ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

পেশা ছাড়ছে গাইবান্ধার চুন বানানো যুগীরা

প্রকাশিত: ১০:২৬, ২০ আগস্ট ২০১৯

 পেশা ছাড়ছে গাইবান্ধার চুন বানানো যুগীরা

আবু জাফর সাবু, গাইবান্ধা থেকে ॥ পান সুপারি এখনও এদেশের গ্রামীণ মানুষের সংস্কৃতির সঙ্গে জড়িয়ে আছে। বিয়ে-শাদি এমনকি যেকোন খানাপিনা ও মেহেমানদারিতেও পান সুপারি একান্ত অপরিহার্য একটি উপাদান। এই পান খেয়ে মুখ লাল করতে এবং পান সুপারির ঝাল এবং কষ্টা ভাবটা দূর করে একে মুখরোচক করতে যে উপাদানটি কার্যকর ভূমিকা রাখে তা হচ্ছে ঝিনুকের চুন। এই চুন ছাড়া পান খাওয়ার কথা ভাবাই যায় না। খাল, বিল, নদী থেকে ঝিনুক কুড়িয়ে, নানা পদ্ধতিতে যারা চুন তৈরি করে তারা হলো যুগী সম্প্রদায় বা চুনার নামে আখ্যায়িত। এ কারণে পান খাওয়ার এই ঝিনুক চুনকে যুগীর চুনও বলা হয়। হিন্দু সম্প্রদায়ের কতিপয় যুগী পরিবার এখনও গাইবান্ধার বিভিন্ন এলাকায় তাদের আদি পেশাকে আঁকড়ে তাদের জীবন জীবিকা নির্বাহ করছে। আর সরবরাহ করছে পান সুপারির রসনা তৃপ্তির সহযোগী উপাদান ঝিনুকের চুন। গাইবান্ধা জেলার গোবিন্দগঞ্জ, সাঘাটা, ফুলছড়ি, সুন্দরগঞ্জ, সাদুল্যাপুর ও সদর উপজেলার ঝিনুক থেকে চুন উৎপাদনকারি প্রায় সাড়ে তিন হাজার পেশাজীবী পরিবার এখনও নানা সমস্যা সঙ্কট নিরসন করেও পৈত্রিক পেশাকে আঁকড়ে ধরে তাদের জীবন জীবিকা নির্বাহ করে চলেছে। কিন্তু নদ-নদী ও খাল-বিলে ঝিনুকের সংখ্যা কমে যাওয়া, চুনা পাথর থেকে তৈরি চুনের ব্যবহার বৃদ্ধি পাওয়ায় যুগীদের তৈরি যুগীর চুনের চাহিদা হ্রাস পেয়েছে। তদুপরি ঝিনুকের চুনের উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি, আর্থিক সঙ্কটসহ নানা কারণে পেশাদার যুগীরা জীবন জীবিকার তাগিদে পৈত্রিক পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় চলে যেতে বাধ্য হচ্ছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, সদর উপজেলার রামচন্দ্রপুর ইউনিয়নের বালুয়ার বাজার সংলগ্ন জলেরমোড়ের যুগীপাড়া গ্রামটি এই ঝিনুকের চুনের কারিগরদের কারণে ইতোমধ্যে চুনের গ্রাম নামেই সর্বাধিক পরিচিত অর্জন করেছে। এই যুগীপাড়াসহ পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলোতে স্বাধীনতা পূর্বকালে প্রায় ১শ’ ৩০ পরিবারের বসতি ছিল। যারা ঝিনুকের চুন তৈরি করে খুব সচ্ছল জীবন যাপন করত। কেননা, সে সময় চারদিকে নদী বেষ্টিত এ জেলায় ঝিনুক পাওয়া যেত অনেক বেশি। সেজন্য চুনও উৎপাদনের পরিমাণও ছিল নেহায়েত কম নয়। এছাড়া পাথরের চুনের প্রচলনও তখন শুরু হয়নি। উৎপাদিত চুন এখান থেকে যেতো পার্শ্ববর্তী জেলায়। ফলে দাম বেশি পাওয়া যেতো বলে তখন চুনের কারবার ছিল রমরমা। কিন্তু এখন সে অবস্থা আর নেই। সম্প্রতি রামচন্দ্রপুরের যুগীপাড়ায় মাত্র ১৫ পরিবার তাদের পুরাতন এই চুন তৈরির পেশাকে আঁকড়ে রেখেছে। পরিবারের নারী-পুরুষ মিলে এই চুন তৈরিতে নিয়োজিত থাকে। যুগীরা ব্রহ্মপুত্র তীরবর্তী বালাসীঘাট, কামারজানি, করতোয়া নদীর বড়দহ ঘাটসহ বিভিন্ন এলাকার জেলেদের কাছ থেকে নদীর ঝিনুক কেনে। মাছ ধরার সময় জালে যে ঝিনুক ওঠে, স্থানীয় ভাষায় সেগুলোকে বলা হয় ‘সিপি’ বা ‘টোকরাই’। জেলেরা তা জমা করে রাখে যুগীদের জন্যই। প্রতিমণ ঝিনুক যুগীরা কেনে ৫শ’ থেকে ৬শ’ টাকা দরে। তারপর এগুলোকে তারা গরম পানিতে সিদ্ধ করে। যাতে সেগুলো মরে যায় এবং এতে সহজেই খোলস দুটো ফাঁক হয়ে খুলে যায়। এরপর যুুুুগী পরিবারের মেয়েরা প্রতিটি ঝিনুক থেকে ভেতরের নরম অংশগুলো বের করে নেয়। যা হাঁস-মুরগির অত্যন্ত পুষ্টিকর এবং প্রিয় খাবার হিসেবে খামারীদের কাছে বিক্রি হয়। এ অবস্থায় ঝিনুকের খোলসগুলো পানিতে ধুয়ে পরিষ্কার করে রোদে শুকানো হয়। সবশেষে চুনের ভাঁটিতে আগুনে পুড়িয়ে তা ছাই করা হয়। ভাঁটিতে আগুনের উত্তাপ বৃদ্ধির জন্য সাইকেলের চাকায় তৈরি একটি বিশেষ হাঁপর চালিয়ে ভাঁটিতে বাতাস দেয়া হয়। ঝিনুক বা টোকরাইয়ের এই ছাইগুলো বড় মাটির পাত্রে রেখে তাতে পানি মিশিয়ে বাঁশের লাকড়ি দিয়ে ঘুটিয়ে ঘুটিয়ে তৈরি করা হয় পানে খাওয়ার সেই কাক্সিক্ষত চুন। গাইবান্ধা সদর উপজেলার রামচন্দ্রপুর ইউনিয়নের জলের মোড় যুগীপাড়া গ্রামের যুগীরা জানালেন, এক মণ ঝিনুক থেকে দুই মণ চুন হয়। এক মণ ঝিনুকের চুন তৈরি করতে সময় লাগে তিনদিন। এই চুন তারা প্লাস্টিকের ক্যানে ভরে মাথায় নিয়ে অথবা সাইকেলে করে পানের দোকানে দোকানে ফেরি করে প্রতি কেজি ৫৫ থেকে ৬০ টাকায় বিক্রি করে। এছাড়া ঝিনুকের কোমলাংশ এবং চুন বিক্রি করে খরচ বাদে লাভ হয় ৫শ’ ৮০ টাকা থেকে সাড়ে ৬শ’ টাকা। যা দিয়ে তাদের জীবন জীবিকা নির্বাহ করা দুঃসাধ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। এছাড়া পরিবেশগত ভারসাম্যহীনতায় খাল-বিল শুকিয়ে যাওয়ায় স্থানীয় নদী-নালা-খাল-বিল থেকে এখন আর সহজেই ঝিনুক পাওয়া যায় না। ফলে জেলার বাইরে থেকেও বেশি দামে ঝিনুক কিনে আনতে হয়। এতে চুনের উৎপাদন খরচ পড়ে যায় অনেক বেশি। তদুপরি ইদানীং সমুদ্রের শঙ্খ এবং সাদা রংয়ের ঝিনুক থেকেও চুন তৈরি হচ্ছে পার্শ্ববর্তী বগুড়াসহ অন্যান্য জেলায়। সেখানে শঙ্খ এবং সাদা ঝিনুকও কিনতে পাওয়া যায়। সামুদ্রিক শঙ্খ এবং সাদা ঝিনুক থেকে যে চুন হয় তার রং এমনিতে হয় সাদা। ইদানীং কোথাও কোথাও এসিড মিশিয়ে সাধারণ ঝিনুকের চুনের মতো সাদা ধবধবে করা হচ্ছে। যা স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর। আবার এইসব সাদা চুনের চাহিদাও অনেক বেশি। এতে দামও পাওয়া যায় অনেক বেশি। কিন্তু দরিদ্র এই যুগীদের চুনে কোন কেমিকেল মেশানো হয় না বলে তার রং হয় একটু কালচে। ফলে সঙ্গত কারণে ধবধবে এই সাদা শঙ্খের চুনের দাম বেশি হলেও প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছে না যুগীদের বানানো ঝিনুকের চুন। জলেরমোড়ের যুগীপাড়ার যুগীরা জানালেন, তাদের দাবি আর্থিক কারণে তারা আদি এই গ্রামীণ শিল্পের বিকাশ ঘটাতে পারছে না। এ জন্য সহজ শর্তে ঋণ সহায়তা দেয়া হলে তাদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ঘটানো সম্ভব হবে এবং তারা এতদঞ্চলের খাল-বিল-নদী-নালা থেকে প্রাপ্ত সাধারণ এই ঝিনুকের চুন শিল্পের বিকাশ ঘটাতে পারবে।
×