ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

চরম লোকসানের মুখে পোল্ট্রি শিল্প

প্রকাশিত: ১১:৪৬, ২১ আগস্ট ২০১৯

চরম লোকসানের মুখে পোল্ট্রি শিল্প

রহিম শেখ ॥ চট্টগ্রাম বন্দরে পণ্য খালাসে জটিলতার কারণে ভয়াবহ সঙ্কটের মুখে পড়েছে দেশের পোল্ট্রিখাত। সবচেয়ে কম সময়ে পণ্য খালাস করতেও ১৮ থেকে ২০ দিন সময় লাগছে। কখনও কখনও এক মাসেরও বেশি সময়ে পণ্য খালাস হচ্ছে না। আর এই জটিলতার কারণে কাঁচামালের আমদানি খরচ ২৫ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে অভিযোগ করছেন সংশ্লিষ্টরা। পোল্ট্রি ও ফিশ ফিডের প্রস্তুতকারক ও কাঁচামাল আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলোর বলছে, যার ফলে মাছ, মুরগি ও গবাদিপশু খাদ্যের উৎপাদন খরচ বহুগুণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। স্বল্পতম সময়ে এ সমস্যার সমাধান না হলে বিপর্যস্ত হয়ে পড়বে প্রাণিজ আমিষ উৎপাদনের সবচেয়ে বড় সহায়ক এ খাতটি। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, এসিআই গোদরেজ নামের একটি কোম্পানির যুক্তরাষ্ট্র থেকে আনা স্টেরিলাইজড ফিশ মিল চট্টগ্রাম বন্দরে এসে পৌঁছে চলতি বছরের ২৬ জুন। অথচ কনসাইমেন্টটি ছাড়করণ করা হয় ১ মাস ৫ দিন পর। কনসাইমেন্টটির এলসি ভ্যালু ছিল ৩ কোটি ৮৪ লাখ ৫০ হাজার ৫শত ৪২ টাকা। বিলম্বে মাল খালাসের জন্য বন্দরকে জরিমানা বাবদ পরিশোধ করতে হয়েছে ৯ লাখ ১৩ হাজার ৪৫০ টাকা। এছাড়া শিপিংলাইনকে অতিরিক্ত প্রদান করতে হয়েছে ১৪ লাখ ৭৪ হাজার ১৯৬ টাকা। অর্থাৎ মোট জরিমানা পরিশোধ করা হয়েছে ২৩ লাখ ৮৭ হাজার ৬৪৬ টাকা। নারিশ ফিড মিল নামের একটি প্রতিষ্ঠানের ১২টি কন্টেনারে আসা ৩০৮.৮৩২ টন ডিডিজিএস চট্টগ্রাম বন্দরে এসে পৌঁছে চলতি বছরের ২১ জুলাই। এরপর তা ছাড়করণ করা হয় ৬ আগস্ট। এতে মোট সময় লেগেছে ১৭ দিন। ৬৮ লাখ ৬৯ হাজার ৯ শত ২৪ টাকা এলসি মূল্যের আমদানিকৃত পণ্যে অর্থদ- দিতে হয়েছে প্রায় ১১ লাখ ৭৫ হাজার ৯ শত ৮৮ টাকা। প্যারাগন ফিড লিঃ নামের অপর একটি প্রতিষ্ঠানের ৮টি কন্টেনারে ২০৯.৭০৬ টন এবং অপর ১৫ কন্টেনারে ৩৯২.৩৬৫ টন ডিডিজিএস চট্টগ্রাম বন্দরে এসে পৌঁছে যথাক্রমে ২ জুলাই ও ৪ জুলাই তারিখে। এরপর তা চূড়ান্ত এ্যাসেসমেন্ট ও ছাড়করণ করা হয় ২৯ ও ৩১ জুলাই। অর্থাৎ মোট সময় লেগেছে ২৮ থেকে ৩০ দিন। মোট ২৩টি কন্টেনারে আসা ১ কোটি ৩২ লাখ ৩৩ হাজর ৮ শত ৮৩ টাকার (এলসি মূল্য) পণ্যে অর্থদ- পরিশোধ করতে হয়েছে প্রায় ১৫ লাখ ৮৫ হাজার ৩৪১ টাকা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পুরো প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে এ ধরনের কনসাইনমেন্ট ছাড় করাতে এক সপ্তাহ সময়ও লাগা উচিত নয়। জানা গেছে, কোরবানির ঈদের ছুটির কারণে গত ৪ আগস্ট থেকে ১৭ আগস্ট পর্যন্ত ল্যাব টেস্টের জন্য নমুনা সংগ্রহ বন্ধ রাখার নোটিস ইস্যু করেছিল পোল্ট্রি রিসার্চ এ্যান্ড ট্রেনিং সেন্টার (পিআরটিসি)। সরকারী সিদ্ধান্তে ল্যাব বন্ধ থাকলেও এই ১৪ দিনসহ পরীক্ষার জন্য আনুমানিক আরও প্রায় ২০-২৫ দিনে বড় অঙ্কের আর্থিক ক্ষতিপূরণ পরিশোধ করবে বন্দর কর্তৃপক্ষ। এ নিয়ে চরম হতাশা বিরাজ করছে পশু খাদ্য প্রস্তুতকারক ও কাঁচামাল আমদানিকারকদের মাঝে। এ বিষয়ে প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় ও প্রাণিসম্পদ অধিদফতরকে দ্রুত ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছেন বাংলাদেশ পোল্ট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ সেন্ট্রাল কাউন্সিলের (বিপিআইসিসি) সভাপতি মসিউর রহমান। অভিযোগ রয়েছে, আমদানিকৃত পণ্যের মূল্য রি-এ্যাসেস করার মাধ্যমে পণ্যের দাম ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো হচ্ছে। আমদানিকারকরা বলছেন, পণ্য আমদানির সকল কাগজপত্র জমা দেয়ার পরও কাস্টমস কর্তৃপক্ষ নিজেদের খেয়াল খুশিমতো পণ্যের মূল্য পুণর্নির্ধারণ করছেন। এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে চট্টগ্রাম কাস্টমস কমিশনার মোহাম্মদ ফখরুল আলম জনকণ্ঠকে বলেন, অভ্যন্তরীণ ঘাটগুলোর বিভিন্ন সমস্যার কারণে পণ্য খালাসে দেরি হচ্ছে। ফলে সময়মতো লাইটার জাহাজ পাওয়া যাচ্ছে না। কাস্টমস কমিশনার বলেন, গত আড়াইবছরে তিন হাজারের বেশি চালানের পণ্য বন্দরে আটকা আছে। এসব পণ্য এ্যাসেসমেন্ট করা হয়েছে, কিন্তু কাস্টমসে শুল্ক পরিশোধ করা হয়নি। এতে সরকার যেমন রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, বন্দরে কাজেরও সমস্যা হচ্ছে। তবে ব্যবসায়ীরা তা মানতে নারাজ। গতবছর একটি জাহাজ থেকে ৫২ হাজার ৫০০ টন গম খালাস করতে সময় লাগে ৭৩ দিন। ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, অব্যবস্থাপনার কারণে ল্যাবে এক পণ্যের সঙ্গে অন্য পণ্যের মিশ্রণে সম্পূর্ণ ভুল রিপোর্টও আসছে। আমদানিকৃত ফিস মিল হয়ে যাচ্ছে কখনও মিট এ্যান্ড বোন মিল, আবার কখনও রিপোর্টে দেখানো হচ্ছে বোভাইন এমনকি শুকরের মাংস ও হাড়ের উপস্থিতিও। এ বিষয়ে জানতে চাইলে যোগাযোগ করা হলে চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি এ্যান্ড এনিমেল সাইন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিপার্টমেন্ট অব মাইক্রোবায়োলজি এ্যান্ড ভেটেরিনারি পাবলিক হেলথ এর ফ্যাকাল্টি অব ভেটেরিনারি মেডিসিন এবং পিআরটিসি’র পরিচালক প্রফেসর ড. পরিতোষ কুমার বিশ্বাস বলেন, ল্যাবে এক পণ্যের সঙ্গে অন্য পণ্যের মিশ্রণে সম্পূর্ণ ভুল রিপোর্ট আসাটা দুঃখজনক। এভাবে একটা সেক্টর চলতে পারে না। অনুসন্ধানে দেখা যায়, প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের চলতি বছরের ২৩ জুন একটি চিঠির মাধ্যমে ফিশ মিল ও ডিডিজিএস আমদানির ক্ষেত্রে সকল চালান চট্টগ্রামের জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তার উপস্থিতিতে নমুনা সংগ্রহপূর্বক পিআরটিসি ল্যাবে পরীক্ষা করার অনুরোধ জানানো হয়েছিল। পরীক্ষায় যে বিষয়গুলো নিরীক্ষার কথা বলা হয়েছে তা হলো : শুকরের উপজাতের উপস্থিতি, মাইক্রোবায়োলজিক্যাল পরীক্ষা, ভারি ধাতুর উপস্থিতি ও ক্ষতিকারক এ্যান্টিবায়োটিকের উপস্থিতি। অথচ কাস্টমস কর্তৃপক্ষ উক্ত পরীক্ষাসমূহের অতিরিক্ত ‘বোভাইনের উপস্থিতি’ এবং অনুমান বিশ্লেষণ করার শর্তও যুক্ত করে দিচ্ছেন। মূলত : এরপর থেকেই ল্যাব পরীক্ষার রিপোর্ট পেতে এবং পণ্য খালাস করাতে মাত্রাতিরিক্ত সময় ব্যয় হচ্ছে। ফিড ইন্ডাস্ট্রিজ এ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি এহহেশাম বি. শাহজাহান বলেন, পণ্যের ল্যাব পরীক্ষা করাতে তাদের কোন আপত্তি নেই। তবে পরীক্ষা, এ্যাসেসমেন্ট, রি-এ্যাসেসমেন্ট ইত্যাদির নামে যে সময়ক্ষেপণ করা হচ্ছে এবং সেজন্য যে অর্থদ- দিতে হচ্ছে তার দায় আমদানিকারকদের কাঁধে আসার যৌক্তিকতা কোথায়? সেক্ষেত্রে যদি সরকারী কাজের জটিলতার কারণে পণ্য খালাসে দীর্ঘসূত্রতা ঘটে থাকে তবে সে দায় থেকে আমদানিকারকদের রেহাই দিতে হবে। এমনকি পণ্যের গুণগতমানের ক্ষতি হলে ক্ষতিপূরণের বিষয়টিও বিবেচনা করতে হবে। ল্যাব টেস্টে দীর্ঘসূত্রতার অবসানে প্রয়োজনে একাধিক ল্যাব বা ইউনিট প্রতিষ্ঠা; এমনকি বেসকারী উদ্যোগে আন্তর্জাতিকমানের ল্যাব প্রতিষ্ঠায় সরকারী অনুমতিরও দাবি জানান তিনি। খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, ল্যাব টেস্ট ও অন্যান্য জটিলতার কারণে শুধুমাত্র মাছ, মুরগি ও গবাদি পশুর খাদ্য তৈরিতে ব্যবহৃত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ ডিডিজিএস ও ফিশমিল -এই দু’টি পণ্য আমদানিতে প্রতিমাসে ১৫ থেকে ২০ কোটি টাকার অধিক অর্থদ- দিতে হচ্ছে পোল্ট্রিখাতের আমদানিকারকদের। এ ধরনের দীর্ঘসূত্রতাকে দেশের শিল্প উন্নয়নের পথে বড় অন্তরায় বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
×