ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

রূপনগর বস্তি থেকে বছরে ওঠে ৬০ কোটি টাকা

প্রকাশিত: ০৬:৩৫, ২৪ আগস্ট ২০১৯

রূপনগর বস্তি থেকে বছরে  ওঠে ৬০ কোটি টাকা

স্টাফ রিপোর্টার ॥ মিরপুর ৬ নম্বর ঝিলপাড় বস্তির বয়স প্রায় ৪৫ বছর। দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে নিম্ন আয়ের মানুষ বংশ পরম্পরায় এখানে বসবাস করছেন। ঝিল ভরাট করে প্রতিবছরই বাড়ানো হয় ঘর। যত ঘর, প্রভাবশালীদের তত আয়। রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় চলে মাদক, অবৈধ গ্যাস, বিদ্যুত ও পানির ব্যবসা। ক্ষমতার পালাবদলে অবশ্য বস্তির নিয়ন্ত্রণ নেয়া প্রভাবশালী মুখগুলোর পরিবর্তন হয়ে যায়। রাজধানীর দ্বিতীয় বৃহত্তম এ বস্তি থেকে প্রতিমাসে অবৈধভাবে আয় কত, তা নির্দিষ্ট করে বলা না গেলেও, বাসিন্দাদের সংখ্যা ও ঘর হিসেবে একটি পরিসংখ্যান পাওয়া যায়। সে মতে আয়ের পরিমাণ প্রতিমাসে কয়েক কোটি টাকারও বেশি। প্রাপ্ত পরিসংখ্যানে দেখা যায়, এখানে ১৫ থেকে ২০ হাজার ঘর রয়েছে। গ্যাস-বিদ্যুত ও পানির বিলসহ এক রুমের ভাড়া দিতে হয় দুই হাজার ৭০০ টাকা। সে হিসাবে ১৫ হাজার ঘর থেকে প্রতি মাসে টাকা ওঠে ৪ কোটি ৫ লাখ টাকা। বছরে ওঠে ৪৮ কোটি ৬০ লাখ টাকা। অন্যদিকে ২০ হাজার ঘর হিসাবে ধরলে এই টাকার পরিমাণ প্রতি মাসে টাকা উঠে ৫ কোটি ৪০ লাখ। যা বছরে দাঁড়ায় ৬৪ কোটি ৮০ লাখ টাকা। অর্থাৎ কম করে হলেও এই বস্তি থেকে ৫০ থেকে ৬০ কোটি টাকা ওঠে বছরে। সরকারী জায়গার এই টাকার ভাগ কে কে পায় তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সিটি কর্পোরেশনের মেয়রের উচিত এই বিষয়টি খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা গ্রহণ করা। সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, টিন ও বাঁশের বেড়া দিয়ে জিলপাড় বস্তির ঘরগুলো তৈরি করা হয়েছিল। এসব ঘরের নিচ দিয়ে টানা হয়েছে গ্যাসের লাইন। প্লাস্টিকের পাইপ ব্যবহার করে জোড়া তালি দিয়ে অরক্ষিতভাবে টানা এসব গ্যাস সংযোগে জ্বলত বস্তির বাসিন্দাদের রান্নার চুলা। ১৬ আগস্টের আগুনে পুড়ে যাওয়া বস্তির অংশের প্রতিটি বাড়ির রান্না ঘরে প্লাস্টিক পাইপের গ্যাস সংযোগ দেখা গেছে। আগুনের তাপে এসব পাইপ ফেটে গেছে। পুড়ে যাওয়া ঘরগুলোতে গ্যাসের চুলার অস্তিত্ব না থাকলেও প্লাস্টিকের পাইপের উপস্থিতি ঠিকই পাওয়া গেছে। বস্তির ক্ষতিগ্রস্ত বাড়িওয়ালা ও ভাড়াটিয়ারা জানান, বস্তিতে সরকারী কোন গ্যাস লাইন নেই। এখানে প্রতিটি বাড়িতে যে গ্যাসের সংযোগ ছিল সেগুলো সব অবৈধ। বস্তিতে বিদ্যুত ও গ্যাস সংযোগের ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করতেন দুলাল হোসেন ও রহিম। ক্ষমতাসীন দলের লোক পরিচয় দিয়ে ও জনপ্রতিনিধিদের হাত করে দীর্ঘদিন ধরে তারা এই ব্যবসা করে আসছিল। নাম প্রকাশ না করার শর্তে বস্তির এক বাড়িওয়ালা বলেন, ‘বস্তিতে গ্যাসের অবৈধ সংযোগ দিতেন দুলাল হোসেন নামে এক ব্যক্তি। সে বিভিন্ন অফিস ও স্থানীয় নেতাদের টাকা দিয়ে মুখ বন্ধ করে রাখতো। সে এভাবে অনেক টাকার সম্পত্তি গড়েছে।’ মিরপুর ৬ নম্বর ঝিলপাড় বস্তিতে পরিবার নিয়ে বসবাস করেন মগবুল হোসেন। তার গ্রামের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা থানায়। অভাবের কারণে গ্রামের ভিটা বিক্রি করে ৪২ বছর আগে ঢাকায় এসেছিলেন তিনি। বস্তিতে তার দুটি ঘরের একটি বাড়ি ছিল, যা আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। তিনি বলেন, ‘আমার চার ছেলে নিয়ে এই বস্তিতে থাকতাম। বাড়ির বিদ্যুত ও গ্যাস বিলে খরচ হতো দুই হাজার টাকা। দুই বার্নারের চুলায় দিতাম এক হাজার আর বিদ্যুত বিল হিসেবে দিতে হতো আরও এক হাজার টাকা। বস্তির উত্তর পাশে গাছের নিচে ফরিদের ঘরে গ্যাস বিস্ফোরণ হয়ে আগুন লাইগা যায়। সবাই আগুন আগুন কইতে কইতেই পাঁচ মিনিটে পুরা বস্তি ফানাফিল্যা। এখন আমাগো কিছ্ইু নাই। কোথাও থাকার জায়গাও নাই। সরকারের কাছে আবেদন করি, এইহানে যেন আমাদের থাকার ব্যবস্থা কইরা দেয়।’ তিনি অভিযোগ করেন, ‘যারা আগে এই বস্তিতে থাকতো, তারা ঘর তুইলা, রুম ভাড়া খাইয়া এখন বড় বড় দালান করছে। কয়েকটা বাড়ির মালিক হইছে। তারা এই বস্তির মানুষগো দিয়া চাষবাস কইরা কোটিপতি হইছে। আজকে আমরা এই দুর্দিনে তাগো দেহা যায় না। যা ক্ষতি হবার বস্তির মানুষেরই হইছে।’ বস্তির ক্ষতিগ্রস্ত বাড়িওয়ালা ও ভাড়াটিয়ারা জানান, দুলাল হোসেন পুরো বস্তিতে প্লাস্টিকের পাইপ দিয়ে গ্যাস সাপ্লাই দিতো। প্রতিমাসে বস্তির বাড়িওয়ালাদের কাছ থেকে গ্যাস বিল বাবদ ৫৫ লাখ টাকা তুলে নিতো। এক চুলা পাঁচ শ’ আর দুই চুলার জন্য এক হাজার টাকা ছিল তার রেট। অপরদিকে, প্রতিঘরে এক বাতির জন্য এক শ’ টাকা। বাতি ও ফ্যান থাকলে তিন শ’ টাকা, টিভি থাকলে দিতে হতো পাঁচ শ’ টাকা। আর ঘরে কারও ফ্রিজ থাকলে এক হাজার টাকা করে মাসিক বিল দিতে হতো। বস্তির বাসিন্দারা জানান, গ্যাস বিল তোলার কাজটি করত জিতু, মোনতাজ। তারা দুলালের সহযোগী। দুলাল মিয়া ও রহিম দু’জনই বস্তিতে অবৈধভাবে গ্যাসের সাপ্লাই দিতেন। দুলাল ও রহিম মিরপুর রূপনগরের ক্ষমতাশীল দলের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত আছেন। অন্যদিকে বাড়িওয়ালা-ভাড়াটিয়াদের কাছ থেকে বিদ্যুত বিল তুলতো তুষার, হেলাল উদ্দিন, খলিলুর রহমান, হানিফ, নুরুল ইসলাম, মাসুদ, রুবেলসহ আরও অনেকে। তারা মিরপুর ৬ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর হাজী রজ্জব হোসেনের অনুসারী বলে জানিয়েছেন ক্ষতিগ্রস্তরা। তবে বস্তিতে অবৈধ গ্যাস ও বিদ্যুত সংযোগের ব্যবসার সঙ্গে নিজের কোন সম্পৃক্তা নেই বলে দাবি করেন মিরপুর ৬ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর হাজী রজ্জব হোসেন। তিনি বলেন, ‘বস্তিতে গ্যাসের অনেক অবৈধ সংযোগ আছে। তবে প্লাস্টিকের পাইপ দিয়ে গ্যাসের লাইন টানার বিষয়টি আমার জানা ছিল না। যারা অবৈধ গ্যাসের ব্যবসা করছে তারা কেউই আমার লোক নয়। আবার অনেকেই আমাদের নামে কথা বলছে। আমি এর তীব্র প্রতিবাদ জানাই।’ বস্তির বাসিন্দা রহিমা বেগম বলেন, ‘এখানে ১৫ থেকে ২০ হাজার ঘর রয়েছে। প্রতি চুলা ছাড়াও আবার ঘর প্রতিও ৫০০ করে টাকা নেয়া হতো। সব টাকা দুলাল লিখে লিখে নিতো। তার কাছে সব হিসাব আছে।’ ঝিলপাড় বস্তির বাড়িওয়ালা সাদেক মিয়ার বাড়িতে এক রুম ভাড়া নিয়ে থাকতেন মোঃ মোহসিন। তিনি ভ্যানগাড়ি চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন। তিনি বলেন, ‘গ্যাস-বিদ্যুত ও পানির বিলসহ এক রুমের ভাড়া দেই দুই হাজার ৭০০ টাকা। আগুনে তো সব জ্বইলা গেছে। এখন কিছু সাহায্য-সহযোগিতা পাইলে ভাল হইতো। কমিশনারের অফিস থেকে কয়েকজন আসছিল। আমার নাম আর বাড়ির মালিকের নাম লিখে নিয়ে গেছে। কিন্তু আমার সম্পূর্ণ পরিচয় নেয় নাই। সরকার যদি কোন অনুদান দেয় আর তখন যদি আমার নাম কইরা অন্যজন নিয়া ফালায়, তবে আমি তো কিছুই পাবো না। এই কারণে তালিকায় নাম লেখাইয়াও ভরসা পাইতাছি না।’ বস্তিতে অবৈধ গ্যাস লাইন সংযোগের বিষয়ে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে কি না? জানতে চাইলে তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন এ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের পরিচালক (অপারেশন) প্রকৌশলী কামরুজ্জামান খান একটি অনলাইনকে বলেন, ‘এই বিষয়ে আমি কিছু জানি না। এটি আমাদের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলতে পারবেন। তবে আমরা অনেকবার অবৈধ গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন করেছি। তারপরও স্থানীয়রা লাইন বসিয়ে নেয়।’ তিনি বলেন, ‘ঝিলপাড় বস্তিতে অবৈধ গ্যাস লাইন ব্যবহারের বিষয়ে তিতাস গ্যাসের পক্ষ থেকে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্ত করে অপরাধীদের চিহ্নিত করার কাজ চলছে। এতে যদি তিতাসের কেউ জড়িত থাকে তাদের বিরুদ্ধেও প্রয়োজনীয় ব্যবস্তা গ্রহণ করা হবে।’ ডেসকো’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব) শাহিদ সারওয়ার ওই অনলাইনকে বলেন, বস্তি এলাকায় ডেসকোর পক্ষ থেকে পোল মিটার বসানো রয়েছে। সেই মিটার থেকে বিদ্যুত সংযোগ নিয়ে তারা ব্যবহার করতে পারেন। এছাড়াও অনেকে অবৈধভাবে বিদ্যুতের সংযোগ নিয়ে থাকে। তবে আমরা আমাদের রুটিং ওয়ার্ক অনুযায়ী সেসব অবৈধ বিদ্যুতের সংযোগ কেটে দিয়ে আসি। বিভিন্ন সময় ম্যাজিস্ট্রেটের মাধ্যমে অভিযানও পরিচালনা করা হয়।
×