ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

‘বর্ণবাদবিরোধী নারী কণ্ঠ টনি মরিসন’

প্রকাশিত: ১৩:৪০, ২৩ আগস্ট ২০১৯

‘বর্ণবাদবিরোধী নারী কণ্ঠ টনি মরিসন’

যখন গোটা আমেরিকা ও ইউরোপে বর্ণবাদের বিষবাষ্প, কৃষ্ণাঙ্গদের প্রতি শ্বেতাঙ্গের চরম ঘৃণা, তারা সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্যে জর্জরিত, কৃষ্ণাঙ্গরা কুসংস্কার ও বিভিন্ন অপরাধে নিমজ্জিত, তখন কলম হাতে তুলে নিয়ে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি ও সমাজ পরিবর্তনের সাহসী পদক্ষেপ নিয়ে ছিলেন টনি মরিসন। দাস প্রথা বিলুপ্ত হলেও শ্বেতবর্ণের মানুষরা তখনও কৃষ্ণবর্ণের মানুষদের তাদের মতোই একজন মানুষ হিসেবে দেখতো না। তখনও কৃষ্ণাঙ্গদের ঘৃণার চোখে দেখা হতো। শুধুমাত্র গায়ের রং ও শারীরিক আকৃতির পার্থক্যের জন্য শ্বেতবর্ণের দৃষ্টিতে তারা ছিল নিকৃষ্ট বা নিচু প্রজাতির মানুষ। তাদের প্রতি ছিল সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে আকাশ পাতাল বৈষম্য। সেই বৈষম্যের বিরুদ্ধেই ছিল টনি মরিসনের পথচলা। তাঁর সাহিত্যকর্মে প্রাধান্য পেয়েছে শিশু ও নারী নির্যাতন, বর্ণবাদ বিরোধিতা, কৃষ্ণবর্ণের মানুষদের প্রতি শ্বেতবর্ণের মানুষদের অমানবিক অবিচার, নির্যাতন ও বৈষম্য। ¯্রােতের বিপরীতে সবাই হাঁটতে পারে না। অধিকাংশ মানুষ ¯্রােতের অনুকূলে থাকতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। হাতে গোনা বিরলপ্রজ কিছু মানুষ ¯্রােতের বিপরীতে হেঁটে ইতিহাস রচনা করেন। তাদের মধ্যে অন্যতম একজন হলেন কৃষ্ণবর্ণের বিখ্যাত মার্কিন ঔপন্যাসিক টনি মরিসন। তিনি ছিলেন কৃষ্ণবর্ণের মানুষদের অধিকার ও সামাজিক মর্যাদা আদায়ের লড়াইয়ে একজন বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর। সাহিত্যকর্মে তিনি তাঁর অসামান্য অবদানের জন্য ১৯৯৩ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার অর্জন করেন। এটি-ই ছিল আফ্রিকান আমেরিকান হিসেবে সাহিত্যে সর্বপ্রথম নোবেল প্রাপ্তি। টনি মরিসন ছিলেন একাধারে একজন ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক, সম্পাদিকা ও প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস। তাঁর উপন্যাসের বৈশিষ্ট্য হলো মহাকাব্যিক রীতি, তীক্ষè কথোপকথন এবং পুঙ্খানুপুঙ্খ চরিত্রায়ন। ১৯৭০ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘দ্য ব্লুুয়েস্ট আই’। এই উপন্যাসে ‘পিকোলা’ নামক কৃষ্ণবর্ণের এক বালিকার নির্দয় ভাগ্য আর অভিশপ্ত জীবনের গল্প লিখেছেন। ছোট্ট পিকোলা নিজেকে চেনার আগে চিনেছে নিজের প্রতি ঘৃণাকে, চিনেছে বৈষম্য আর বিভেদকে, জেনেছে কেবল জন্ম আর বর্ণের ফেরে সে মানব সমাজে নেমে গেছে অনেক নিচে, হয়ে উঠেছে অবহেলা আর ঘৃণার পাত্র। এই পৃথিবীতে কালো রং, মোটা ঠোঁট ও বোচা নাকের কুৎসিত মানুষের কোন মূল্য নেই। তাদের উপর নির্মম নির্যাতন, এমনকি তাদের হত্যা করা হলেও সেটা গুরুতর অপরাধ নয়। সে বুঝতে পারে, নীল রঙের চোখ ও সোনালি চুলের পুতুলের মতো হতে পারলেই মানুষ তাকে আদর করবে। তাই সে ঈশ্বরের কাছে একজোড়া নীল রঙের চোখ প্রার্থনা করত। নিজ মাতাল পিতা কর্তৃক ধর্ষিত হওয়ার পর সে অনুভব করে, এই প্রথম কেউ তাকে কাছে টেনে আদর করেছে। অকালে গর্ভবতী হওয়ার পর সমাজ তাকে তীব্র ঘৃণার দৃষ্টিতে দেখে এবং পুরোপুরিভাবে বিবর্জিত হয়। তখন পিকোলো ভাবতে থাকে, তার কালো রঙের চোখ সম্ভবত ঈশ্বর নীল রঙে পরিণত করেছে। তাই সবাই ভিন্ন দৃষ্টিতে অবাক বিস্ময়ে পিকোলোকে তাকিয়ে দেখছে। মূলত টনি মরিসন একজন কৃষ্ণবর্ণের প্রতিনিধি হিসেবে ‘দ্য ব্লুয়েস্ট আই’ উপন্যাসের মাধ্যমে অত্যন্ত সুচারুরূপে বর্ণবাদ, শিশু নির্যাতন, কৃষ্ণাঙ্গদের প্রতি অমানবিক সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্যগুলো উপস্থাপন করেছিলেন। যা এক সময় সারা পৃথিবীর বুকে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল এবং পাঠক হৃদয় হয়েছিল দগ্ধ। এর তিন বছর পর ১৯৭৩ সালে বের হয় দ্বিতীয় উপন্যাস ‘সুলা’। দুজন কৃষ্ণাঙ্গ মহিলার বন্ধুত্বকে কেন্দ্র করে উপন্যাসের কাহিনী গড়ে উঠেছে। এই উপন্যাস টনির স্বপ্নকে বহুদূর এগিয়ে নিয়ে যায়। পাঠক ও সমালোচকদের মধ্যে ব্যাপক সাড়া পড়ে। লেখক খ্যাতির জন্য তাঁকে অপেক্ষাও করতে হয়নি। এরপর একে একে প্রকাশিত হয় তাঁর আরও নয়টি উপন্যাস। ১৯৭৭ সালে প্রকাশিত হয় উপন্যাস ‘সং অব সলোমান’। এই উপন্যাসে একজন কৃষ্ণাঙ্গ পুরুষের ওপর আলোকপাত করা হয়। ১৯৮১ সালে প্রকাশিত হয় ‘টারবেরি’। ১৯৮৭ সালে প্রকাশ করেন তাঁর সবচেয়ে আলোচিত উপন্যাস ‘বিলাভিড’। একজন আফ্রিকান আমেরিকান দাস নারীর সত্য ঘটনার ওপর ভিত্তি করে তৈরি করেন এই উপন্যাস। মার্গারেট গার্নার নামের এক ক্রীতদাস নারীর দাসত্ব থেকে পালিয়ে আসার ইতিহাস থেকে মরিসনের এই উপন্যাস লেখা হয়। পালিয়ে আসার পরও গার্নারকে দাস-প্রভুরা খুঁজে বের করার চেষ্টা করে। সন্তানকে যাতে দাসত্বে ফিরে না যেতে হয়, সে জন্য সে তার দুই বছর বয়সী মেয়েকে মেরে ফেলে। আত্মহত্যা করার চেষ্টা করে সফল হওয়ার আগেই গার্নার আবার ধরা পড়ে যায়। এখানে প্রমাণিত হয়ে যায় ক্রীতদাসের জীবনের চেয়ে মৃত্যুই শ্রেয়। ১৯৯৮ সালে উপন্যাসটি নিয়ে একই নামের একটি চলচ্চিত্র নির্মিত হয়। এতে অভিনয় করেছিলেন বিখ্যাত টেলিভিশন উপস্থাপিকা অপরাহ উইনফ্রে।
×