ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

সারতাজ আলীম

নতুন রূপে রাশিয়ার সিলিকন ভ্যালি

প্রকাশিত: ০৬:১৬, ২৪ আগস্ট ২০১৯

নতুন রূপে রাশিয়ার সিলিকন ভ্যালি

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ তখন। বিশ্বের দুই পরাশক্তি আমেরিকা এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন নতুন এক যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে। স্নায়ুযুদ্ধ বলে সম্বোধন করা এই যুদ্ধ আদতে সরাসরি কোন যুদ্ধ নয়। প্রযুক্তি, বিজ্ঞান, কূটনীতি, সামরিকায়নের মতো বিষয়গুলোতে একে অন্যের চেয়ে এগিয়ে যাওয়া। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরের সময়টাকে প্রথমদিকে রাশিয়া মহাকাশ এবং অন্য কয়েকটি দিকে আমেরিকার থেকে এগিয়ে থাকলেও বাকি সব ক্ষেত্রে আমেরিকা এগিয়ে যাচ্ছিল। বিজ্ঞানী গবেষকদের তীর্থস্থান হতে শুরু করে আমেরিকা। এদিকে ১ম বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই ইউরোপে জ্ঞানচর্চা কমতে থাকে। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতায় মেধাবীরা আমেরিকা পাড়ি দিতে শুরু করে। মুক্ত পরিবেশ সেখানে তারা নিজেদের গবেষণা চালিয়ে যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে জার্মানি বাদে কারোরই বিজ্ঞান চর্চা চোখে পড়ার মতো ছিল না। বিষয়টি ভাবিয়ে তোলে সোভিয়েত নীতি নির্ধারকদের। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পাল্লা দিতে তাদেরও বড় কিছু করা চাই। আর তাই একটা বিজ্ঞান শহরের বিশেষ প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন তারা। ঠান্ডার রাজ্য সাইবেরিয়াতে এক বিজ্ঞাননগরী গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। রাশিয়ায় যার শাসন আমল থেকেই সাইবেরিয়া ভীতি শুরু হয়। হিমশীতল আবহাওয়া এবং দুর্গম এলাকায় তখন শহর অঞ্চল থেকে অপরাধী বা বিরোধীদের নির্বাসন দেয়া হতো। শীতের চাদরে মোড়া এই এলাকা নিয়ে তাই জনগণের মধ্যে একটা আতঙ্ক কাজ করত। এদিকে সাইবেরিয়া ছিল প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর। বড় কোন শহর গড়ে না ওঠায় প্রচুর জায়গাও ছিল। আর সবমিলে সাইবেরিয়া ভীতি কাটানোরও দরকার ছিল। পরিকল্পনা অনুযায়ী সাইবেরিয়ার অন্যতম বৃহত্তম শহর নভোসাইবেরিস্ক থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরে অব নদীর তীরে গড়ে উঠতে শুরু করে গবেষণার এই তীর্থভূমি। নদিতে বাঁধ দিয়ে একটি লেক সৃষ্টি করা হয়েছিল। ৫০-এর দশকে এই হ্রদে একটি জলবিদ্যুত কেন্দ্র চাল করা হয়। রাশিয়ান ভাষায় এই বিজ্ঞাননগরীর নাম দেয়া হয়েছিল ‘Akademgorodok’। তৎকালীন সোভিয়েত প্রধানমন্ত্রী নিকিতা ক্রুশ্চেভর বিশেষ নজরে এই অঞ্চল খুব দ্রুত গড়ে উঠতে শুরু করে। ১৯৬০ সালের আগে কর্মমুখর হয়ে উঠে এই নগর। সাইবেরিয়ার এই বিজ্ঞান নগরের প্রাণ ভোমরা ছিল নভোসাইবেরিস্ক স্টেট ইউনিভার্সিটি। এই বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াও এখানে ৩৫টি প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছিল। তবে এখানে সর্বপ্রথম স্থাপিত প্রতিষ্ঠান ইনস্টিটিউট অফ হাইড্রোডায়নামিক্স। জলসম্পদ নিয়ে কাজ করত এই সংস্থাটি। হাইড্রো-কার্বন, তেল অনুসন্ধান, তথ্যপ্রযুক্তি, মহাকাশ, জীববিজ্ঞান, গণিত এবং আরও অনেক খাত নিয়ে গবেষণা চলত এই আকাদেমগোরোদক নগরে। আড়াই কিলোমিটার এলাকার ভেতর ২০টি গবেষণা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করা হয়। সোভিয়েতরা গর্ব করে বলত এত ছোট এলাকার ভেতর পৃথিবীর আর কোথাও এত বৈজ্ঞানিক প্রতিষ্ঠান নেই। সাইবেরিয়া প্রাকৃতিক সম্পদের এক ভান্ডার ছিল। ফলে গবেষণার জন্য কোন প্রাকৃতিক সম্পদের ফরকার হলে সেটা খুব দ্রুতই পাওয়া যেত। বিজ্ঞানীদের জন্য আরেকটা আশীর্বাদ ছিল সোভিয়েত আমলাতান্ত্রিক জটিলতা থেকে মুক্তি পাওয়া। কোন প্রজেক্টের জন্য গুরুত্বপূর্ণ কিছু কেনার দরকার হলে বিশাল আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে যেতে হতো; কিন্তু আকাদেমগোরোদকে এই জটিলতা অনেকটাই কমে আসে। গবেষণা করার মতো যেসব খাত আছে তার প্রায় সবকিছু নিয়েও গবেষণা চলত আকাদেমগোরোদকে। আর তাই কোন অর্জনকে বিশেষ করে করে চোখে পড়ে না। সোভিয়েতরা আধুনিক পদার্থবিজ্ঞান নিয়ে দারুণ কিছু সাফল্য পেয়েছিল এখান থেকে। প্রাণীদের সঙ্কর জাতও তৈরি হয়েছিল। কিছু সূত্র অনুযায়ী গৃহপালিত শেয়ালের মতো সঙ্কর জাত তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিল গবেষকরা। গবেষকরা অবশ্য প্রথমদিকে খুব স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেনি। সোভিয়েত ইউনিয়নে প্রতিনিয়ত সম্মুখীন হওয়া সমস্যাগুলো এখানেও থাকবে কিনে এটা নিয়ে সবাই উদ্বিগ্ন ছিল। এছাড়াও হিমশীতল এই অঞ্চলে তাদের জন্য কি পরিমাণ নাগরিক সুবিধা সরকার দেবে সেটাও ভাবার বিষয় ছিল। প্রথমদিকের গবেষকরা বিভিন্ন সময়ে জানিয়েছেন অল্প কিছুদিনের মধ্যে তাদের দুশ্চিন্তা কেটে গিয়েছিল। নাগরিক সুবিধা সোভিয়েত ইউনিয়নের গড়ের থেকে বেশ ভাল ছিল। গহীনে অবস্থিত হলেও খাবার এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সরবারহ ভাল ছিল। বিজ্ঞানী, গবেষক, শিক্ষানবিস এবং তাদের পরিবার পরিজন সব মিলে ২৫ হাজারের বেশি মানুষ থাকত সেখানে। বেশির ভাগেরই গড় বয়স ছিল ৩০ এর নিচে। ভাল বেতনের চেয়ে ভালভাবে গবেষণা এবং জ্ঞানচর্চার সুবিধার কথা বার বার বলা হয়েছিল যার ফলে সবাই আকৃষ্ট হয়। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর কিছুদিনের জন্য থমকে যায় সব। ১৯৯২ সালে প্রথম বেসরকারী বিনিয়োগে একটি তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান যাত্রা শুরু করে আকাদেমগোরোদতে। নভসফট নামের এই কোম্পানির মূল ক্রেতা ছিল আইবিএম। ধীরে ধীরে আরও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান অফিস খুলতে শুরু করে। ২০১১ সাল নাগাদ ৩০০টি প্রতিষ্ঠানের মূল বা স্থানীয় অফিস ছিল এই বিজ্ঞাননগরীতে। ইন্টেল, এইচপি, প্যারালালের মতো বড় প্রযুক্তি জায়ান্টদের অফিস বর্তমানে প্রতিবছর ১৭ বিলিয়ন রুবল সমমানের সেবা বা পণ্য উৎপাদন আকাদেমগোরোদ। যুক্তরাষ্ট্রের সিলিকন ভ্যালি গত ৯০-এর শেষ দশক থেকে গড়ে উঠেছে। ১৯৯৫ সালের পর থেকে তথ্যপ্রযুক্তির প্রাণকেন্দ্র হয়ে ওঠে। অন্যদিকে রাশানদের বিজ্ঞাননগর-এর থেকে আরও আগে স্থাপিত হওয়ার অনেক সময় একে ‘আসল সিলিকন ভ্যালি’ বলা হয়। রাশিয়া তার ‘আসল সিলিকন ভ্যালি’কে আগের রূপ দিতে আবার বদ্ধপরিকর। গত বছর পুতিনের সফরের পর সেই ধারণা আরও জোরালো হয়েছে। পুরনো গৌরব কি আবার ফেরত আনা যাবে? আকাদেমগোরোদ বা পুরনো সিলিকন ভ্যালি যে নামেই ডাকা হোক না কেন দেখার বিষয় এখন একটাই।
×