ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

আলী যাকের

মধ্যাহ্ন, অপরাহ্ণ!

প্রকাশিত: ১৩:৪৫, ২৩ আগস্ট ২০১৯

মধ্যাহ্ন, অপরাহ্ণ!

পর্ব-৩৭ এর পরে নানাবিধ ঘাত ও প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে বংলায় নাটক চলতে থাকে। সাধারণ রঙ্গালয়, ১৮৭৫-এর পরে কলকাতা শহরে, ক্রমশ জনপ্রিয়তা অর্জনের কারণে বাণিজ্যিক রূপ পরিগ্রহ করে। শুরুতে নারী চরিত্রে তরুণ পুরুষেরা অভিনয় করলেও আস্তে আস্তে নারীদের আগমন ঘটে এবং এদের আগমন ঘটে সাধারণত উত্তর কলকাতায় অবস্থিত নিষিদ্ধ পল্লী থেকে। এদেরই মাঝে অনেকেই অভিনয়কে সত্যিকারের ভালবেসেই মঞ্চে প্রতিষ্ঠিত হন। ‘বিনোদিনী দাসী’ এ রকমই একজন ছিলেন যাকে পথপ্রদর্শক হিসেবে চিহ্নিত করেন নাট্যবিশারদগণ। ওই সময় যদিও জমিদারদের বাগানবাড়িতে কিংবা প্রাসাদ প্রাঙ্গণে নাট্যাভিনয় হতো মনোরঞ্জনের জন্য, অচিরেই আমরা পেশাদারিত্বের আবির্ভাব দেখি নাট্যালয়ে। এ বিষয়ে অবশ্য কলকাতার প্রতিষ্ঠিত মাড়োয়াড়ি ব্যবসায়ীরা অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। প্রথমে অপেশাদারী মনোভাব নিয়ে শুরু হলেও ১৮৭৫-এ মাড়োয়াড়ি ব্যবসায়ীদেরই প্রচেষ্টায় প্রতিষ্ঠিত হয় সাধারণ রঙ্গালয় এবং দর্শনীর বিনিময়ে নিয়মিত নাটকাভিনয়ের সূচনা ঘটে। কেননা তারা মঞ্চনাটক নিয়ে সফল ব্যবসার সম্ভাবনা দেখেছিলেন। যাহোক, এ কথা অনস্বীকার্য যে প্রায়োগিক শিল্পকলা হিসেবে নাটক প্রতিষ্ঠা পায় কলকাতাতেই প্রথম তবে এও উল্লেখযোগ্য যে বাংলাদেশের বিভিন্ন শহর-উপশহরে পূজা কিংবা অন্যান্য উৎসবের সময় নাটক অভিনয় হতো নিয়মিত। সাধারণত দুর্গা পূজার সময় কলকাতা থেকে তরুণেরা ফিরে আসত গ্রামবাংলায় এবং তাদেরই প্রচেষ্টায় বিনোদনের জন্য নাট্যাভিনয় হতো পূজাকে কেন্দ্র করে। আমরা বিংশ শতাব্দীর শুরু থেকেই বাণিজ্যিক থিয়েটার প্রতিষ্ঠিত হতে দেখি নগর কলকাতার সাধারণ রঙ্গালয়ে। যে নাটকটি দিয়ে সাধারণ রঙ্গালয়ে নিয়মিত ভিত্তিতে দর্শনীর বিনিময়ে নাটকাভিনয় শুরু হয় ১৮৭৫-এ সেটি হলো দীনবন্ধু মিত্র রচিত ’নীল দর্পণ’। সাধারণ রঙ্গালয়ে নীল দর্পণের অভিনয় প্রায় ব্রিটিশ আইন ভঙ্গ করার মতোই অপরাধ হিসেবে ধরে নেয় তৎকালীণ প্রশাসন এবং নাট্যকার-অভিনেতাদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারী পরোয়ানাও জারি করা হয়। এরই ফলে আমরা পরবর্তীতে একটি নিবর্তনমূলক আইনের উদ্ভাবন দেখতে পাই। এই আইনটির শিরোনাম ছিল ‘অভিনয় নিয়ন্ত্রন আইন।’ আমরা এই আইনেরই বিধিনিষেধ মান্য করে আমাদের নাট্যচর্চা চালিয়ে যেতে থাকি। বাংলাদেশের স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধুর এক নির্দেশে এই আইনটিকে রদ করা হয়। আমাদের ঢাকায় তথা বাংলাদেশে দর্শনীর বিনিময়ে নিয়মিত নাটকাভিনয় শুরু হয় ১৯৭৩-এর ৩ ফেব্রুয়ারিতে। নাটকটির নাম ছিল ‘বাকি ইতিহাস’। নাট্যকার : বাদল সরকার। এই মঞ্চপরিক্রমা শুরু করে, ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত একটি দল, নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়। পর পর আট রবিবার সকালে ব্রিটিশ কাউন্সিল মঞ্চে এই নাটক অভিনীত হয়। তারপর ব্রিটিশ কাউন্সিলের মঞ্চায়ন বন্ধ করে দেয়া হয় পরীক্ষার কারণে। সেই সময়ে, বেইলি রোডের ‘মহিলা সমিতি মঞ্চ’ আবিষ্কৃত হয় এবং সেখানেই চলতে থাকে নিয়মিত নাটক মঞ্চায়ন। আমরা যারা শুরু থেকেই দর্শনীর বিনিময়ে নাটক মঞ্চায়নের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলাম তারা প্রতিনিয়ত নানারকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতাম নাটক নিয়ে। সেই সময় যেমন সমসাময়িক বাস্তববাদী নাটক মঞ্চায়ন করেছি আমরা তেমনি ধ্রুপদী এবং অবাস্তব-অসংলগ্ন নাটক নিয়েও যথেষ্ট পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়েছে। আমাদের কিছু অগ্রণী নাট্যকার যেমন সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্, সাইয়্যীদ আহ্মেদ, জিয়া হায়দার এরা এই নাট্যধারা নিয়ে যথেষ্ট পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন। সেই সময় বহিপীর, লালসালু, কালান্তর, মাইলপোস্ট কিংবা শুভ্রা; সুন্দর; কল্যাণী; আনন্দ এসব নাটকে বিস্তর আলোচিত হতো। ১৯৭৩-এ আমরা যখন নাটক শুরু করি তখনও কোন নাট্যরীতি প্রতিষ্ঠা পায়নি। তাই আমাদের সুযোগ ছিল ফর্ম এবং কনটেন্ট নিয়ে নানাবিধ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার। অতএব এ নিয়ে যেমন যথেষ্ট অবিমৃষ্যকারিতা হয়েছে তেমনি দু’-একটা ভাল কাজও যে হয়নি তা নয়। সেই শুরুর সময় থেকে, আজ এতদূরে এসে, নানা রকম মেধা উদ্বুদ্ধ আলোচনা করা সহজ বৈকি কিন্তু সেই সময় এত ভেবেচিন্তে কোন কাজ করা হয়নি। আমরা যারা এই চর্চার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলাম তারা একটি চলমান প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত ছিলাম বিধায় সর্বদাই সৃজনশীলতার উত্তেজনায় টগবগ করে ফুটতাম। লক্ষ্য করা সম্ভব হবে যে, বাংলাদেশে নিয়মিত নাটক মঞ্চায়নের শুরু যে নাটক দিয়ে সেটি খুব একটা বাস্তববাদী ছিল না। অনেকে তো একে অধিবাস্তববাদী নাটক হিসেবেই আখ্যায়িত করে থাকেন। এর পর পরই সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্র বহিপীর, সাইয়্যীদ আহ্মেদের মাইলপোস্ট, আলবেয়র কাম্যূর ক্রসপারপাস ইত্যাদি বাস্তববাদী নাটক ছিল না। একই সময় ঢাকা থিয়েটার মঞ্চায়িত সংবাদ কার্টুন একটি গতিশীল ন্যারেটিভ ধারার সৃষ্টি করে। আমাদের একটা সুবিধা ছিল এই যে আমরা যখন নাট্যচর্চা শুরু করি তখন বিশ্ব নাটক, কি চিন্তায়-কি প্রতিপাদ্যে অনেকদূর এগিয়ে গেছে। আমাদের কাজকর্মের দ্বারা এই সময়টিকে আমাদের ধরে ফেলার ব্যাপার ছিল।
×