ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

কাশ্মীর কোন্ পথে

প্রকাশিত: ১১:৩০, ২১ আগস্ট ২০১৯

কাশ্মীর কোন্ পথে

॥ নয় ॥ পাকিস্তান থেকে আসা জঙ্গী মৌলবাদী মুজাহিদীনদের হামলায় তিন লাখ হিন্দু জম্মুতে এসে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছিল। সন্ত্রাসের ঘটনা শ্রীনগরে যতটা ঘটেছে, গ্রামের দিকে ততটা হয়নি। যে কারণে প্রতিবেশী মুসলমানদের ভরসায় বিভিন্ন গ্রামে কিছু হিন্দু ১৯৯০-এর পরও থেকে গিয়েছিলেন। জঙ্গীরা যখনই এসব গ্রামে থাকা হিন্দুদের খবর পেয়েছ- তাদের ওপর হামলা করেছে। হামলার নৃশংসতা বোঝার জন্য ওয়ানধামা হত্যাকাণ্ডের উল্লেখ করতে পারি। ১৯৯৮-এর ২৬ জানুয়ারি ছিল ভারতের প্রজাতন্ত্র দিবস, একই সঙ্গে ছিল মুসলমানদের পবিত্র ধর্মীয় দিবস শব-ই-কদর। সেই রাতে কাশ্মীরের গন্ডারবাল জেলার ওয়ানধামা গ্রামের মুসলমানরা যখন বিশেষ নামাজ আদায় করতে মসজিদে গেছে তখন অতর্কিতে গ্রামে হামলা করেছে জঙ্গীরা। রাতের অন্ধকারে তারা শ্রীনগর থেকে মাত্র ত্রিশ কিলোমিটার উত্তরের এ জনপদে ২৩ জন কাশ্মীরী প-িতকে হত্যা করেছে নৃশংসভাবে। যাদের ভিতর ৯ জন মহিলা এবং ৪টি শিশু। একজনের বয়স ছিল মাত্র এক বছর। অপরজনের বয়স তিন বছর। শ্রীনগরের মুসলিম সম্প্রদায়ের নেতারা সব সময় কাশ্মীরে ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে হাজার হাজার মুসলমান হত্যার বিবরণ দিয়েছেন, নারী নির্যাতনের কথা বলেছেন, গৃহে অগ্নিসংযোগ ও লুণ্ঠনের কথাও বলেছেন, কিন্তু তাঁরা ’৮৯-৯০-এ কাশ্মীরে হিন্দু পন্ডিতদের ওপর মুসলিম মৌলবাদী জঙ্গীদের হামলার বিষয়টি এড়িয়ে গেছেন। জম্মুর শরণার্থী শিবির ঘুরে ফিরে পনুন কাশ্মীরের দফতরে গিয়েছিলাম কাশ্মীরে হিন্দুদের ওপর যেসব নির্যাতন হয়েছে তার বিবরণ সংগ্রহ করার জন্য। প্যারেড গ্রাউন্ডের পাশে গীতা ভবনের ছোট্ট এক কামরায় উদ্বাস্তু কাশ্মীরী হিন্দু প-িতদের এই দফতর। একজন বৃদ্ধ বসেছিলেন অতি জীর্ণ দফতরে। পরিচয় জেনে বললেন, আপনি বরং এখানকার পত্রিকা অফিসে খুঁজে দেখুন, যা চাইছেন পেতে পারেন। জম্মুর সর্বাধিক প্রচারিত ইংরেজী দৈনিক ‘ডেইলি এক্সেলশিয়র’-এর কপি শ্রীনগরে আমার হোটেলও দেখেছি। নামটি পরিচিত হওয়ার বিশেষ কারণ ছিল। এ পত্রিকায় মুখ্যমন্ত্রী ফারুখ আবদুল্লাহর সঙ্গে আমার সাক্ষাৎকার সম্পর্কে বড় রিপোর্ট ছেপেছিল। ট্যাক্সিওয়ালাকে পত্রিকার নাম বলতেই জানিপুরায় এক্সেলশিয়রের দফতরে নিয়ে গেছে। সর্বাধিক প্রচারিত ইংরেজী দৈনিক হলেও দফতর আহামরি কিছু নয়। তবে স্থানীয় এবং অধিকাংশ সর্বভারতীয় পত্রিকার ফাইল যতœ করে রাখা আছে। ওয়ানধামার ঘটনার কথা বললে তারা আলাদা একটি ফাইল বের করে দিলেন। ব্রাউন পেপারে বাঁধানো ফাইলের ওপর মার্কার দিয়ে ইংরেজীতে লেখা ‘ওয়ানধামা ম্যাসাকার।’ ২৭ জানুয়ারি ’৯৮-এর ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের মূল খবরের ভেতর একটা বক্স আইটেমে চোখ আটকে গেল। মুজামিল জলিলের লেখা এক কলাম সংবাদের শিরোনাম ‘সে ছিল আমার রাখী বোন।’ খবরে বলা হয়েছেÑ ‘যখন শব-ই-কদরের পবিত্র রাতে গ্রামবাসীরা কাশ্মীরের শান্তি সমৃদ্ধি ফিরিয়ে আনার জন্য মসজিদে প্রার্থনা করছিল তখনই পুনরাবৃত্তি ঘটেছে মর্মন্তুদ ঘটনার। এবার ঘটেছে সেই পন্ডিতদের ঘরে, যাদের সম্প্রদায়ের অন্যরা ’৯০-এ গ্রাম ছেড়ে চলে গেলেও তারা যায়নি। ‘আমাকে এখন কে বিশ্বাস করবে? বুলেটে বুলেটে ঝাঁঝরা হয়ে যে সীমা এখানে মাটিতে পড়ে আছে, ও আমার রাখী বোন ছিল। প্রথমবার ও যখন রাখী বাঁধতে এসেছিল তখন আমি বলেছিলাম, তুমি হিন্দু আর আমি মুসলমান। তারপরও সীমা আমার হাতে রাখী বেঁধেছিল।’ কোণে বসে কাঁদতে কাঁদতে বলল এক মুসলমান যুবক। ‘গ্রামের নম্বরদার বৃদ্ধ আবদুস সামাদ ইতস্তত ছড়িয়ে থাকা লাশগুলো গুনতে গুনতে বললেন, ‘ওদের মনে যদি এটা ছিল, উচিত ছিল আগে আমাদের হত্যা করা। দুঃখ আর লজ্জায় আমাদের মাথা হেঁট হয়ে গেছে। আমরা এদের নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম, যখন ’৯০ সালে এদের আটটি পরিবার গ্রাম থেকে চলে যায়।’ ‘নিহত প্রতিবেশী মোতিলালের কথা বলছিলেন হাজী মোহিদীন। ‘ডাক্তারখানার কম্পাউন্ডার ছিলেন মোতিলাল। ক’দিন আগে যখন শুনলেন আমার শরীর ভাল নয়, মাঝরাতে ছুটে এসেছিলেন আমার বাড়িতে। ভালমতো পরীক্ষা করে ওষুধ আর ইনজেকশন দিয়েছিলেন। এ গ্রামে আমরা একে অপরের সুখ-দুঃখের সঙ্গী হয়ে মিলেমিশে বংশ পরম্পরায় বাস করছিলাম একটি পরিবারের মতো। গত রাতে আমাদের সেই ভালবাসা আর সম্প্রীতির মৃত্যু ঘটেছে।’ ‘অল্প দূরে একজন মুসলমান নারী বুক চাপড়ে কাঁদছিলেন তার নিহত হিন্দু পুত্রের জন্য। ‘দক্ষিণ কাশ্মীরের শোপিয়ান থেকে এক তরুণ দম্পতি তাদের দুই শিশু সন্তান নিয়ে মামাবাড়ি বেড়াতে এসেছিল। তাদের বেড়ানোর পরিসমাপ্তি ঘটেছে মৃত্যুর মধ্য দিয়ে।’ ওয়ানধামার এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের দশ মাস আগে সংগ্রামপোরা গ্রামে একই ধরনের ঘটনা ঘটেছিল। সেখানে নিহতের সংখ্যা ছিল আট। এরা ছিলেন সেসব হতভাগ্য প-িত, যারা জম্মু যাওয়ার খরচ যোগাতে পারেননি কিংবা যারা সরল মনে বিশ্বাস করেছিলেন তাদের মুসলমান প্রতিবেশীদের। তারা ধারণা করতে পারেননি সীমান্তের ওপর থেকে আসা ভিনদেশীরা প্রত্যন্ত অঞ্চলের গ্রামে এসে তাদের হত্যা করবে। এসব হত্যাকাণ্ড শরণার্থীদের কাশ্মীরে প্রত্যাবর্তনের সম্ভাবনা ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছে। ওয়ানধামার এই মর্মন্তুদ ঘটনার সাক্ষী ষোলো বছরের তরুণ বিনোদ কুমার ধর, যার ডাকনাম আশু। এখন জম্মুতে থাকে বিভাগীয় কমিশনারের বাড়িতে। আশু বলেছে, রাত দশটার দিকে পনেরো কুড়িজন লোক, যাদের পরনে ছিল আর্মির পোশাক, মুখ ছিল কালো কাপড়ে ঢাকা, ওদের গ্রামে ঢুকেছিল। একজন ছাড়া সবাই উর্দুতে কথা বলছিল। কয়েক গ্রুপে ভাগ হয়ে ওরা প-িতদের বাড়িতে প্রবেশ করেছে। একটি গ্রুপ আশুদের বাড়িতে ঢুকে চা খেতে চায়। সঙ্গে সঙ্গে ওদের চা দেয়া হয়। ওরা যখন চা খাচ্ছিল তখন এক বন্দুকধারী এসে খবর দেয়, গোটা এলাকা ঘিরে ফেলা হয়েছে। তারপরই ওরা গুলি করা শুরু করে। আশু গোবরের গাদায় লুকিয়ে থেকে প্রাণ বাঁচিয়েছে। ওয়ানধামা গ্রামের অধিবাসীদের ভিতর সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি কত গভীর ছিল তা প্রকাশ পেয়েছে নিহত পণ্ডিতদের শেষকৃত্যের সময়। তাদের সৎকারের যাবতীয় আয়োজন প্রতিবেশী মুসলমানদেরই করতে হয়েছে। গ্রামের মুসলমান মহিলারা বুক চাপড়ে কেঁদেছেন। আশপাশে হিন্দু পুরোহিত না থাকায় বিএসএফ ক্যাম্প থেকে একজনকে আনা হয়েছে প্রার্থনার জন্য। এর দু’দিন পর মুখ্যমন্ত্রী ফারুখ আবদুল্লাহ ওয়ানধামা এসে বিরূপ পরিস্থিতির শিকার হয়েছিলেন। মুসলিম গ্রামবাসীরা চিৎকার করে বলেছেন, ‘আপনার সরকার আমাদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়েছে।’ ওয়ানধামার এই নৃশংস ঘটনার তিন মাস না পেরোতেই একই ধরনের নারকীয় হত্যাকাণ্ড ঘটেছে উধমপুর জেলার প্রাণকোট গ্রামে। ‘কাশ্মীর টাইমস’-এর রিপোর্ট (২১ এপ্রিল, ’৯৮) অনুযায়ী জঙ্গীরা গুলি করে এই গ্রামের ৩০ জন হিন্দু প-িতকে হত্যা করেছে, যাদের ভিতর নারী ও শিশু ছিল। প-িতদের বাড়িতে গুলি করেও ক্ষান্ত হয়নি জঙ্গী সন্ত্রাসীরা। তারা বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। এই গ্রামের আক্রান্ত হিন্দুদের ভিতর একজন মাত্র বেঁচে আছে। সে হচ্ছে জনৈক শোভারামের চার মাস বয়সী কন্যা সন্তান, যার শরীরের ৭৫ ভাগ পুড়ে গেছে। টাইমস অব ইন্ডিয়ার খবরে বলা হয়েছেÑ ‘প্রাণকোটে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে ১৩ জনকে। বাকিদের জবাই করে কিংবা আগুনে পুড়িয়ে মারা হয়েছে। প্রাণকোটের এই ঘটনার পর আশপাশের গ্রামে যেসব প-িত পরিবার অবশিষ্ট ছিল তারা তাদের ঘরবাড়ি ফেলে চলে গেছে।’ ’৯৮-এর জানুয়ারিতে হেরাল্ডের বার্ষিক সংখ্যায় পাকিস্তানের জিহাদ রফতানির ওপর এক দীর্ঘ প্রতিবেদন লিখেছেন জাইগাম খান। তাঁর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ’৮৭ সালে লাহোর থেকে ৩০ মাইল দূরে মুরিদকে শহরে ‘মার্কায় দাওয়া ওয়াল ইরশাদ’ গঠন করেছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন জন অধ্যাপক। মার্কাযের প্রধান নীতি হচ্ছে দাওয়াত ও জিহাদ। সবাইকে ইসলামের ছায়ায় আশ্রয় নেয়ার দাওয়াত দেয়া হবে। যারা এই দাওয়াত প্রত্যাখ্যান করবে তাদের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করা হবে। এই জিহাদ পরিচালনার উদ্দেশ্যে মার্কাযের নেতারা গঠন করেছেন ‘লস্করে তৈয়বা’, বর্তমানে যাকে গণ্য করা হয় পাকিস্তানের সর্ববৃহৎ জিহাদী সংগঠন হিসাবে।... সাংবাদিক জাইগাম খানকে দেয়া এক সাক্ষাতকারে লস্করে তৈয়বার আমির হাফিজ মোহাম্মদ সাঈদ বলেছেন, ‘আমাদের জিহাদ নির্দিষ্টভাবে অমুসলমান, বিশেষ করে হিন্দু ও ইহুদীদের বিরুদ্ধে। এরা হচ্ছে ইসলামের দুই প্রধান দুশমন। কোরানে বলা আছে, এরা ইসলামের দুশমন। এরা পাকিস্তান ও মুসলমানদের জন্য সমস্যা সৃষ্টি করছে।’ গণতন্ত্র সম্পর্কে লস্করে তৈয়বার আমিরের বক্তব্যÑ ‘গণতন্ত্র হচ্ছে এমন একটি ভয়ানক বস্তু যা আমরা পেয়েছি বিদেশী সরকারের কাছ থেকে। এগুলো একেবারেই অপ্রয়োজনীয় জিনিস এবং এমন একটি সিস্টেমের অংশ, যার বিরুদ্ধে আমরা লড়ছি। আমাদের কোন কোন ভাই মনে করেন এই সিস্টেমের ভিতর থেকেও ইসলামী সমাজ ব্যবস্থা কায়েম করা যায়। গণতান্ত্রিক সিস্টেমের ভিতর থেকে ইসলামী সমাজ কায়েম করা সম্ভব নয়। আল্লাহ্ যদি আমাদের সুযোগ দেন আমরা ইসলামী খিলাফতের বিশুদ্ধ ধারণা ফিরিয়ে আনব।’ কাশ্মীরে তাদের কাজের ব্যাপারে লস্করে নেতা খুবই আশাবাদী। তাঁর মতে, ‘কাশ্মীরে সবাই ত্যাগের আদর্শ নিয়ে কাজ করছে। সংগঠনগুলো একে অপরের সঙ্গে সহযোগিতার সম্পর্ক বজায় রেখে কাজ করে যাচ্ছে।’ ১৯৯৯ সালে কারগিল যুদ্ধের সময় পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর প্রধান অবলম্বন ছিল লস্করে তৈয়বার জঙ্গী বাহিনী। ভারতের বিরুদ্ধে কাশ্মীরের মাটিতে তাদের জিহাদ এখনও অব্যাহত আছে। পাকিস্তান সম্পর্কে লস্কর নেতার বক্তব্যÑ ‘আমাদের কাজের জন্য পাকিস্তান হচ্ছে আদর্শ স্থান। এখানে আমাদের কাজে পরিপূর্ণ স্বাধীনতা রয়েছে। এখান থেকে আমার তৈরি করছি মুজাহিদীন, প্রচারক ও বিকল্প নেতৃত্ব। এমন এক সময় আসবে ইসলামের যারা বিরোধিতা কছে তারা ধ্বংস হয়ে যাবে। এ কাজ শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে করতে হবে।’ কাশ্মীরে আসার আগে দিল্লীতে ইসলামিক সেন্টারের সভাপতি মওলানা ওয়াহিদ উদ্দিন খান বলেছিলেন, পাকিস্তান অন্য দেশকে ধ্বংস করার যে উদ্যোগ নিয়েছে একদিন তা পাকিস্তানেরই ধ্বংসের কারণ হবে। (ক্রমশ.)
×