ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

প্রেমস্বর্গ

প্রকাশিত: ১৩:৪৩, ২৩ আগস্ট ২০১৯

প্রেমস্বর্গ

কবিতা বলেন, ছড়া বলেন, গল্প বলেন, গান বলেন বা সাংবাদিকতা যাই বলেন, সব বিষয়েই তাঁর হাত শক্তিশালী। আমি বলছি সঙ্গীত সাধক অসিত কুমার ম-লের কথা। সাহিত্যের প্রতিটি ক্ষেত্রেই বিচরণ করলেও তিনি মূলত কবি। কবিতাকেই আজীবন সঙ্গী করে নিয়েছেন, ভালবেসেছেন। তাঁর কবিতা সবসময়ই সমাজের নানা অসঙ্গতির বিরুদ্ধে সোচ্চার। তাঁর কবিতা মানবতাবাদে সমৃদ্ধ, অন্যায়, শোষণ, নিপীড়নে হয়ে ওঠে প্রতিবাদমুখী, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ বিনির্মাণের হাতিয়ার, শান্তিপ্রিয় ও দেশপ্রেমে উজ্জীবিত। বিভিন্ন বিষয় নিয়ে লিখতে লিখতে তাঁর কবিতা হয়ে উঠেছে বৈচিত্র্যময়। তবে আমার মনে হয় কবি প্রেমসুধা বেশ পান করেছেন যার ফলে তাঁর প্রেমের কবিতাগুলো অসাধারণ রূপ লাভ করেছে। বিভিন্ন বিষয়ে প্রকাশিত ত্রিশটিরও বেশি গ্রন্থের জনক অসিত কুমার ম-লের ‘প্রেমস্বর্গ’ কাব্যগ্রন্থটি পরিপূর্ণ একটি প্রেমের কবিতার বই। অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০১৯-এ দাঁড়িকমা থেকে প্রকাশিত ৪০টি প্রেমের কবিতা দিয়ে গ্রন্থিত বইটির প্রচ্ছদ করেছেন পাবলো আহান। বুক সাইজ ৬৪ পৃষ্ঠার এই কাব্যগ্রন্থখানির মূল্য ধরা হয়েছে ১৩৫/= (একশত পঁয়ত্রিশ টাকা মাত্র)। অত্যন্ত সহজ, সরল ও প্রাঞ্জল ভাষায় তিনি কবিতা নির্মাণ করেছেন। তবে তাঁর কবিতাগুলো গীতরসে পূর্ণ। গানের আঙ্গিকেই কবিতাবলি রচিত। বইটির প্রথম কবিতা- ‘ভালোবাসার রক্তে আগুন’ কয়েক পঙক্তি ‘পুড়ছে সময়-পুড়ছে মন/পুড়ছে ভালোবাসার সাজানো বৃন্দাবন।/তবু তার মনে প্রেমের ফাগুনÑ/দক্ষিণা মলয় হয়ে দোলা দেয় না;/চির-সবুজ মাঠের মতো সবুজ হয় না।/ কবে কার প্রেমের উষ্ণ-শীষে/ঘুম ভেঙে যায় নিশীথ বেলায়;/মেতে সেই অলীক প্রেমের খেলায়।/...আগুন ধরেছে ভালোবাসার মরুভূমি মনে;/দাউ দাউ জ্বলে রক্তে-আগুন!/পুড়ে যায় প্রেমের সাজানো ফাগুন।’ ‘প্রেমের স্বর্গ’ কবিতায় কবি স্বর্গে যেতে চাননি, তবে প্রেমের স্বর্গে যাবার তাঁর আকুতি লক্ষণীয়। ‘আমি পুণ্যের স্বর্গ চাই নে।/আমি ভালোবাসার স্বর্গ চাই।/যে স্বর্গে শুধু তুমি আর আমি;/আমি আর তুমিÑ/আর কেউ নাই।... চাই নে আমি স্বর্গে যেতে;/ ভালোবাসাই স্বর্গ আমার,/ইচ্ছে প্রেমের স্বর্গে যাবারÑ/চাই যে শুধু প্রেমের স্বর্গে পুণ্য আসন পেতে।’ কবি যারে ভালোবাসেন সে মোটেও কবিকে পাত্তা দেয় না বা পাত্তা দিতে চায় না; এমন অভিব্যক্তিই মেলে ‘ভালোবাসার দুঃখ’ কবিতায়- ‘যাকে ভালোবাসি আমি দিয়ে প্রাণ-মন/সে-তো বোঝে না মোর ভালোবাসার আকিঞ্চন/...সে-তো জানে না, তার ভালোবাসা ছাড়া;/এ দুটি আঁখি হয় নিশিথে তন্দ্রাহারা।/ ভাবনায় তার কথা সর্বদা করে ভিড়;/এ হৃদয় পুড়ে হয় চৈত্রের মাঠসম চৌচির!’ (সংক্ষিপ্ত)। কবি যেদিন পৃথিবী থেকে বিদায় নেবেন, সেদিন হয়ত তার প্রেমিকা তাঁকে বিভিন্নভাবে স্মরণ করতে পারে এমন অনুভূতি ব্যক্ত হয়েছে ‘যেদিন হারিয়ে যাব’ কবিতাটিতে (৫ম ও ৬ষ্ঠ স্তবক)- ‘যেদিন আমি হারিয়ে যাব/জাগবে নিশি একা একা;/পড়বে বসে আমার লেখাÑ/কল্পনাতে আঁকবে আমার ছবি।/ যেদিন আমি হারিয়ে যাব/শিশির ভেজা হিমেল হাওয়ায়/বসে তুমি ঘরের দাওয়ায়;/ভাববে মনে কোথায় গেলে কবি?’(সংক্ষিপ্ত)। ‘প্রেমের শিশির’ কবিতার উপমায় চমৎকারিত্ব আছে। (৩য়, চতুর্থ ও ৬ষ্ঠ স্তবক)- ‘সরোবরের টোপর পানার মতো/ভালোবাসা জমাট বেঁধেছেÑ/ তোমার প্রেমের হৃদয় পুকুরে।/... লাউয়ের ডগার মতো তোমার প্রেম/ লক লক করছে-আকশি উঁচিয়ে;/ খুজছে ভালোবাসার মাচা।/... শরতের শিশিরের মতো গড়িয়ে পড়ছে/তোমার ভালোবাসার শিশির বিন্দু।/ আর আমি ভালোবাসার মধ্য-গগনে/পূর্ণিমা চাঁদের মতোÑ/চারদিক আলো করেÑ/তোমার প্রেমের শিশির কণা খুঁজছি।’ ‘শুধু একটু ভালোবাসা চাই’ কবিতার ২য় ও চতুর্থ স্তবকে কবি বলেনÑ ‘তুমি আমার হৃদয়ের কান্না বোঝো না;/ দেখতে পাও না মনের ঘরেÑ/ভালোবাসা না পাওয়ার নীল কষ্ট;/ কেমন করে বন-পোড়ার মতো পুড়ছে।/... আমার দেহের প্রতিটি রক্ত-কণিকা আজ/ তোমার ভালোবাসার জন্য উদগ্রীব;/আমার শরীরের প্রতিটি শিরা-উপশিরা/ তোমাকে ভালোবাসতে চায়।/আমার কবিতার প্রতিটি শব্দ আজ/তোমার ভালোবাসার জন্য ব্যকুল।’ (সংক্ষিপ্ত)। ‘ভালোবাসার স্বপ্ন’ কবিতায় কবির ভাবনা (২য় স্তবক): ‘তুমি ভালোবাসার মন্ত্র পুত করে/প্রেমের দীক্ষা দিয়েছো আমার কর্ণে।/আমি তোমার ভালোবাসার মন্ত্রÑ/জপে চলেছি অহর্নিশি।’ ‘ভালোবাসা শুধু ভালোবাসা’ কবিতায় (২য়, ৩য় ও শেষ স্তবক) কবি তাঁর ভালোবাসার নারীকে প্রশ্ন করেন: ‘তুমি ভালোবাসার ডটকম খুলে/কোন সুদূরে আছো ভুলে?/ কাকে নিবেদনের প্রতীক্ষায়?... আমার ওয়েব সাইটের ঠিকানা/তোমার প্রেমের কম্পিউটারে কি ধরা পড়ে না?/ কার ভালোবাসা খুঁজে তোমার দিন যায়?... ভালোবাসা শুধু ভালোবাসা-ডিজিটাল নয়।’ ‘আকাশ আমি এসেছি’ গ্রন্থটির সর্বশেষ কবিতা (১ম ও ২য় স্তবক): ‘বলাকারা উড়ে যায় নীল আকাশে;/ আমি সাঁতার কাটি প্রেম সমুদ্রে।/তুমি চুপটি করে বসে থাকো/পৃথিবীর ভালোবাসার পুষ্পবনেÑ/স্বর্গের অপ্সরীর মতো।... শশীকলার স্বচ্ছ আলোক বিন্দু/তোমার লাবণ্যময় শরীরে প্রতিফলিত হয়।/সেরূপ ঝিলিক দিয়ে ওঠেÑ/ লবণ সমুদ্রের জলের উপরে/মৎস্যকন্যার দলের মতো।’ কবি অসিত কুমার ম-ল প্রেমের আনন্দ-বিরহ, রাগ-অনুরাগ কাব্যিক ভাষায়, ছন্দের দোলায় সাজিয়েছেন তাঁর ‘প্রেমস্বর্গ’। গীতিকাব্যের আদলে রচিত এই কাব্যগ্রন্থটি। বইটির ছাপা সুন্দর, চকচকে। কবিতাগুলো খুব বড় নয়। বইটি পরিশিলীত, পরিমার্জিত এবং সুসম্পাদিত বলে আরেকটি বিশেষ গুণ রয়েছে। শ্রাবণের বৃষ্টি ধারার মতোই, পড়লেই ভালো লাগবে। তাঁর প্রেমের কবিতাগুলো সরস রসগোল্লার মতো একটির পর একটি গিলে খেতে ইচ্ছে করবে পাঠকের। গ্রন্থটির বহুল প্রচার কামনা করি।
×