শ্রী কৃষ্ণের জন্মজয়ন্তী আজ

কৃষ্ণ চরিত্র মহাবিশ্বের মহাবিস্ময়। অখন্ড ধর্মীয় ভারতের রূপকার কৃষ্ণ। অন্তত সাড়ে তিন হাজার বছর পূর্বে ভারত সভ্যতার যিনি বিকাশ ঘঠিয়েছিলেন। জীবনব্যাপি সাধনার দ্বারা কৃষ্ণ ভারতীয় সভ্যতার শুধু জন্মই দেননি তার ভালে যৌবনের জয়টিকাও পরিয়ে দিয়েছেন। আজ তার জন্মেৎসব। কৃষ্ণের জন্মজয়ন্তীকে বলে জন্মাষ্টমী। “জন্মাষ্টমী” না’ হয়ে “কৃষ্ণাষ্টমী’ হলেই ভাল হতো তাহলে কৃষ্ণের সাথে অষ্টমীর যুগোল বন্ধন হয়ে কৃষ্ণের জয় ঘোষণা করতো। যেমন রাধাষ্টমী। রাধাষ্টমী শব্দের ভিতর দিয়েই রাধার জন্মের উৎসব সূচিত হয়-নতুন করে ব্যাখ্যার প্রয়োজন হয় না। জন্মোৎসবে জীবনও কর্মের উপর আলোচনা করাই সঙ্গত। শ্রী কৃষ্ণের জন্ম ও কর্ম অভিনব ও অসাধারণ। ভাদরের আদরে কৃষ্ণের জন্ম হলেও সে রাতটি ছিল ভয়াবহ-ঝঞ্জা বিক্ষুদ্ধ বিদ্যুৎ চমকিত। কৃষ্ণের জন্ম হয়েছিল কংসের কারাকক্ষে। সংসারে ও সমাজে একটি সন্তানের জন্ম হলে সেটি উৎসবে পরিণত হয়। চারিদিকে ললনাগণের উলুধ্বনি ও মঙ্গল পক্ষ বাজতে থাকে। কৃষ্ণের জন্ম সময়ে কোন উলুধ্বনি হয়নি কোন মঙ্গলশঙ্খ বাজেনি। বেজেছিল। বৃষ্টি উলুধ্বনি দিয়েছিল। আর বিদ্যূৎ বাজিয়েছিল মঙ্গলশঙ্খ। তাই কৃষ্ণ জনমদু:খী। কিš‘ কৃষ্ণ শুধু নিজের জীবনের নয় জগৎ জনের দু:খও মোচন করেছিলেন। কৃষ্ণের ইতিহাস বিজয়ের ইতিহাস। কৃষ্ণের জীবনে পারিবারিক,সামাজিক, পারিবেশিক ও রাষ্ট্রীয় ঝড় ও দু:খ নেমেছে। কৃষ্ণ কোন দু:খকেই এড়িয়ে যেতে চেষ্টা করেননি বরং সকল দু:খকে বুক পেতে গ্রহন করেন এবং ¯ি’র হয়ে তার সুষ্ঠু সমাধান দিয়েছেন। সমস্যা থেকে পালিয়ে গেলে সমস্যা কমে না বরং বাড়ে, জড়িয়ে ধরে। কৃষ্ণ তাই কোন সমস্যা থেকে পালিয়ে যাননি। বীর বিক্রমে সম্মুখে এগিয়ে গিয়ে তার সমাধান করেছেন। বাল্যকালেও কৃষ্ণের জীবনে জীবনঘাতী ঘটনা ঘটেছে। কংসবধ থেকে কুরুক্ষেত্র পর্যন্ত কৃষ্ণের জীবনে নেমেছে কঠিন ঝড়। বীরত্ব বীরত্ব বিশেষত তীক্ষè বুদ্ধিমত্তা দিয়ে কৃষ্ণ এসব ক্ষেত্রে বিজয় ছিনিয়ে এনেছেন বিশেষত কুরুক্ষেত্রের বিজয় কৃষ্ণকে ভারতের অদ্বিতীয় ভাবমূর্তিতে প্রতিষ্ঠিত করেছে। কংসের কারাকক্ষে জন্ম হলো কৃষ্ণের। প্রকৃতি অস্বাভাবিক। ঝড়-বৃষ্টি বিদ্যুৎপাত। পূর্ব প্রতিশ্রƒতি মোতাবেক বসুদেব সদ্যজাত শিশুকে নিয়ে চললেন কংসের আগারে। দৈবকী বললেন হে আর্য, প্রতিশ্রুতি মোতাবেক তুমি (বসুদেব) সাতটি সন্তানকে কংসের হাতে তুলে দিয়ে সত্য ধর্ম রক্ষা করেছ কিš‘ একটি ধর্ম রক্ষা হয়নি। সেটি পিতৃধর্ম। সন্তানকে সর্বতোভাবে রক্ষা করাই পিতৃধর্ম তুমি অনেক বার কংসের হাতে সন্তানকে তুলে দিয়ে সত্য ধর্ম পালন করেছ কিš‘ একটি সনির্বদ্ধ প্রার্থনা তুমি এই সন্তানটিকে কংসের হাত থেকে রক্ষা করে অন্তত একটিবারের জন্য পিতৃধর্ম রক্ষা কর। প্রিয়তমা স্ত্রী সদ্য প্রসাধনী দৈবকীর কাতর প্রার্থনায় বসুদেবের চিন্তায় মোড় খেল, সত্যিই তো, আমি একটি সন্তানকেও যমের করালগ্রাস থেকে রক্ষা করতে পারলাম না। এটি কি পিতার কর্তব্য। হ্যাঁ দৈবকীর কথাই ঠিক। এই সন্তানটিকে নিষ্ঠুর যম কংসের হাত থেকে রক্ষা করে অন্তত একবার পিতৃধর্মকে রক্ষা করি। বসুদেব মুখ ফেরালেন। কংসের গৃহাভিমুখ থেকে গোকুলের দিকে। গোকুলে রয়েছে বসুদেবের কাকাতো ভাই নন্দ। নন্দ বসুদেবের ভাই। তাছাড়াও পূর্বপরীক্ষিত। বসুদেবের প্রথমা স্ত্রী রোহিনী পুত্র বলরামকে নিয়ে নন্দের আশ্রয়েই তো আছে। অতএব কাল বিলম্ব না করে বসুদেব পুত্রকে নিয়ে নন্দের গোকুলেই রওনা হলো। ওদিকে গোকুলে নন্দের স্ত্রী যশোদা একটি কন্যা সন্তান প্রসব করেছে। বসুদেব নন্দের সহায়তায় নিজ পুত্রকে যশোদার কাছে রেখে যশোদার কন্যাটিকে নিয়ে মথুরার দিকে যাত্রা করলেন। তখনও প্রকৃতি অশান্ত। ভোর হয়নি, পাখি ডাকেনি। কংস কন্যাটিকে পেয়ে দুহাত ধরে পাষাণে আছাড় মারলেন। কন্যাটি কিš‘ কংসের হাত থেকে পিছলে আকাশের দিকে উঠে গেল। যাবার সময় বলে গেল ‘আমারে মারিলি তুই, তোরে মারিবে যে, গোকুলে বাড়িছে সে। কংস প্রশ্ন করলেন গোকুলে কে বাড়ছে, তাকে নিধন করার জন্য? খোঁজ খোঁজ তাকে হত্যা করতে হবে। চারিদিকে কংসের সেনারা বেরিয়ে পড়ল। কংসের মন্ত্রক নারদ ব্যস্ত হয়ে পড়ল। মথুরার চারিদিকে বিশেষত গোকুলে কঠিন তল্লাশি চলতে লাগল। কৃষ্ণকে খুঁজতে গিয়ে হাজার হাজার শিশুকে হত্যা করল কংসের সৈন্যরা। কৃষ্ণকে নিয়ে নন্দ পালিয়ে গেল বৃন্দাবনের মাঠে। রাজধানীর সন্তান রাজার সন্তানকে বনবাসে বাস করতে হলো। কৃষ্ণ নিজের গুনে বনবাসকে নিজবাস করে নিল। কৃষ্ণের কত বন্ধু কত শখা কত খেলার সাথী। প্রতিদিন নতুন নতুন খেলা খেলে গোধন চড়িয়ে কৃষ্ণের সময় কাটে। গোকুলে একটি বাৎসরিক প্রথা ছিল। ইন্দ্রপ্রজা। পয়লা বৈশাখে এই পুজাটি হতো। ইন্দ্রপূজা হলে বৃষ্টি নামতো। কৃষ্ণ এই পূজোর পরিবর্তন সাধন করেন। কৃষ্ণ বোঝালেন যারা কৃষক তাদের গ্রীষ্ম ঋতুতে বৃষ্টি প্রয়োজন আছে। বৃষ্টি নামলে মাটি নরম হয়। কৃষকের চাষ ও বীজ বপণের সুবিধা হয়। কিš‘ গোপিদের পেশা কৃষি কাজ নয়। অতএব তাদের সাথে বৃষ্টির সম্পর্ক নেই। গোপিদের মূলধন, ঘি, ঘোল বিক্রয় করে গোপদের জীবন চলে। অতএব গোপিদের যদি কোন পূজা করতে হয় তাহলে গরুপূজা করাই উচিত। অতএব কৃষ্ণ গোপিদেবকে ইন্দ্র পূজার পরিবর্তে গোপূজা করতে বলেন। প্রচলন হোল দেব পূজার পরিবর্তে জীবিকা পূজা। জীবিকা জীবন ও জাতিকে রক্ষা করেন। অতএব জীবন ও জাতিকে রক্ষা করার স্বার্থেই জীবিকাকে অধীর করতে হবে-ভালোবাসতে হবে পূজা করতে হবে। পূজা না পেয়ে ইন্দ্র ক্ষেপে গেলে সে অনর্গল বৃষ্টি আরম্ভ করলো। লক্ষ্য গোপিদের ভাসিয়ে দেবে। কৃষ্ণ গোবর্ধন পর্বত ধারণ করে গোকুলকে রক্ষা করলে। গোকুলের ঘন বনে প্রচুর বাঘ। মাঝে মাঝেই ছোট ছোট পাহাড়, গাছ-পালবেষ্টিত অন্ধকারা”ছন্ন জলাশয়। প্রায়ই গরু বাঘে নিয়ে যায় গোপিদের একমাত্র অবলম্বন গাভী বাঘে নিয়ে গেলে তাদের আর দুর্দশার অন্ত থাকতো না। কৃষ্ণ পরামর্শ দিলেন বৃন্দাবনে গেলে কেমন হয়। কৃষ্ণের পরামর্শ আহিরি পল্লি মেনে নিল। গোপেরা বৃন্দাবনে চলে গেল। এখানে বন আছে ফুলের বন। বাঘ পালানো জঙ্গল নেই। অতএব গোপিদের গাভী আর বাঘে নেয় না। তাছাড়া বৃন্দাবনের উঁঁচু ভূমিতে প্রচুর ফুলের বাগান মৃদু মন্দ বাতাস। ফুলের প্রাণ-ভরা সুগন্ধ। জোৎস্নামোদিত মৃদু চঞ্চল নদীর জল গোপিদের পাগল করে তুলল। রসিকেন্দ্র ব্রজ কিশোর কৃষ্ণ নদীর ধারের পুষ্প-গন্ধ মাতাল প্লাবিত রাতে বাঁশিতে তাল ধরলেন। সে তাল কি শুধু বৃন্দাবনকে, বিশ্বের সব বনকেই মাতাল করলো। সে বাঁশি আজও বাজে। যার কান আছে সে উপলব্ধি করতে পারে। কৃষ্ণ গোকুল ত্যাগ করে বৃন্দাবনে আসলেন। আসলো গোকুলের গোপিরা উন্নত পরিবেশের কারণে জনপদের ¯’ানান্তর করেননি। উন্নত পরিবেশের জন্য নিরাপত্তার কারণে কৃষ্ণ আরেক বার সভ্যতার ¯’ানান্তর করেছিলেন সে মথুরা থেকে দ্বারকায়। কংস বধের পর কংসের শ্বশুর মধুরা আক্রমণ করেছিল। একবার নয় দুবার নয় আঠারো বার অতএব নিরাপত্তার কারণে কৃষ্ণ মথুরা সভ্যতাকে দ্বারকায় ¯’ানান্তর করে। অতএব সভ্যতার বিকাশ সাধনে ও নিরাপত্তার কারণে ¯’ানান্তরের দৃষ্টান্ত কৃষ্ণ ¯’াপন করেছেন কৃষ্ণের বৃন্দাবন অংশের শেষ লীলা বয়স। পুষ্প-গন্ধ ব্যাকুল জোৎস্না রাতে যমুনার তীরে কৃষ্ণ বাঁশি বাজাতে আরম্ভ করলো সেই বংশী ধ্বনি জগতকে মোহিত করলো-মাতাল করলে গোপ নারীদের। গোপিগন সাংসারিক কাজে ব্যস্ত ছিল-তারা ভুলে গেল সংসারের কাজ। বৈষ্ণব কবিগন আর ভাগবৎ তার অপূর্ব বর্ণনা দিয়েছে। জয়দেবের গীতগোবিন্দ কাব্যেও রাসের বর্ণনা অপরূপ। তবে ভাগবতের সাথে গীত গোবিন্দের সময় গত পার্থক্য লক্ষ্যণীয়। কৃষ্ণের বাঁশির আকর্ষণে গোপ-গোপিগন যমুনা তীরে পৌঁছালে কৃষ্ণ গোপিদের ভর্ৎসনা করেছেন নারীগণ স্বামী সংসারের কাজ ফেলে রাতে যমুনা তীরে আসাটা অনুচিত বলে কৃষ্ণ মনে করেছেন। শেষে কৃষ্ণ গোপীগনের সাথে মিশেছেন- উল্লাস করেছেন। রাসের মাধ্যমে কৃষ্ণ রসও রসময়ের সেতুবন্ধন ঘটিয়েছেন। গোপিগন কৃষ্ণের রসময় ও সর্বময় অবস্থান সর্ম্পকে সম্যক উপলব্ধি করেছে ক্ষুদ্র নিবন্ধে সংক্ষিপ্তাকারে রাস পর্যন্ত আলোচনার সুযোগ এখানে নেই। -ডা.উজ্জ্বল কুমার রায়