ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

শেখ হাসিনা এখনও টার্গেট

হুজি যুগের অবসান হলেও জঙ্গীবাদের অস্তিত্ব বিলীন হয়নি

প্রকাশিত: ১০:৫১, ২১ আগস্ট ২০১৯

হুজি যুগের অবসান হলেও জঙ্গীবাদের অস্তিত্ব বিলীন হয়নি

গাফফার খান চৌধুরী ॥ দেশে ইসলামী শাসন ব্যবস্থা কায়েমের ক্ষেত্রে শেখ হাসিনাকেই বড় বাধা বলে মনে করে উগ্র মৌলবাদী ও জঙ্গী সংগঠনগুলো। আজও জঙ্গীরা সেই ধারণা থেকে সরে যায়নি। এখনও জঙ্গীদের হত্যার টার্গেটে রয়েছেন শেখ হাসিনা। জঙ্গী হামলার ঝুঁকি থেকে এখনও শেখ হাসিনা মুক্ত নন। বোমা দিয়ে শেখ হাসিনা হত্যার মিশন বার বার ব্যর্থ হয়েছে। এজন্য শেখ হাসিনাকে নিশ্চিতভাবে হত্যা করতেই এদেশে পাকিস্তানী শক্তিশালী আর্জেস গ্রেনেড আনা হয়। সেই গ্রেনেড দিয়েই একুশে আগস্ট হামলা চালানো হয়। হামলার পর দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে একের পর এক ৯৪টি গ্রেনেড উদ্ধার হয়। যার মধ্যে ৭৯টিই পাকিস্তানের তৈরি আর্জেস গ্রেনেড। আর্জেস গ্রেনেডগুলো নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠন জেএমবি ও হুজির কাছ থেকে উদ্ধার হয়। বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতা নেয়ার পর সীমান্ত পথে পাকিস্তান থেকে এদেশে গ্রেনেড আসা শুরু হয়। আর্জেস গ্রেনেডও বিফল হলে শেখ হাসিনাকে হত্যা করতে জেএমবি নিজস্ব প্রযুক্তিতে চারটি রকেট লঞ্চার তৈরি করেছিল। বাংলাদেশে জঙ্গীবাদের উত্থান ও শেখ হাসিনাকে শতভাগ নিশ্চিতভাবে হত্যা করতে পাকিস্তান থেকে গ্রেনেড আসা এবং জেএমবির রকেট লঞ্চার তৈরির বিষয়গুলো একইসূত্রে গাঁথা। একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলার পর দেশে জঙ্গী গোষ্ঠী হুজি যুগের অবসান হলেও জঙ্গীবাদের অবসান হয়নি বলে গোয়েন্দাদের দাবি। নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠন হুজির উত্থান ॥ আফগান যুদ্ধ শেষে দেশে ফেরা প্রায় দেড়হাজার মুজাহিদ বিভক্ত হয়ে পড়ে। একটি অংশ চলে যায় শায়খ আব্দুর রহমান ও বাংলা ভাইদের জেএমবিতে। আর কিছু অংশ চলে যায় মুফতি হান্নানের সঙ্গে। মুফতি হান্নান আফগান ফেরত মুজাহিদদের একত্রিত করতে রাজধানীর বাড্ডার তালতলায় জাগো মুজাহিদ নামের একটি অফিস খুলেন। সেখানেই চলতে থাকে হুজির কার্যক্রম। দুইটি সংগঠন আলাদাভাবে কাজ করলেও তাদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য এক। দেশে ইসলামী শাসন কায়েম করা। জেএমবির মতো হুজিও হামলা শুরু করে। ১৯৯৯ সালে যশোরে উদীচী সমাবেশে বোমা হামলার ঘটনা ঘটে। জেএমবি ও হুজির ধারণা বাংলাদেশে ইসলামী শাসন ব্যবস্থা কায়েমের পথে বড় বাধা শেখ হাসিনা। তাই শেখ হাসিনাকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিতে হবে। এমন পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ২০০০ সালের ২০ জুলাই গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায় শেখ হাসিনার নির্বাচনী সমাবেশস্থলে ৭৫ কেজি ওজনের বোমা পেতে রাখে হুজি। কিন্তু সে বোমা উদ্ধার হওয়ায় পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। শেখ হাসিনাকে নিশ্চিতভাবে হত্যা করতে আনা হয় গ্রেনেড। এরপর সিলেটে আরও একবার শেখ হাসিনাকে হত্যার চেষ্টা করে হুজি। কিন্তু প্রাণে রক্ষা পান শেখ হাসিনা। এরপর শেখ হাসিনাকে নিশ্চিতভাবে হত্যা করতেই বাংলাদেশে গ্রেনেড আনা হয়। ২০০৪ সালের একুশে আগস্ট বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে শেখ হাসিনাসহ জ্যেষ্ঠ নেতাদের হত্যা করে আওয়ামী লীগকে নেতৃত্ব শূন্য করতেই গ্রেনেড হামলা চালানো হয়। হামলায় প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের স্ত্রী আইভি রহমানসহ ২৪ জন নিহত হন। আহত হন পাঁচ শতাধিক। কোনমতে বেঁচে যান শেখ হাসিনা। কিন্তু তার দুই কানই মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এমন ঘটনায় শুরু হয় সারা দুনিয়াজুড়ে তোলপাড়। শেখ হাসিনাকে হত্যা করতে রকেট লঞ্চার তৈরি করেছিল ॥ জেএমবির কারাবন্দী আমীর জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় শূরা সদস্য মুফতি মাওলানা সাইদুর রহমান জাফর ২০১০ সালে ঢাকার কদমতলী এলাকা থেকে পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়। সাইদুর রহমান গোয়েন্দাদের জানিয়েছেন, সার কারখানা থেকে সংগ্রহ করা রক সালফার পরবর্তীতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাঁড়াশি অভিযানের মুখে বস্তায় বস্তায় পানিতে ফেলে নষ্ট করে দেয়া হয়েছে। তবে তখনও জেএমবির অনেক সামরিক শাখার কাছে সেই রক সালফার ছিল। হুজি শেখ হাসিনাকে হত্যা করতে ব্যর্থ হওয়ার পর জেএমবি নিজেদের প্রযুক্তি ব্যবহার করে রকেট লঞ্চার তৈরি করেছিল। অনেক দূর থেকে নিক্ষেপ করা যায় এমন চারটি রকেট লঞ্চার তারা তৈরি করেছিল। যার মধ্যে সুন্দর বনের গহীন জঙ্গলে তারা দুইটি রকেট লঞ্চারের সফল পরীক্ষাও চালিয়েছে। রকেট লঞ্চার তৈরির উদ্দেশ্যও ছিল শেখ হাসিনাকে হত্যা করা। গ্রেনেড উদ্ধার ও উৎস ॥ একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলার পর গ্রেনেডের উৎস সম্পর্কে শুরু হয় খোঁজখবর। আসামিদের গ্রেফতারে সারাদেশে অভিযান শুরু হয়। অভিযানে ২০০৬ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি র‌্যাব-৩ ঢাকা থেকে পরিত্যক্ত অবস্থায় ৪টি আর্জেস গ্রেনেড উদ্ধার হয়। এরপর ২০০৭ সালে ২৮ ও ২৯ অক্টোবর র‌্যাব সদর দফতরের ইন্টেলিজেন্স উইং ও র‌্যাব-৬ এর একটি দল রাজধানীর বাড্ডার বাসা থেকে হুজি প্রধান মুফতি হান্নানকে ১৬টি আর্জেস গ্রেনেড ও চারটি একে-৪৭ রাইফেল, বিপুল পরিমাণ তাজা বুলেট, শক্তিশালী বোমা তৈরির সরঞ্জামসহ গ্রেফতার করে। র‌্যাব-১২ এর একটি দল ২০০৭ সালের ৩ নবেম্বর রাশিয়ান এইচই (হাই এক্সপ্লোসিভ)-৩৬ মডেলের ৪টি গ্রেনেড, ৩শ’ রাউন্ড এলএমজির (লাইট মেশিন গান) তাজা বুলেট ও তিনটি এলএমজির ম্যাগজিন, ২০০৮ সালের ৫ জানুয়ারি র‌্যাব-৯ এর একটি দল ১২টি হ্যান্ড গ্রেনেড ও ৮টি শক্তিশালী পাওয়ার জেল উদ্ধার করে। ২০০৮ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি গাজীপুর জেলার বানিয়াচালা মেম্বারবাড়ি জামে মসজিদ থেকে একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলার অপারেশনাল কমান্ডার মুফতি মঈন উদ্দিন ওরফে আবু জান্দালকে গ্রেফতার করে র‌্যাব সদর দফতরের গোয়েন্দারা। আবু জান্দালের তথ্যমতে ১৫ ফেব্রুয়ারি সাতক্ষীরা জেলার দেবহাটা থেকে নজরুল ইসলাম ঘরামিকে গ্রেফতার করা হয়। তার কাছ থেকে উদ্ধার হয় ৪১টি আর্জেস গ্রেনেড। ২০০৮ সালের ২৮ মে র‌্যাব-৬ এর একটি দল পরিত্যক্ত অবস্থায় রাশিয়ান এইচই-৩৬ মডেলের একটি গ্রেনেড উদ্ধার করে। ২০০৬ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি র‌্যাব-২ একটি আর্জেস গ্রেনেড, র‌্যাব-১২ ২০০৯ সালের ৭ সেপ্টেম্বরে ১টি এবং র‌্যাব-১ এবং র‌্যাব-৯ যৌথ অভিযান চালিয়ে ২০০৯ সালের ১১ অক্টোবর শেরপুর জেলার ঝিনাইগাতি থেকে ১০টি আর্জেস গ্রেনেড উদ্ধার করে। সব মিলিয়ে ৭৩টি আর্জেস-৮৪ মডেলের গ্রেনেডসহ ৯০টি গ্রেনেড উদ্ধার হয়। এছাড়া বঙ্গবন্ধু এভিনিউ থেকে অবিস্ফোরিত অবস্থায় একটি ও হামলার পর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে আরও একটি আর্জেস-৮৪ মডেলের গ্রেনেড উদ্ধার করে পুলিশ ও কারা কর্তৃপক্ষ। সবমিলিয়ে ৭৫টি আর্জেস গ্রেনেড উদ্ধার হয়। আর সর্বশেষ গত ২৬ মার্চ রাজধানীর দক্ষিণখান থানাধীন কসাইবাড়ির পূর্ব মোল্লারটেকের প্রেমবাগান এলাকার একটি বাড়ি থেকে একটি আর্জেস গ্রেনেড, ১২টি পেট্রোলবোমা, ৩০টি হাতবোমা ও শক্তিশালী বোমা তৈরিতে ব্যবহৃত ৬০টি ডেটোনেটরসহ চার জেএমবি সদস্যকে গ্রেফতার করে র‌্যাব।
×