ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

গল্প ॥ জন্মান্ধ

প্রকাশিত: ১৩:৪৪, ২৩ আগস্ট ২০১৯

গল্প ॥ জন্মান্ধ

প্রবল বর্ষণ ছাড়া গ্রীষ্মের খরতাপে অথবা হাড় কাঁপানো শীতে দোচালা খড়ের ঘরটিতে আটকে রাখতে পারে না জন্মান্ধ সুনীল গায়ককে। প্রদোষের আলো ছড়ানোর সঙ্গে সঙ্গেই হেঁটে রওনা হয়ে তিন মাইল দূরের রশনীপুর রেলস্টেশনে পৌঁছায় ভোরের ট্রেনটি ধরার জন্য। এটুকু পথ শৈশব থেকে প্রথমে বাবার হাত ধরে, পরে বাবার পাশে থেকে এবং শেষে একাই রপ্ত করে স্টেশন অবধি পৌঁছাতে পারে। বাড়ি থেকে স্টেশন পর্যন্ত পথটুকুতে কোন বাঁকে কী আছে, কোথায় গর্ত, কোথায় উঁচু, প্লাটফরমে কীভাবে উঠতে হয়, প্লাটফরমের কোন কোনায় কী আছে সেসব সুনীলের নখদর্পণে। বাবার শেখানো কয়েকটি গান ও একটি দোতারাÑ এই তার পুঁজি। গানের মধ্যে মারফতি গান, শাহ আব্দুল করিমের গান, লালনগীতি, ভাটিয়ালি আর পল্লীগীতি। দোতারার তামিল বাবার হাতেই। এই পুঁজি নিয়েই জীবনসংগ্রামের প্রতিকূল ¯্রােতের বিরুদ্ধে হাঁটি হাঁটি পা পা করে সুনীল শৈশব পেরিয়ে যৌবনে পা রেখেছে। কী তার চাওয়া-পাওয়া, কী তার স্বপ্ন এসব কখনই ভাবেনি সুনীল। দুচারটি গান গেয়ে কিছু টাকা পেলে মায়ের জন্য রাতে এক সের চাল আর কিছু আনাজ-তরকারি, কদাচিৎ দুয়েকদিন মাছ কিনে নিতে পারলেই তার জাগতিক দেনা মিটে। মায়ের হাতের মাছের ঝোল দিয়ে রাতে তৃপ্তিসহকারে খেয়ে নিñিদ্র ঘুম দিতে পারে তখন তার চেয়ে সুখী আর কে? এমন দিনে মায়ের সঙ্গে গল্প করে, আইজ একজনে দশ ট্যাহা দিয়া দিল। এই দুনিয়াতে ভালা মাইনষের অভাব নাই। ছেলের কথা শুনে মা আঁচলে মুখ ঢাকে, সুনীল দেখতে পায় না। মায়ের মুখ থেকে একটা প্রশংসা, কিছু ভালো কথা শোনার সে অপেক্ষা করে। মুখ থেকে আঁচল নামিয়ে মা বলে, ভালা মানুষ আছে তাই আমরা বাঁইচা আছি। দশ ট্যাহা তো কম কথা নয়। কয়জনের দিলে কুলায় এত ট্যাহা দিতে? আর যেদিন শুধু সামান্য চাল আর সামান্য সবজি কিনে বাড়ি ফিরে সেদিনও মায়ের মুখে হাসি ফুটাতে সুনীল কায়দা করে কথা বলে। মা, আইজ গান গাইতে মন চায় নাই। আর মাছের তরকারি খাইতেও মন চায় নাই। মাঝে মাঝে তো শাক-শুঁটকিও খাইতে হয়, তাই না মা? মা জানে ছেলের এই ছলনার মানে কী? আজকে ওর রোজগার ভালো হয়নি। বুক ভরে কান্না আসে। ভেজা চোখ মুছে শান্ত গলায় বলে, কয়ডা দিন বিশ্রাম নে রে পুত। প্রতিদিন এত দূরের পথ...। ঘরে মন বসে না মা। যখন ট্রেইনে ঘুইরা বেড়াই, পেসেঞ্জারদের গান শোনাই, কেউ যখন কয় আরও একটা গান গাও সুনীল তখন মনে হয় আমি বড় শিল্পী। মনডা তখন ভরে যায় আনন্দে। তোর নামও জানে? জানবো না আবার? হে হে হে। জানো মা, আমি খুব কায়দা করে নিজের নাম গানের ভিতরে ঢুকাই দেই। কেমনে? গানের শেষে যেখানে আছে ‘করিম বলে’ সেখানে আমি বলি ‘সুনীল বলে’... কথা শেষ না করেই অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে সুনীল। মাও হাসে। বড় সুখের হাসি। ছোট্ট ঘরটায় ভরাট স্তব্ধতা ভেঙে খান খান হয়ে যায় মা-ছেলের উচ্ছ্বাসের ঢেউয়ে। সেই ছোটবেলা থেকে ট্রেনে চলছি, সবাই আমারে চিনে। কেউ কেউ আমারে ডাইক্যা কয়, সুনীল আইজ অমুক গানটা শোনা। এসব কথা মনে অইলে কি আর ঘরে থাকন যায় মা? মা কোনো উত্তর দেয় না। নিশুতি রাতের নৈঃশব্দ্য, নিবাত অন্ধকারে ঢাকা গ্রামগুলো। কোথাও কোথাও জোনাকি পোকারা আলো জে¦লে উড়ে বেড়ায়। পেঁচার ডাক শোনা যায় মাঝে মাঝে। গভীর রাতে পেঁচার ডাক শুনলে মা কুপি বাতিতে হলুদ পোড়ায় আর বলে, দূর যা। দূর যা আপদ। পেঁচার এমন ডাক নাকি কুলক্ষণে। মায়ের অনেক সংস্কার, ধর্মকর্ম থাকলেও সুনীল সেসব কিছু বোঝে না। দুবেলার আহার জোগাড় করতে পারলেই নিজেকে ধন্য মনে করে। হতদরিদ্র মানুষের জীবনে দুবেলা দুটি ভাত, আব্রু ঢাকার মোটা কাপড়ের বাইরে আর কী-ই-বা চিন্তা করতে পারে। গানই জীবন, গানই মরণ... দীর্ঘশ^াস ফেলে সুনীল। কৈশোর পেরিয়ে যৌবনে পা রাখার পরে সুনীল বাড়িতে মায়ের কাছে পান চায়। মাও পান বানিয়ে দিয়ে নিজেও খায়, ছেলেকেও দেয়। রশনীপুর স্টেশনে কুলিদের সঙ্গে মেলামেশা করে সিগারেটও খাওয়া শিখেছে। তবে বাড়িতে মাকে সমীহ করার জন্য সিগারেট টানে না। ভাত খাওয়ার পার চান চিবোয়। সুনীলের বিছানাটা ঠিক করে দিয়ে মা পাশের আরেকটা চকিতে শোয়। দোতারাটা থাকে সুনীলের শিয়রেই। সুনীলকে শুইয়ে দিয়ে মা কুপিবাতি নিভায়। সুনীলের কাছে কুপির আলো আর অন্ধকারের মধ্যে কোনো তফাৎ নেই। তবু সে অনুমান করতে পারে ঘরের সামান্য আলোটুকু নিভিয়ে মা শুয়েছে। মায়ের কথা ভাবলে বুকের ভেতরটা হো হো করে সুনীলের। মনে মনে বলে, আমি জন্মান্ধ আর আমার মা জনমদুখী। বারো বছর বয়সে বিয়ে হয়েছিল মায়ের। মায়ের মা দ্বিতীয় সন্তান প্রসব করার সময় মারা গেল। বাবার আদরে বারো বছর হতেই বিয়ে। আর বিয়ের বারো বছরের সময় আমাকে নিয়ে মা একা হলো। আহা! তখন নিজের কথা ভাবতে ভালো লাগে না সুনীলের। শুধু মায়ের কষ্টের কথা ভেবে অন্তরাত্মা কান্নাসিক্ত হয়। যতদিন মা আছে ততদিনই সুনীলের জীবন সুখের। এরপর কী হবে কে জানে? এতকিছু ভাবতেও চায় না সুনীল। সারা দিনের ক্লান্তিতে শরীরটা কাদার তাল হয়ে থাকে, বাঁধভাঙা ঘুমে আচ্ছন্ন হয়। সকালে নাশতা খাওয়ার জন্য মাকে আর বিরক্ত করতে ইচ্ছে করে না সুনীলের। নাশতা না খেয়েই বাড়ি থেকে বের হয়ে স্টেশনে এসেই দোলনের চায়ের স্টলের বেঞ্চিতে বসে এক কাপ চা আর একটি টোস্ট বিস্কুট খেয়ে শুরু করে দিনের কাজ। দোতারাটি কাঁধে নিয়ে স্টেশনে বসে মাঝে মাঝে টুনটুন করে তার ঠিক করে। তারপর ট্রেন এলে উঠে যায়। চলে যায় দূরের জংশনে, সেখানে দুপুরে কোনো দিন ভাত খায়, কোনো দিন পাউরুটি আর কলা খাবার খেয়ে ফিরতি ট্রেনেই গান গাইতে গাইতে বাড়ি ফিরে সন্ধ্যায়। ট্রেনের লেট হলে রাতে। ট্রেনের অনিয়মের কারণে সুনীল মাঝে মাঝে বাড়ি ফিরে না। কোনো স্টেশনের প্ল্যাটফরমেই ঘুমিয়ে রাত কাটিয়ে দেয়। আবার কখনও ট্রেনেই চলে যায় দূর-দূরান্তে। নাম না জানা কত জায়গায় ঘুরে বেড়ায় সুনীল। মানুষের কাছে হাত পাতে, দয়া করে জন্মান্ধকে কিছু সাহায্য করুন। হাতে কাগুজে নোটের স্পর্শ লাগলে মুখে হাসির জৌলুস ছড়ায়। আর টাকার স্পর্শ না পেলে মলিন মুখেই অন্য বগিতে আবার শুরু করে গান। যাত্রীদের মধ্যে কখনও সঙ্গীতপাগলের সঙ্গে দেখা হলে একাধিক গান গাইতে হয়। শরীরটা বদলেছে সুনীলের। এখন ওর মুখে দাড়ি-গোঁফ। চার বছর আগে বাবা মারা গেছে। শুধু মায়ের অপেক্ষার কোনো পরিবর্তন হয়নি। শরীর বদলালে মনোজগতেও অনেক ভাবনা কিলবিল করে। ট্রেনের অপেক্ষায় যখন বেঞ্চিতে বসে থাকে তখন কান্দু কুলি এসে সুনীলের পাশে বসে। আর কত কথা! কান গরম হয়ে যায়। এসব কথা সুনীলের শুনতে ভালো লাগত না কিছুদিন আগেও। জন্মান্ধ বলে হীনম্মন্যতায় ভুগত। এখন শরীরে শিহরণ জাগে তা সুনীল অনুভব করতে পারে। চায়ের স্টলের পাশেই এক কিশোরী ভিক্ষে করে। ওর একটা পা চিকন। শরীরটাও লিকলিকে, রোগা। রুক্ষ এলোমেলো চুল। দাঁদের গোড়ায় হলদেটে ময়লা। লাঠিতে ভর করে হাঁটে। সকালে ওর নানি ওকে স্টেশনে দিয়ে যায়, সারাদিন ভিক্ষা করার পর সন্ধ্যায় এসে নিয়ে যায় বাড়িতে। কান্দু কুলি রেশমীর সঙ্গে বেশ জমিয়ে কথা বলতে চায়। সুনীলকে ডেকে কাছে নিয়ে গান শোনায়। রেশমীর শরীরেও পরিবর্তন এসেছে। সুনীলের গান শুনে ভাবালুতায় ডুব দেয়। কান্দু কুলির দৃষ্টি তখন থাকে ছেঁড়া জামার ফাঁক-ফোকরে। রেশমীর মেজাজটা এত খিটখিটে যে কান্দু কুলি মাঝে মাঝে কাছে ভিড়তে পারে না। কান্দুর তাছিরও খারাপ। সে শরীরের সঙ্গে মিশে বসে কথা বলতে চায়। রেশমী কি তাহলে বুঝতে পারে কান্দুর কুমতলবের কথা? না-হয় কেন তিরিক্ষি মেজাজে বলে, এই হারামাজাদা ফকিন্নির পোলা, শইলের লগে ঘষলাইতে আইয়োছ ক্যান? খিঁচানো মেজাজে কান্দু কুলিও বলে, এই হারামজাদী, আমি ঘসলাইছি কই? ফহিন্নি তো তুইন। আমি কাম কইর‌্যা খাই। তুর মতোন ভিক্ষা করি না। মুখ দিয়ে কথা বললেও মগজে তেজ টগবগ করতে থাকে কান্দুর। তখন ইচ্ছে হয় ওর মাথাটা চিবিয়ে খায়। যদি প্ল্যাটফরমে মানুষ না থাকত তাহলে হয়তো একটা কিছু করেই বসত। রেশমীই বা ছাড় দিতে যাবে কেন? হ। ভিক্ষা কইর‌্যা খাই। তুর বাপের তালুকে ভিক্ষা করি, হা। কান্দুর বড় জেদ হয়। পাছে মানুষের ধোলাই খায় কিনা কে জানে? তাই দূর থেকে দুয়েকটা তাতানো কথা শুনিয়ে অন্যদিকে চলে যায়। দিনের পর দিন রোজগার কমে যাচ্ছে সুনীলের। এখন ট্রেনে ওঠার সময়ই বুকের ভেতরটায় চিন চিন করে। মানুষ আর আগের মতো গান শুনতে চায় না। কেন? গান কি ভালো হয় না? এই রহস্য কি সে জানে? পৃথিবীর সবকিছুই বদলে যাচ্ছে, কী করে বুঝবে জন্মান্ধ সুনীল? কিছুটা অনুমান করে সুনীল। গত বছর এক ছেলে ট্যাপরেকর্ডার বাজিয়ে গান শুনিয়ে ভিক্ষা করছিল। ভিক্ষাও যে ডিজিটাল হয়ে গেছে সে বার্তা সুনীলের কাছে নেই। সেই ছেলের সঙ্গে সেদিন খুব ঝগড়া হয়েছিল সুনীলের। সুনীল রূঢ়ভাবে বলেছিল, আমি যেহানে যাই তুই মরতে আইয়োছ ক্যান? অন্য বগিত যাইতে পারোস না? এই গাতকের ঘরের গাতক, টেরেইন কি তোর বাপের? আমার যেহানে খুশি যামু। তোর তাতে কী? আরও দুয়েক কথায় সুনীলকে ওই ছোকড়াটা মারধর করেছিল। স্টেশনের মানুষ না ফিরালে হয়তো সুনীলের বড় ক্ষতিই করত সে। রোজগারের ভাটা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে সুনীলের আনন্দের গাঙও যেন শুকিয়ে যেতে শুরু করে। মায়ের বাতের ব্যথায় সারাক্ষণই কুঁকায়। একটু চিকিৎসা করবে সে টাকাটাও জোগাড় করতে পারে না। কোনো দিন নিজের খাওয়ার টাকাটাও হাতে আসে না। খড়ের চালাটা বদলানো হয়নি বলে বর্ষায় ঘরে পানি পড়ে। নিত্যদিনের এত হাহাকার নিয়ে সুনীল কী করে ভালো থাকে? মাঝে মাঝে ট্রেনে চড়লেও গান গাইতে ইচ্ছে করে না। মনমরা হয়ে বসে থাকে ট্রেনের গেটের পাশে। সেদিন বাড়িও ফিরে না। ট্রেনে চেপে দূরে কোথাও চলে যায়। ফিরে আসে দুদিন পর। আজকে ট্রেন কখন আসবে কেউ বলতে পারে না। সেই সকাল থেকে বেঞ্চিতে বসে আছে সুনীল। জরাগ্রস্ত শরীরে যেন অবিনাশী শ্রান্তি ভর করেছে। তন্দ্রাচ্ছন্ন সুনীলের পাশে বসে কান্দু কুলি বলল, যুগ পাল্টে গেছে রে সুনীল। হ, মানুষ গান হুনে না। গানের কি আকাল? মানুষের হাতে হাতে গানের বাকশো। কত হুনবো? গান ছাড়াও আরও... মুদ্রণ অযোগ্য বার্তা দিল সুনীলের কানে। সুনীল হতভম্ব হয়ে শুনে আর আফসোস করে। হায়! হায়! বুকের ভিতর হাহাকার করে। মোবাইল জিনিসটা একবার যদি দেখতে পারতাম, আহা! কান্দুর মোবাইল ফোন সেটটি সুনীলের হাতে দিয়ে বলে এইডা দিয়া কথা কওন যায়। গানও হুনন যায়। তয় ভালা ফোন অইলে... মুদ্রণ অযোগ্য কথা বলে কান্দু। কান্দুর স্বভাবই এমন। অশ্লীলতা যেন ওর সব কথার এপিঠ-ওপিঠ। কান্দু মোবাইল থেকে একটি গান বাজিয়েও শোনায় সুনীলকে। সেদিন থেকেই সুনীলের ভেতরটা অর্ধেক মরে যায়। মাঝে মাঝে বুকের ভেতর থেকে তেজ উঠে ভালো করে গান গাওয়ার জন্য, চেষ্টা করে, আবার সেই চেষ্টা নিভে যায় মুহূর্তেই। কালবৈশাখীর প্রমত্ত ঝড়ের আভাস। গুরু গুরু মেঘ ডাকছে। মেঘের ঘনঘটায় বিকেল থেকে যেন অমবস্যার দুর্ভেদ্য অন্ধকারে ঢেকে গেছে। আকাশের এমন ভয়ঙ্কর সুন্দর রূপ দেখার সুযোগ নেই সুনীলের। তবে হিম বাতাস ক্রমে প্রবল থেকে প্রবলতর হয়ে শোঁ শোঁ শব্দে বইতে শুরু হয়, মেঘের গুরুগম্ভীর নিনাদে চমকে ওঠে সুনীল। মানুষের হুড়োহুড়ি, ছোটাছুটি, চেঁচামেচি শব্দ থেকে সহসাই ঠাওর করে সুনীল, বড় ধরনের ঝড় হতে যাচ্ছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ঝড়োবাতাসে যেন প্রকৃতি ল-ভ- করে দিচ্ছে এমনই অনুমান করে সুনীল। প্ল্যাটফরমে ছাদ আছে, চায়ের দোকানগুলো বন্ধ, স্টেশন মাস্টারের রুমের দরজা বন্ধ। সুনীল সেইসব রুমের কোনো এক কোনায় দাঁড়িয়ে বৃষ্টির ছাট থেকে শরীরটা বাঁচায়। একবার অনুভব করে তার পাশে রেশমী কচকচ করছে। আহা রে মেয়েটা হয়তো আইজ বাড়িত যাইতে পারবো না, অনুচ্চারে আক্ষেপ করে সুনীল। আজকে সুনীলের রোজগার বলতে পাঁচটি টাকা। মন খুবই বিষণœ। রেশমীর সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। রেশমীরও তাই। নানি আসেনি। রাতে এখানেই থাকতে হবে। রাতে খাবারের মতোও কিছু নেই। চায়ের স্টলের মালিকেরা চলে গেছে ঝড়ের আভাস পেয়ে। দু’জন মানুষ পাথরের মূর্তির মতোই পাশাপাশি দাঁড়িয়ে থাকে ঝড়োবৃষ্টি থেকে বাঁচার জন্য। স্টেশন মাস্টারের কথা শোনা যায়, টেলিফোনে কথা বলছেন। খিঁচুরি রান্না করো। ইলিশ মাছ ভাজা আর মুরগির ভুনা। জিভে পানি আসে সুনীল আর রেশমীর। এমন খাবার কি ওরা জীবনে কোনোদিন খেয়েছে? স্মৃতির খাদে হাতড়িয়ে দেখে না। পাতলা খিচুরি খায় ওরা। ইলিশ মাছের নাম শুনেছে কিন্তু এর কী স্বাদ তা ওরা জানে না। ঝড়বৃষ্টি থামতে থামতে অনেক রাত। রেশমীকেও নিতে আসেনি ওর নানি। সুনীলও আর বাড়িতে যেতে সাহস পায়নি। মায়ের জন্য মনটা খুব খারাপ হলেও নিরুপায় সুনীল জনশূন্য স্টেশনের বেঞ্চিতে ঘুমানোর জন্য শুয়ে পড়ে। ঝড়ের কারণেই লোড শেডিং। সারারাত। দুর্ভেদ্য অন্ধকারে ভয়াল নৈঃশব্দ। হিম বাতাসে বেশ শীত লাগছে। সুনীল লুঙ্গিটা গলা পর্যন্ত ছড়িয়ে শুয়ে থাকে। একটা অপরিচিত কুৎসিত শব্দ শুনতে পায় সুনীল। বড় অচেনা শব্দ। দক্ষিণ পাশের একটি পাথরের বেঞ্চিতে শিয়রে দোতারাটা রেখে কখন যে ঘুমিয়ে যায় সুনীল টের পায়নি। টের তখনই পায় যখন তিনজন পুলিশ কনস্টেবল এসে হাতকড়া পরায়। হাতকড়া কী সুনীল জানে না। চারপাশে অনেক মানুষের ভিড়। কেউ কেউ হায় হায় করছে। তীব্র নিন্দা আর ধিক্কার দিচ্ছে সুনীলকে। এই শালা কানায় এই কাম করল? ছি। ছি। কিছু মানুষের মনে আক্ষেপ, কিছু মানুষের খিস্তি খেউড়। আর সুনীলকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে কনস্টেবলরা। আমার দোতারা? এই শালা বদমাইশ। চল আগে। আবার দোতারা ফলাছ! একটি গাড়িতে উঠছে সুনীল। ঘড়ঘড় করে গাড়িটি এগিয়ে যাচ্ছে। গাড়িতে কেউ কথা বলেনি সুনীলের সঙ্গে। খুনির সঙ্গে কী কথা বলবে? রেশমীকে ধর্ষণ করে সুনীলই যে হত্যা করেছে তার প্রমাণের জন্য খুব বেশি দূর যেতে হয়নি। সুনীলের দোতারা দিয়ে মাথায় আঘাতের ফলেই রেশমী নামের কিশোরীটির মৃত্যু হয়। দোতারাটা সেখানেই ছিল। স্পষ্টই বোঝা যায়। তাছাড়া কান্দুও সাক্ষ্য দিয়েছে সুনীলের সঙ্গে রেশমীর বড় ভাব আছিল। ওইদিন স্টেশনে সুনীল গাতক ছাড়া আর কেউই স্টেশনে আছিল না। মহামান্য আদালত সুনীলের পক্ষে কোনো উকিল পাননি। হয়তো সুনীলের মা উকিলের টাকা জোগাড় করতে পারেনি অথবা ছেলের নিরুদ্দেশের কারণও জানে না। মহামান্য আদালত রায়ে বলেছেন, রেশমী নামের এক প্রতিবন্ধী কিশোরীকে ধর্ষণের পর হত্যা করেছে আসামি সুনীল রায়। সাক্ষ্য দ্বারা প্রমাণিত হওয়ায় এবং বিবাদীর পক্ষে কোনো উকিল না পাওয়ায় আসামিকে যাবজ্জীবন কারাদ- দেয়া হলো। মামলার ধারায় আসামির সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদ-ই প্রাপ্য ছিল কিন্তু দৃষ্টি প্রতিবন্ধী হওয়ায় সাজা কিছুটা মওকুফ করে যাবজ্জীবন বিনাশ্রম কারাদ- প্রদান করা হলো। আদালতের আর্জি অনুযায়ী সুনীল বলল, বিচারক সাব, আমি জন্মান্ধ। কোনো দিন মানুষ দেখি নাই। আপনের রায় শুইন্যা মনে অইল আপনেও অন্ধ। আমি যেমন মানুষ দেখি না, আপনিও তেমনি আসামি দেখেন না। আদলতকক্ষটি অকাট্য স্তব্ধতায় ডুবে যায় ঢেকে যায়। ‘তুমি জন্মান্ধ, আমি আইনান্ধ’, মুহ্যমান মহামান্য আদালত অস্ফুট উচ্চারণে বলতে বলতে এজলাশ ত্যাগ করেন।
×