ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

মিলু শামস

ওয়ান বেল্ট ওয়ান, পিভট টু এশিয়া এবং এ্যাক্ট ইস্ট

প্রকাশিত: ১১:২৭, ২১ আগস্ট ২০১৯

ওয়ান বেল্ট ওয়ান, পিভট টু এশিয়া এবং এ্যাক্ট ইস্ট

সিল্ক রোড নামে পরিচিত মধ্য এশিয়া থেকে পশ্চিম অভিমুখী প্রাচীন বাণিজ্য রুটটি ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ নাম দিয়ে চীন নতুনভাবে পুনরুজ্জীবিত করার উদ্যেগ নিয়েছে। বিশ্ববাণিজ্য ও ভূরাজনীতিতে নিজের অবস্থান পোক্ত করার জন্যই বেইজিং প্রকল্পটি হাতে নিয়েছে। চীনের এই স্থল বাণিজ্য রুট এশিয়া, ইউরোপ ও আফ্রিকার বহুসংখ্যক শিল্প ও বাণিজ্যিক স্থাপনা এবং সড়ক, রেল ও অভ্যন্তরীণ নৌবন্দরকে সংযুক্ত করবে। মোট পঁয়ষট্টিটি দেশ এই রুট ব্যবহার করতে পারবে। বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ষাট শতাংশের বসবাস এ দেশগুলোতে। মোট বৈশ্বিক জিডিপির এক-তৃতীয়াংশ এসব দেশের। চায়না ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক এসব দেশের প্রায় ৯০০ প্রকল্পে ৯০ হাজার কোটির বেশি ডলার বিনিয়োগ করেছে। ‘স্ট্রিং অব পার্ল’ বা ‘মুক্তারমালা’ নামে তাদের আরও একটি অর্থনৈতিক নেটওয়ার্ক গড়ার পরিকল্পনা রয়েছে। এ দুটো বাস্তবায়িত হলে চীন সম্ভবত বিশ্বের শীর্ষ অর্থনৈতিক দেশের অবস্থানে পৌঁছে যাবে। চীনের এ এগিয়ে চলাকে ঠেকাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ‘পিভট টু এশিয়া’ কৌশল নিয়েছে। এতে এ অঞ্চলে তাদের প্রধান মিত্র ভারত। শি জিন পিং এ পরিকল্পনাকে বিশ্বজুড়ে চীনের প্রভাব বিস্তারের পরিকল্পনা নয় বলে পশ্চিমা কূটনৈতিকদের আশ্বস্ত করলেও পশ্চিমা বিশ্ব বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের চীন নিয়ে রয়েছে বড় ধরনের হিসাব-নিকাশ। দক্ষিণ চীন সাগরে চীনের বিরুদ্ধে ফিলিপিন্স, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া, ব্রুনাই ইত্যাদি দেশেকে নৌশক্তি প্রদর্শনের জন্য ক্রমাগত প্রভাবিত করার চেষ্টা করছে যুক্তরাষ্ট্র। চীনের শতকরা আশি ভাগ জ্বালানি তেল আসে ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ার মাঝখানের মালাক্কা প্রণালী দিয়ে। দক্ষিণ এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা ও ইউরোপের সঙ্গে বাণিজ্য যোগাযোগও এ পথে। এ পথ বন্ধ করে দিয়ে চীনকে বাণিজ্য ঝুঁকিতে ফেলাই যুক্তরাষ্ট্রের মূল উদ্দেশ্য। এ উদ্দেশ্যে তারা নৌশক্তির এক বড় অংশ দক্ষিণ চীন সাগরে মোতায়েনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই গোটা পরিকল্পনার নাম ‘পিভট টু এশিয়া’। এর বাস্তবায়নের জন্য দু’হাজার পনেরো সালে প্রকাশিত হয় যুক্তরাষ্ট্রের সামুদ্রিক কৌশলগত দলিল- ‘এ ক্রিয়েটিভ স্ট্র্যাটেজি ফর টুয়েন্টি ফার্স্ট সেঞ্চুরি সি পাওয়ার : ফরোয়ার্ড, এনগেজড রেডি। সংক্ষেপে সিএস ২১ আর। সিএস ২১-এ আরও বলা হয়েছে দু’হাজার বিশ সালের মধ্যেই যুক্তরাষ্ট্রের নৌ ও বিমান শক্তির শতকরা ষাট ভাগ এ অঞ্চলে মোতায়েন করা হবে। চীনকে ঘেরাও করার জন্যই যে এ পরিকল্পনা তাও এতে স্পষ্ট করা হয়, এ পরিকল্পনায় আরও রয়েছে চীনের বিরুদ্ধে মার্কিন বিমান নৌযুদ্ধ এবং ভারত মহাসাগরে চীনের আমদানি-রফতানি যে কোন সময় আটকে দেয়া। দু’হাজার বারো সালে সিঙ্গাপুরে অনুষ্ঠিত এক সংলাপে সে সময়ের মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী লিও পেনট্টা যুক্তরাষ্ট্রের নৌশক্তির শতকরা ষাট ভাগ প্রশান্ত ও ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে মোতায়েন করার কথা জানান। প্রশান্ত ও ভারত মহাসাগর অঞ্চলের ভূ-রাজনীতির গুরুত্ব আগের যে কোন সময়ের চেয়ে অনেক বেড়েছে বলেও জানিয়েছিলেন তিনি। তবে চীনও যথারীতি এগিয়ে চলছে। বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় ঋণদাতা এখন সমাজতান্ত্রিক বাজার অর্থনীতির চীন। ডলারের হিসাবে এ মুহূর্তে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি চীনের অর্থনীতির প্রায় তিনগুণ। দু’হাজার সাত সালেই আসিয়ান দেশগুলোর সঙ্গে চীনের বাণিজ্য যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড়িয়ে গেছে। বেজিংয়ের অর্থনীতিবিষয়ক পরামর্শদাতা প্রতিষ্ঠান জিকে ড্রাগনোমিক্সের এক কর্মকর্তা বছর দুয়েক আগে প্রত্যয়ের সঙ্গে বলেছিলেন, আগামী দশ বছরের মধ্যে চীনের অর্থনীতির আয়তন যুক্তরাষ্ট্রের সমান হবে। এ ভবিষ্যদ্বাণীতে অতিরঞ্জন নেই বলেই মনে হয়। কারণ বিশ্ব মুদ্রা মজুদের চল্লিশ শতাংশের বেশি রয়েছে চীনের কাছে। দু’হাজার পঁচিশ সালের মধ্যে দু’শ’ একুশটি নগর ও আটটি অত্যাধুনিক মেগাসিটি নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে তাদের। যার প্রতিটিতে জনসংখ্যা থাকবে দশ লাখ। চীনের অর্থনীতি লাফিয়ে এগোচ্ছে। দু’হাজার দশের শেষ দিকে ডলারের হিসাবে তার অর্থনীতির আয়তন ছিল পাঁচ দশমিক আট ট্রিলিয়ন ডলার বা ছয় লাখ কোটি ডলার। এক শ’ পঁয়ত্রিশ কোটি দশ লাখ জনসংখ্যার দেশ চীন বর্তমান বিশ্বে দ্বিতীয় বৃহত্তম তেলভোক্তা। প্রথম স্থানে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। তেলের জন্য চীনকে তাই বিভিন্ন মহাদেশে অনুসন্ধান চালাতে হচ্ছে। বিমানবাহী জাহাজ তারা সমুদ্রে ভাসিয়েছে সে খবর এখন পুরনো। সব শেষ খবর হলো, চীন দূরপাল্লার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েন শুরু করেছে যা সমুদ্রে চলমান জাহাজে আঘাত করতে সক্ষম। এ ধরনের ক্ষেপণাস্ত্র বিশ্বে এই প্রথম। বিমানবাহী জাহাজ হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের নৌশক্তির মূলস্তম্ভ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে বিমানবাহী জাহাজ হচ্ছে নৌশক্তির প্রদর্শনের অন্যতম স্ট্যাটাস সিম্বল। চীনের এ দ্রুত এগিয়ে চলা ক্রমেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে বিচলিত করছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শাসক গোষ্ঠীর যে অংশ বুশ প্রশাসনের মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল তারা এখন বেশি সোচ্চার। তাদের মতে, যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্য নিয়ে ব্যস্ততার থাকার সুযোগে চীন বিশ্বজুড়ে তার আর্থিক ও বাণিজ্যিক প্রভাব বিস্তার করেছে। নৌপথে আটকে যাওয়ার বিকল্প হিসেবেও চীনের বেশ কিছু পদক্ষেপ রয়েছে। সিঙ্গাপুর থেকে চীনের কুন মিং পর্যন্ত রেল পথ চালুর পরিকল্পনা রয়েছে তাদের। যা সিঙ্গাপুর থেকে মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড হয়ে লাওস অথবা মিয়ানমার হয়ে চীন পৌঁছবে। এটি চালু হলে সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ার সমুদ্র বন্দরগুলোর সঙ্গে চীন সরাসরি যুক্ত হবে। বেলুচিস্তানের গোয়াদরে আরব সাগর তীরে চীন যে সমুদ্র বন্দর নির্মাণ করেছে তার সঙ্গে চীনা ভূখ-ের সড়ক ও রেলপথ এবং তেল ও গ্যাস পাইপে লাইন নির্মাণে পাকিস্তানের সঙ্গে চুক্তি হয়েছে এবং কাজও শুরু হয়েছে। দক্ষিণ চীন থেকে মিয়ানমার হয়ে বাংলাদেশে সমুদ্র বন্দর পর্যন্ত পৌঁছতে সড়ক ও রেল পথ নির্মাণের কাজও তারা শুরু করে। ওদিকে আফগানিস্তান-ইরান হয়ে আরব সাগর ও পারস্য সাগরে পৌঁছানোর পথ তৈরির পরিকল্পনাও চীনের রয়েছে। বিশেষজ্ঞরা যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ককে তাই কৌশলগত অবস্থান থেকে বিবেচনা করতে বলছেন। বিশ্বের সব মানুষের ‘নিরাপত্তা রক্ষার’ দায়িত্বে নিয়োজিত যুক্তরাষ্ট্র এখন ভীষণভাবে চিন্তিত এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলের নিরাপত্তা নিয়ে। দু’হাজার বারো সাল থেকে শুরু হওয়া ‘যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ নিরাপত্তা সংলাপ’-এর তৃতীয় সংলাপে দু’ই হাজার চৌদ্দ সালের এপ্রিলে মার্কিন দলের প্রধান টমাস কেলির সংলাপ শেষের সংবাদ সম্মেলনে স্পষ্টভাবে সে দুশ্চিন্তা ফুটে উঠেছিল- ‘আসলে সমুদ্র পথগুলো ক্রমবর্ধমান বিশ্ব পুঁজিবাদের শিরা-উপশিরা। বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ নৌ পথগুলোতে সামুদ্রিক নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠিত না হলে তা কাজ করতে পারবে না। বঙ্গোপসাগর পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অর্থনীতির সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্য ও ভারতের পাশাপাশি আফ্রিকার বিকাশমান অর্থনীতিকে সংযুক্ত করে সুতরাং এটি শুধু বাংলাদেশ বা এশিয়ার দেশগুলোর জন্য নয় যুক্তরাষ্ট্র ও গোটা বিশ্বের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ যে বঙ্গোপসাগরে সত্যিকারে সামুদ্রিক নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠিত হোক।’ বঙ্গোপসাগর সামুদ্রিক নিরাপত্তা কী এখন বিঘিœত নয়? একমাত্র যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া ভূ-রাজনীতি বিশেষজ্ঞরা কেউই সে কথা বলছেন না। টমাস কেলি ওই বক্তব্যে আরও বলেছিলেন ‘আমি জোর দিয়ে বলতে চাই যে, বিশ্বের নৌ পথগুলোর চলাচলের স্বাধীনতা যুক্তরাষ্ট্রের একটি মৌকি স্বার্থ।’ এই হচ্ছে আসল কথা। কথার এ সুরের সঙ্গে বিশ্ববাসী পরিচিত। কোন দেশ বা অঞ্চলের ‘নিরাপত্তা’ বা ‘শান্তি প্রতিষ্ঠা’ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ‘দুশ্চিন্তা’ যে কত গভীর ছাপ রেখে যায় ইরাক, আফগানিস্তান, লিবিয়া, সিরিয়ার দিকে তাকালে তা পরিষ্কার হয়ে যায়। মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার কাজ মোটামুটি সম্পন্ন করে যুক্তরাষ্ট্রের মনযোগ এখন ক্রমশ দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দিকে। চিন্তার কথা সেটাই। কারণ নিজের ‘মৌলিক স্বার্থ’ ক্ষুণœ হয় এমন কোন কিছু যুক্তরাষ্ট্র বরদাশ করে না। আপাতত সমুদ্রে তার সে স্বার্থ প্রবলভাবে ক্ষুণœ করার হুমকি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে বেয়াড়া চীন। তাই চীনকে শায়েস্তা করাই দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম লক্ষ্য। কোন রকম রাখঢাক না করেই যুক্তরাষ্ট্র বলেছে সে কথা তাদের ‘পিভট টু এশিয়া’ নীতিতে। এ পরিকল্পনা ‘চীন ঘেরাও’ কৌশলকে বাস্তবায়নের জন্য করা হবে। যার মধ্যে থাকবে চীনের বিরুদ্ধে পেন্টাগনের বিমান-নৌযুদ্ধ, ভারত মহাসাগর দিয়ে চীনের আমদানি রপতানি যে কোন সময় আটকে দেয়ার সক্ষমতা অর্জন। এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে কৌশলগত সহযোগিতা ও অংশদারিত্ব নিশ্চিত করতে হবে। ইন্দো প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে এই কৌশলগত সহযোগিতা ও অংশীদারিত্ব নিশ্চিত করতে কে দাঁড়াবে যুক্তরাষ্ট্রের পাশে? ঝলসে ওঠে একটি নামÑ ভারত। যুক্তরাষ্ট্রের যেমন আছে পিভট টু এশিয়া’ ভারতের আছে তেমনি ‘এ্যাক্ট ইস্ট।’ ঊনিশশ নব্বই এর দশকে নরসীমারাও এর ‘লুক ইস্ট’ নীতি অটলবিহারী বাজপেয়ী ও মনমোহন সিং হয়ে নরেন্দ্র মোদীর হাতে এসে হয়েছে এ্যাক্ট ইস্ট। তবে নাম বদলালেও উদ্দেশ্য অভিন্নই রয়েছে- তাহল দক্ষিণ-এশিয়ায় ভারতের একক আধিপত্য নিশ্চিত করা। অন্তর্গত এ উদ্দেশ্যে অটুট আস্থা রেখেই জন কেরির উপস্থিতিতে ভারত ‘লজিস্টিটিক এক্সচেঞ্জ মেমোরেন্ডাম অব এগ্রিমেন্ট’ সংক্ষেপে এলই এম ও সই করেছে।
×