ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

মানুষ খুনের রাজনীতি রক্তাক্ত বিকেল বিভীষিকা

প্রকাশিত: ১১:০১, ২১ আগস্ট ২০১৯

মানুষ খুনের রাজনীতি রক্তাক্ত বিকেল বিভীষিকা

মোরসালিন মিজান ॥ শহর ঢাকা ৪০০ বছরের পুরনো। বহু ঘটনা দুর্ঘটনার স্বাক্ষী। কিন্তু ২১ আগস্ট যা ঘটেছিল তা একেবারেই ভিন্ন মাত্রার। ২০০৪ সালের এইদিনে অসংখ্য মানুষের জনসভায় গ্রেনেড হামলা চালানো হয়। মুহূর্তেই মৃত্যুপুরী। নরকযন্ত্রণা। মিছিল করতে করতে সমাবেশে যোগ দেয়া যুবকের হাত উড়ে যায়। স্লোগানে মুখর নারী তার পা খুঁজে পায় না। শুধু রক্ত। রক্তে ভেসে যাওয়া মাটিতে জীবিত এবং মৃত মানুষ একসঙ্গে গড়াগড়ি খায়। বিষণœ সেই বিকেলের কথা আজও ভুলতে পারে না ঢাকা। নৃশংস হামলার নেপথ্যে ছিল মানুষ খুনের রাজনীতি। সেই রাজনীতির নীরব স্বাক্ষী হয়ে আছে বঙ্গবন্ধু এভিনিউ। ঘটনার দিন কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে সমাবেশ করছিল আওয়ামী লীগ। সন্ত্রাসবিরোধী সমাবেশে প্রধান অতিথি ছিলেন তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ট্রাকের ওপর স্থাপিত মঞ্চে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা করছিলেন তিনি। সামনে হাজার হাজার নেতাকর্মী। বহু সাধারণ মানুষ। এলোমেলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। বক্তৃতা শুনে উজ্জীবিত সবাই। একটু পর মিছিল। মিছিলে অংশ নেয়ার প্রস্তুতি চলছিল। সব মিলিয়ে প্রাণবন্ত সমাবেশ। এমন সময় বিকেল ৫টা ২২ মিনিটে বিকট শব্দ। একটার পর একটা শব্দে চারপাশ প্রকম্পিত হতে থাকে। ধোঁয়ার কু-লি। আগুনে পোড়া গন্ধ। আর্তচিৎকার। গোঙ্গানির শব্দ। এভাবে বেশ কিছুক্ষণ অতিক্রান্ত হওয়ার পর স্পষ্ট হয়Ñ গ্রেনেড হামলা হয়েছে। পাশের উঁচু বিল্ডিং থেকে একের পর এক গ্রেনেড ছুঁড়ে মারা হয়। নিষ্ঠুর হামলায় মোট ২৪ জন নিহত হন। আহত হয় প্রায় ৩০০ মানুষ। আহতদের অনেকের শরীর গ্রেনেডের স্পিøন্টারে ছিঁড়ে যায়। শীরর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় অঙ্গ প্রত্যঙ্গ। এভাবে প্রকাশ্য জনসমাবেশে গ্রেনেড হামলা চালিয়ে মানুষ হত্যার ঘটনা ঢাকার ইতিহাসকে কলঙ্কিত করেছে। সেদিনের ছবি দেখে রাজধানীবাসী আজও আঁতকে উঠেন। লজ্জায় পড়ে যান। এ প্রসঙ্গে কথা হচ্ছিল ইতিহাসবিদ ড. ফিরোজ মাহমুদের সঙ্গে। জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ জনসমুদ্রে পরিণত হয়েছিল রেসকোর্স ময়দান। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বক্তৃতা শুনতে আসা মানুষের সমুদ্রে বোমা নিক্ষেপ হতে পারেÑ এমন আশঙ্কা ছিল। শেষতক তা হয়নি। পাকিস্তানের শাষকগোষ্ঠী যা করেনি স্বাধীন বাংলাদেশে আমরা যেন তা-ই ঘটতে দেখলাম। হাজার হাজার মানুষের সমাবেশে যুদ্ধাস্ত্র ছুড়ে মারা হলো। ঢাকার ইতিহাসে প্রকাশ্যে গ্রেনেড ছুড়ে এমন নির্বিচার মানুষ হত্যার নজির নেই বলে জানান তিনি। একই প্রসঙ্গে মুক্তিযোদ্ধা ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব নাসির উদ্দীন ইউসুফ বলেন, ঢাকা আন্দোলন সংগ্রামের তীর্থ ভূমি। এখানে যুগে যুগে কালে কালে অধিকার আদায়ের লড়াই হয়েছে। মিছিল সমাবেশ হয়েছে। এসবে পুলিশের হামলে পড়া দেখেছি আমরা। কিন্তু ২১ আগস্ট যে গ্রেনেড হামলা সেটি অত্যন্ত সুপরিকল্পিত। একটি আদর্শকে খুন করার চেষ্টা। বিরুদ্ধ মত থাকবে। নানা পথ থাকবে। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের এই তো সৌন্দর্য। কিন্তু সেদিন যা ঘটেছিল তা মানুষ খুন করার রাজনীতি। এ রাজনীতি দিয়ে কোন আদর্শ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। যারা মানুষ হত্যা করে নিজেদের মত, নিজেদের রাজনীতি প্রতিষ্ঠা করতে চায় মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশে তাদের ঠাঁই হবে না বলে মন্তব্য করেন তিনি। কবি ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ উপাচার্য মুহাম্মদ সামাদ বলেন, আমার নিজের শহরে এমন করুণ মৃত্যু দেখেছি, ভাবলে আজও গা শিউরে ওঠে। বিভিন্ন বয়সী মানুষ, যাদের অধিকাংশই আমাদের অচেনা, সেই মানুষগুলোকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হলো। বীভৎস মৃত্যু, রক্তে ভেসে যাওয়া শরীর, আহাজারি কোনদিন ভুলবার নয়। মানুষ হয়ে আরেক মানুষের এমন মৃত্যু দেখে নিজেই নিজের কাছে ছোট হয়ে যাই। মানবিক সমাজের দাবি পুনর্ব্যক্ত করে তিনি বলেন, রাজনীতি সমাজনীতি অর্থনীতি সবই মানুষের জন্য হতে হবে। তা-ই যেন হয়। আর যেন কোনদিন না আসে ২১ আগস্ট।
×