ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

শ্রীকৃষ্ণের আবির্ভাব তিথির মাহাত্ম্য

প্রকাশিত: ০৯:১০, ২৩ আগস্ট ২০১৯

শ্রীকৃষ্ণের আবির্ভাব তিথির মাহাত্ম্য

পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের আবির্ভাব তিথিকে তাঁর ভক্তরা ‘জন্মাষ্টমী’ বলতেই বেশি ভালবাসেন। ‘ঈশ্বরঃ পরমঃ কৃষ্ণঃ সচ্চিদানন্দ বিগ্রহঃ অনাদিরাদিগোবিন্দঃ সর্বকারণ কারণম্ ॥’ -ব্রহ্মসংহিতা অর্থাৎ- ‘শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন পরম পুরুষোত্তম্ পরমেশ্বর ভগবান। তাঁর শ্রীবিগ্রহ অর্থাৎ শ্রীদেহ সৎ-চিৎ আনন্দঘন, নিত্য শাশ্বত, চিন্ময় বা জ্ঞানময় এবং চিদানন্দময়। তাঁর কোন আদি নেই। কারণÑ তিনিই অনাদিরাদি, সব কিছুর উৎস। তিনিই সর্বকারণের আদি কারণ। সকল অস্তিত্বের পরম উৎস।’ অথর্ব বেদে বলা হয়েছে- ‘যো ব্রহ্মনং বিদধাতি পূর্বং যো বৈ বেদাংশ্চ গাপয়তি স্ম কৃষ্ণ।’ ‘যিনি সৃষ্টির আদিতে ব্রহ্মাকে বৈদিক জ্ঞান উপদেশ করেছিলেন এবং পূর্বেই বৈদিক জ্ঞান বিস্তার করেন, তিনিই শ্রীকৃষ্ণ।’ তিনি যদি অনাদিরাদিই হবেন, তাহলে দ্বাপর যুগে অত্যাচারী রাজা কংসের কারাগারে আবির্ভূত হয়েছিলেন যে কৃষ্ণ তিনি কে? কেনইবা তিনি একজন মানবী মাতা দেবকীর গর্ভে জন্মগ্রহণ করলেন। এ প্রশ্ন মনে জাগাই স্বাভাবিক। আমাদের মতো অর্জুন মহাশয়ও কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে শ্রীকৃষ্ণকে প্রশ্ন করেছিলেন, -সূর্যদেব বিবস্বানের জন্ম হয়েছিল তোমার জন্মের অনেক পূর্বে। কিভাবে দশ লাখ বছর পূর্বে গীতার জ্ঞান তুমি তাকে দিয়েছিলে। ভগবান উত্তরে বলেছিলেন- ‘যদিও আমি জন্ম রহিত এবং আমার চিন্ময় দেহ অব্যয় এবং যদিও আমি সর্বভুতের ঈশ্বর, তবুও আমার অন্তরঙ্গা শক্তিকে আশ্রয় করে আমি আমার আদি চিন্ময় রূপে যুগে যুগে অবতীর্ণ হই।’- ভঃগী (৪/৬) শ্রীকৃষ্ণের আবির্ভাব এবং অন্তর্ধান সূর্যের মতো। সুর্য যখন আমাদের দৃষ্টিসীমার মধ্যে উদিত হয় তখন আমরা মনে করি সূর্য উদিত হয়েছে। আবার সূর্য যখন আমাদের দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে যায় তখন আমরা বলি সূর্য অস্ত গেল। সূর্য কিন্তু সর্বক্ষণই আকাশে বিরাজ করছে। এ কথাটি আমরা উপলব্ধি করতে পারি নাÑ কারণ, আমাদের দৃষ্টিইন্দ্রীয়টির ক্ষমতা সীমাবদ্ধ। আমরা মনে করি, সূর্য উদিত হল এবং অস্ত গেল। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ নিত্য। শ্রীকৃষ্ণ কখনও জন্মগ্রহণও করেন না বা মৃত্যুবরণও করেন না। তিনি কেবল সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের মতো সম্পূর্ণভাবে স্বেচ্ছা প্রণোদিত হয়ে পতিত জীবকুলকে উদ্ধার করার জন্য ও তাঁর ভক্তগণকে আনন্দ দানের জন্য এই জড় জগতে আবির্ভূত হন এবং যথাসময়ে লীলা সংবরণ করে অন্তর্হিত হন। অবতার হচ্ছেন- যিনি চিন্ময় জগত থেকে অবতরণ করেন। আমাদের এই পৃথিবীটা হচ্ছে সৌরজগতের মধ্যে অবস্থিত একটি গ্রহ। আর সৌর জগত হচ্ছে ব্রহ্মা-ের মধ্যে অবস্থিত ক্ষুদ্র একটি অংশ। এ রকম অসংখ্য ব্রহ্মা- যে আকাশে ভাসমান তা হচ্ছে জড় জগতের আকাশ। আর এই জড় আকাশের পরপারে শুরু হয় অন্তহীন চিন্ময় জগত। যা পরম দিব্য, মহাবিভূতিময় বৈকুণ্ঠলোক। ঐলোক থেকেই পরম পুরুষ ভগবানের নানা প্রকাশ বিগ্রহকে প্রয়োজন অনুসারে তিনিই অবতরণ করান। আমাদের এই ব্রহ্মা-ে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ নির্দিষ্টকাল অন্তর আবির্ভূত হন। ব্রহ্মার একদিন আমাদের ৪৩২ কোটি বছর। অর্থাৎ ব্রহ্মার একদিন-রাত সমান আমাদের ৮৬৪ কোটি বছর। ব্রহ্মার একদিনকে বলা হয় এক কল্প। এরকম এক কল্পে সত্য-ত্রেতা-দ্বাপর-কলি এ রকম চতুর্যুগ এক হাজার বার আবর্তিত হয়। এই এক হাজার বার আবর্তনের সময় ১৪ জন মনু শাসনাধীনে থাকেন। অর্থাৎ প্রতিজন মনু ৭১ চতুর্যুগ পর্যন্ত শাসন করেন। একজন মনুর শাসনাধীন সময়কে কালকে হয় এক মন্বন্তর। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তার স্বয়ংরূপে প্রতি কল্পের সপ্তম মন্বন্তরের ২৮তম চতুর্যুগের মধ্যে দ্বাপর যুগে আবির্ভূত হন। শ্রীকৃষ্ণ সর্বশক্তিমান পরমেশ্বর ভগবান হয়েও কেন দ্বাপর যুগে মানবকুলে আবির্ভূত হয়েছেন তা ভাগবতম এর (১০/৩/৪১) থেকে আমরা জানতে পারি- সত্যযুগে পরম বিষ্ণুভক্ত সুতপা দেবী ও প্রভু পৃষ্ণী কঠোর তপস্যার মাধ্যমে ভগবান বিষ্ণুকে সন্তুষ্ট করেন। ভগবান হলেন ভক্তবাঞ্ছা কল্পতরূ। তিনি তাঁর প্রিয়ভক্তের কাছে বিক্রীত হয়ে যান। অর্থাৎ প্রিয় ভক্তের ইচ্ছা তিনি পূর্ণ করেনই। ভগবান বিষ্ণু ভক্তদ্বয়ের ভক্তি ও আরাধনায় অত্যন্ত প্রীত হয়ে তাদের বর দিতে চাইলেন। তখন সুতপা দেবী ও প্রভু পৃষ্ণী ভক্তিভরে জানান তাদের কোন কিছুই প্রয়োজন নেই। কেবল ভগবানকে পুত্র রূপে পেলেই তাদের সবকিছু পাওয়া হবে। কিন্তু ভগবান তো শুদ্ধভক্তের ভক্তির কাছে বন্দী, তাই তিনি বর দিলেনÑ ‘তথাস্তু, তোমাদের মনোবাসনা দ্বাপরে পূর্ণ করব।’ ভক্তের বাসনা পূর্ণ করতে আর অত্যাচারী রাজার কবল থেকে ধর্মকে রক্ষা করতে ভগবান আবির্ভূত হবেন, তাই দ্বাপরযুগে কংসবধ লীলা সম্পন্ন করার মানসে ভক্ত সুতপাকে দেবকী রূপে ও প্রভু পৃষ্ণীকে বসুদেব রূপে মথুরায় প্রেরণ করেন। যথাসময়ে দেবকী ও বসুদেবের বিবাহ হয়। অত্যাচারী রাজা কংস দৈববাণী শুনতে পান যে, দেবকীর অষ্টমগর্ভের সন্তান তাকে হত্যা করে জগতে অধর্মের বিনাশ করে, ধর্মের প্রতিষ্ঠা করবেন। তাই অত্যচারী রাজা কংস বসুদেব ও দেবকীকে কারাগারে বন্দী করে রাখেন। প্রিয় ভক্তদ্বয়ের এহেন দুর্দশা সহ্য করতে না পেরে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ভাদ্র মাসের প্রচ- ঝড়ঝঞ্ঝার মধ্যে রাতে শুক্লপক্ষের অষ্টমী তিথিতে যখন রোহিনী নক্ষত্র সংযুক্ত হয়েছে ঠিক তখনই মথুরায় কংসের কারাগারে শ্রীবিষ্ণু রূপে আবির্ভূত হন। সেই সময় বসুদেব শিশুটিকে চতুর্ভুজ মূর্তিতে প্রকটিত হতে দেখেন। পরনে স্বর্ণউজ্জ্বল পীতবাস, পদ্ম পলাশ লোচন, শঙ্খ-চক্র-গদা-পদ্মধারী, তাঁর গলদেশে পদ্মফুলের মালা। বক্ষ শ্রীবৎস চিহ্নিত ও কৌম্ভভমণি শোভিত, সুন্দর কেশধাম যুক্ত, মস্তকে উজ্জ্বল বৈদুর্যমণি খচিত মুকুট শোভা পাচ্ছে। তাঁর গাত্রবর্ণ নবোদিত মেঘমালার মতো উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ এবং তাঁর শ্রীঅংগ কর্ণকু-ল, বাজুবন্দ নানা দিব্য আভরণে ভূষিত। শিশুটির ঐ রকম অসাধারণ রূপ দর্শন করে বসুদেব পরম বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে পড়েন। একটি সদ্যজাত শিশু কিভাবে এমন রতœাভরণ-ভূষিত দিব্য মূর্তিতে প্রকাশিত হতে পারে। আসলে তিনি তো আর কেউ নন তিনি হচ্ছেন- পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ। লেখক : উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী, ডিপিডিসি, ঢাকা
×