেন তাদের নিয়মের ভেতরেই রয়েছে ভাদর কাটানি প্রথা। ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে ভাদর কাটানির কোন ব্যাখ্যা না থাকলেও এই অঞ্চলের আদি প্রথা অনুযায়ী, ভাদ্র মাসের ১ তারিখ থেকে শুরু হয়ে যুগ যুগ ধরে পালিত হয়ে আছে এ উৎসব। জানা যায় বৃহত্তর রংপুরের আট জেলার ও ভারতের পশ্চিম ও দক্ষিণ দিনাজপুর মালদহ, মুর্শিদাবাদের কোন কোন অংশে এই প্রথা চালু আছে। এছাড়াও জলপাইগুড়ি, কুচবিহার, শিলিগুড়ি জেলা কোন কোন অংশে এই প্রথা বাঙালী সমাজে চালু রয়েছে। অনেকে বলেন একটি বালিকা বধূর স্বামীগৃহে অবস্থানকালে পিতৃগৃহে গমনের উন্মুখতা এটি । আদিকাল থেকে এ অঞ্চলে এ রীতি পালন করে আসছেন পূর্ব পুরুষেরা। সেই রীতি অনুযায়ী মেয়েরা সাধারণত এ সময় বাবার বাড়িতে থাকেন। প্রত্যেক নববধূ বাবার বাড়ি থেকে স্বামীর জন্য মঙ্গল কামনা করেন। এক নববধূ জানান, স্বামীর মঙ্গলের জন্য আমরা বাবার বাড়ি চলে এসেছি। এ সময় স্বামীর মুখ দর্শন করলে নাকি স্বামীর অকল্যাণ হয়। এ বিশ্বাস নিয়ে আমরা এ রীতি পালন করে আসছি। ভাদর কাটানির বিষয়ে নীলফামারী সরকারী মহিলা কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ এটিএম গোলাম মোস্তফা বলেন, ধর্মীয়ভাবে ভাদর কাটানি করতে হবে এমন রীতি বা বিধান নেই। এটা নিছক পূর্ব পুরুষদের প্রচলিত প্রথা। যার ধারাবাহিকতায় এ অঞ্চলে এ অনুষ্ঠানটি প্রতি বছর সকল ধর্মাবলম্বী অভিভাবক পালন করে থাকেন। ভাদর কাটানি নিয়ে নানা মানুষের নানান মত রয়েছে। এটিকে কেউ মনে করেন এলাকার ঐতিহ্য, আবার অনেকে বলছেন কুসংস্কার। তবে যে যাই বলুক না কেন এরই মধ্যে বাড়িতে বাড়িতে মেয়ে বরণের উৎসব হবেই। এবারের ভাদর কাটানি উৎসবটি ভিন্ন আমেজে এসেছে। নববধূরা পবিত্র কোরবানির ঈদ স্বামীর ঘরে পালন করে এবার বাপের বাড়িতে এসেছে নাইওরে ভাদর কাটানিতে। ভাদর কাটানি এক ধরনের লোকাচার হলেও এটি এখন এ এলাকায় হয়ে উঠেছে সামাজিক রেওয়াজ এবং উৎসব। পাশাপাশি পুরো ভাদ্র মাসই বিয়ের অনুষ্ঠান বন্ধ থাকবে। বিশেষত এলাকাগুলোর হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে এটি বেশি প্রচলিত। নীলফামারী সরকারী কলেজে অধ্যক্ষ দেবী প্রসাদ জানালেন ভাদর কাটানির এ প্রবণতা শহরাঞ্চলের তুলনায় গ্রামাঞ্চলে প্রচলন বেশি। অবশ্য সমাজে ভাদর কাটানির একটি ইতিবাচক দিকও আছে। বিয়ে দেয়ার পর মেয়ে বাবার বাড়িতে বেশি দিন থাকার একটা সুযোগ পায় না। যাতে তারা পরিবার ও আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে সময় কাটাতে পারে। এতে করে পরিবারগুলোতে উৎসবমুখর পরিবেশেরও সৃষ্টি হয়। নীলফামারীর ইটাখোলা ময়দানের পাড় গ্রামের ইউনুছ আলী বলেন আমার মেয়ে রুনার এক বছর আগে বিয়ে হলেও সে এখন নাইওর হয়ে আমার বাড়িতে এসেছে। একইভাবে ডিমলা উপজেলার টুনিরহাট গ্রামের লাবলু মিয়া বলে আমার মেয়ে ছয় মাস পর স্বামীর বাড়ি হতে ভাদর কাটানিতে এসেছে আমার বাড়িতে। জেলা সদরের দোগাছি গ্রাম থেকে রাজিরউদ্দীনের মেয়ে আয়শা আকতার, বাড়াইপাড়া গ্রাম থেকে ইনাম আহমেদের মেয়ে রহিমা বেগম, সর্দারপাড়া গ্রামের সাদেক ইসলামের স্ত্রী নাসিমা বেগম, রোস্তম আলীর স্ত্রী সাথী আকতার, খয়খাটপাড়ার মৃত খোরশেদ আলীর মেয়ে বিলকিস জলঢাকা উপজেলার উপজেলা পাড়ার সাদেক আনোয়ার প্রিন্সের স্ত্রী রুবিনা অসংখ্য নববধূ স্বামীর বাড়ি থেকে বাবার বাড়ি নাইওর এসেছেন। স্বামীর কর্মস্থল দিনাজপুরের বিরামপুর থেকে ভাদর কাটানিতে বাবার বাড়িতে এসেছে লুইচি। সে হাসতে হাসতে বলে এ কোন রীতি জানি না। তবে তার স্বামীর খাওয়া দাওয়ার কষ্ট হবে এই কয়েকদিন। এ জন্য তার খুব খারাপ লাগছে। ৭০ বছরে এক বৃদ্ধা আমেনা বেগম জানান, আমরা আমাদের বাবা-দাদাদের আমল থেকে দেখে আসছি ভাদ্র মাসের শুরুতে প্রথম সাতদিন নববধূরা স্বামীর মুখ দেখা ও কথা বলা থেকে বিরত থাকে। কালের গতিতে তা এখনও চলে আসছে। ফারহানা বিলকিছ মিমির স্বামী স্কুল শিক্ষক আবু তাহের জানান, অনেকদিন পর স্ত্রী বাবার বাড়িতে গেছে এটা আনন্দের বিষয়। রুবিনার শ্বশুর রনজু চৌধুরী জানান, আমরা বাপ-দাদার কাছ থেকে দেখে আসছি নববধূদের ভাদর কাটানি এ ছাড়া আর কোন কিছু জানি না। তবে ভাদ্র মাসের প্রথম তিন দিন স্বামীর মুখ দেখলে স্বামীর অকল্যাণ হয়, এটা তিনি শুনেছেন কিন্তু বিশ্বাস করেন না। ভাদর কাটানি যে এক ধরনের কুসংস্কার সেটি এ অঞ্চলের অধিকাংশ লোকজন জানেন বা উপলব্ধি করতে পারেন। এর পরেও তারা সামাজিক প্রথা হিসেবে এই রেওয়াজটি দীর্ঘদিন ধরে মেনে আসছেন। অনেকের মতে, বাপ-দাদার আমল থেকে যে রেওয়াজ চালু আছে তা কি হঠাৎ করেই অমান্য করা যায়। আজকাল অবশ্য শহরাঞ্চলের শিক্ষিত পরিবারগুলোতে এটিকে কুসংস্কার বলে পরিহার করলেও গ্রামাঞ্চলের অনেক শিক্ষিত পরিবারে তা এখনও মেনে চলছে। উত্তরের পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুর, নীলফামারী, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, রংপুর, গাইবান্ধা ও জয়পুরহাট এই নয় জেলায় ভাদর কাটানির রেওয়াজের পাশাপাশি আরও একটি প্রবণতা দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে। এসব জেলায় খবর নিয়ে দেখা গেছে প্রতিবছর ভাদ্র মাস শুরু হবার আগে শ্রাবণে বিয়েরও ধুম পড়ে যায়। যা অনেকটা প্রতিযোগিতার মতোই। এরপর পুরো ভাদ্র মাসই বিয়ে বন্ধ থাকে।
×