ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

শাহাব উদ্দিন মাহমুদ

মার্কিন ‘কোবরা’ হেলিকপ্টার ॥ ২৪ আগস্ট, ১৯৭১

প্রকাশিত: ০৯:১৫, ২৪ আগস্ট ২০১৯

 মার্কিন ‘কোবরা’ হেলিকপ্টার ॥ ২৪ আগস্ট, ১৯৭১

১৯৭১ সালের ২৪ আগস্ট দিনটি ছিল মঙ্গলবার। বাংলাদেশের মানুষের ওপর ইয়াহিয়া সরকারের অমানবিক নিপীড়নের বিরুদ্ধে দুনিয়াজুড়ে চলমান নিন্দা আর সমালোচনা সত্ত্বেও, রক্তপিপাসু পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীকে সরমাস্ত্র সরবরাহ অব্যাহত রাখার নীতি পরিত্যাগ করেনি নিক্সন প্রশাসন। মূলত মার্কিন সমরাস্ত্রে সজ্জিত হবার কারণেই ইয়াহিয়া এরকম একটি ন্যক্কারজনক সামরিক অভিযান শুরু করার সাহস পেয়েছিল, তা সত্ত্বেও নিক্সন প্রশাসন তার সমর্থন এখন অবদি অব্যাহত রেখেছেন। অথচ নিক্সনের পক্ষেই সম্ভব ছিল ইয়াহিয়াকে যৌক্তিক রাস্তায় ফিরিয়ে আনা। নৃশংস সামরিক নিপীড়নের নিন্দা জানানোর বদলে তিনি ইতোমধ্যে সুসজ্জিত ও বেপরোয়া এই সামরিক শক্তিকে আরও অস্ত্রশস্ত্র আর রসদ জুগিয়ে যাচ্ছেন। যা কিনা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াসহ বিশ্ব শান্তির জন্য চরম হুমকি এবং বাংলাদেশ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অশুভ পরিকল্পনারই প্রমাণ দেয়। ৭৫ মিলিয়ন মুক্তিকামী মানুষ এই যুদ্ধবাজ নিপীড়কদের কাছ থেকে ঠিকই বিজয় ছিনিয়ে আনবে। কোরিয়া, ভিয়েতনাম আর লাওসে ন্যক্কারজনক পরাজয় থেকে যুক্তরাষ্ট্র কোন শিক্ষা গ্রহণ করেছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে না। ঠিক যে মুহূর্তে নিক্সন ভিয়েতনাম থেকে সেনা প্রত্যাহার করার কথা বলছেন, তিনি বাংলাদেশে নিজের হাতকে আরও বেশি রক্তাক্ত করতে ইচ্ছুক বলে মনে হচ্ছে। মার্কিন সেনাদের যত বড় দলই আসুক না কেন, তারা ইয়াহিয়াকে বাঁচাতে পারবে না। তারা কেবল ইতিহাসের পাতায় হত্যাকারী ইয়াহিয়ার সহযোগী হিসেবে নিক্সনের নামটাই প্রতিষ্ঠা করতে পারবে। তবে এই গণহত্যার নীতি থেকে নিক্সনের সরে আসার এখনও সময় আছে। এইদিন সারাপুর এবং লাতুতে অবস্থিত ভারতীয় অ্যাডভান্স ক্যাম্পের মধ্যে একটি টেলিফোন লাইন স্থাপন করা হয়। মুক্তিফৌজের স্থাপন করা অ্যান্টি পার্সোনাল মাইনের বিস্ফোরণে একজন বেসামরিক লোক পা হারায়। ৮নং সেক্টরে পাকবাহিনীর একটি কোম্পানি নাটোর থেকে মুজিবনগরের দিকে অগ্রসর হলে মুক্তিবাহিনীর একটি দল নায়েব সুবেদার আবদুল মতিন পাটোয়ারীর নেতৃত্বে বাগুয়ানে এবং আর একটি দল মানিক নগরে এ্যামবুশ করে। প্রায় আড়াইঘণ্টাব্যাপী এই যুদ্ধে ৯ জন পাকসেনা নিহত ও অনেকে আহত হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের গুলির মুখে পাকসেনারা পিছু হটতে বাধ্য হয়। এই যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর একজন যোদ্ধা আহত হয়। যুদ্ধ চলা অবস্থায় ওখানকার ছোট ছোট ছেলেরা গোলাবারুদ মাথায় করে মুক্তিফৌজের সাপ্লাই বজায় রাখে। অঞ্জলি নামে একজন খ্রিস্টান নার্স সব সময় মুক্তিফৌজের সেবা শুশ্রুষা করত। সে গ্রাম রেকি করে মুক্তিফৌজকে খবর দিত। সব সময় প্রথম সারিতে থাকত। কুমিল্লায় গেরিলাদের কমান্ডো আক্রমণ প্রতিনিয়ত বাড়ছিল। গত কয়েক দিনের মধ্যে প্রায় ৪ কর্মকর্তা এবং ২০০ ও আরএস মারা যায়। এছাড়া অজ্ঞাত সংখ্যক হানাদার দোসর আহত হয়। হামলায় দাউদকান্দিতে ৮টি ভারী যানবাহন বহনে সক্ষম একটি ফেরি ধ্বংস হয়। ফেরিঘাটে, স্টিমার ঘাট, জেটি ও পল্টুুন, জ্বালানি ধ্বংস করা হয়। ১২ রাজাকারসহ বেশ কয়েকজন পশ্চিম পাকিস্তানী পুলিশও নিহত হয়। মুক্তিবাহিনী কুমিল্লার সিএন্ডবি রোডের কালামুড়া ব্রিজে অবস্থাররত রাজাকারদের ওপর আক্রমণ চালায়। এতে ৭ জন রাজাকারের সবাই আত্মসমর্পণ করে এবং মুক্তিযোদ্ধারা প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র দখল করে। পরে মুক্তিযোদ্ধারা কালামুড়া ব্রিজটি ধ্বংস করে। সুবেদার আবদুল ওয়াহাবের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধা দল কালামুড়া ব্রিজের ২ মাইল দক্ষিণে মাধবপুর ও মীরপুরের মাঝখানে পাকসৈন্য ভর্তি ২টি স্টেট বাস, ৩টি জীপ ও ২টি ডজ এ্যামবুশ করে। মুক্তিযোদ্ধাদের তীব্র আক্রমণে পাকবাহিনীর সবকটি গাড়ি ধ্বংস হয় এবং বহু পাকসৈন্য নিহত হয়। একজন রাজাকার ও তিনজন পাকসৈন্য অস্ত্রশস্ত্রসহ ধরা পড়ে। মুক্তিবাহিনী সাতক্ষীরায় রাজাকারদের আশাশুনি ক্যাম্প আক্রমণ করে। এই আক্রমণে রাজাকারদের ক্যাম্পটি সম্পূর্ণ ধ্বংস হয় এবং অনেক রাজাকার নিহত হয়। জামায়াতে ইসলামীর মহাসচিব লাহোরে এক সাংবাদিক সম্মেলনে বলেন, দেশ থেকে সামরিক শাসন তুলে কোন বেসামরিক সরকার প্রতিষ্ঠার সময় এখনও আসেনি। পূর্ব পাকিস্তান নেজামে ইসলাম দলের জেনারেল সেক্রেটারি মওলানা আশরাফ আলী ঢাকায় এক বিবৃতিতে বলেন, সীমান্ত এলাকায় নিরীহ জনগণের ওপর ভারতীয় অনুপ্রবেশকারীরা অত্যাচার করছে। পাক সরকার জানায়, ভারতীয় অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে পঁচাগড়া, সাতক্ষীরা, ঝিকরগাছা, ঠাকুরগাঁও, সিলেট ও কুমিল্লায় ৫শ’ অমুসলিমসহ ৫ হাজার ৪শ’ উদ্বাস্তু ফিরে এসেছে । ওয়াশিংটনের স্টেট ডিপার্টমেন্টের এক মুখপাত্রের বর্ণনা অনুযায়ী মার্চ ১৯৭২ এর মধ্যে তারা প্রায় ২০ মিলিয়ন ডলার মূল্যমানের সমরাস্ত্র সরবরাহ করবে। মার্কিন সরকারের দাবি অনুসারে ১৭টি ১০০০টন ধারণক্ষমতার জাহাজ প্রস্তুত করা হয়েছে দেশের অভ্যন্তরে খাদ্য ও অন্যান্য সামগ্রী সরবরাহ করার জন্য। আদতে এগুলো সামরিক কাজে ব্যবহার করা হবে। এটি সবার জানা আছে যে, ইয়াহিয়ার খুনি বাহিনীর জন্য জরুরী ভিত্তিতে নৌযান প্রয়োজন যাতে তারা নদীমাতৃক বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে প্রবেশ করতে পারে। মার্কিন-বান্ধব যেসব পাকিস্তানী সেনা কর্মকর্তা যুক্তরাষ্ট্রে প্রশিক্ষণ নিয়েছে ভিয়েতনামের ‘গ্রীন বেরেট’ এর আদলে তারা এ মুহূর্তে বাংলাদেশেই অবস্থান করছে। বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত এই ‘অদম্য’ সৈনিকেরা বিশেষ করে গণহত্যা, স্যাবোটাজ, গুপ্তহত্যা আর নির্যাতন করায় পারদর্শী। বিশ্বস্ত সুত্রে এও জানা গেছে যে এক ডজনেরও বেশি আমেরিকান ‘বিশেষজ্ঞ’ কোয়েটা, বেলুচিস্তান আর ঢাকায় পাকিস্তানীদের বিচ্ছিন্নতাবিরোধী অভিযানের জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। এটা লক্ষণীয় যে, ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময়ও মার্কিন বিশেষজ্ঞরা একই রকম ভূমিকা পালন করেছিল। ভিয়েতনামের মতো বাংলাদেশের যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র সরকার বেশ উন্মুখ বলেই মনে হচ্ছে। মার্কিন মিডিয়ায় প্রকাশিত খবর অনুযায়ী ভিয়েতনামের জন্য বরাদ্দ করা মার্কিন সমরাস্ত্র ঢাকা ও করাচিতে পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছে। দক্ষিণ ভিয়েতনামে ‘গণতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠার জন্য বরাদ্দ করা এসব অস্ত্র এখন এখানে এসে পড়েছে। যুক্তরাষ্ট্র থেকে পাওয়া যে বোয়িং উড়োজাহাজটি পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের বহরে যুক্ত হয়েছিল সেটি এখন বাংলাদেশে পাকিস্তানী সেনা পাঠানোর কাজে নিয়োজিত হয়েছে। এর বাইরে নিক্সন প্রশাসন পাকিস্তানের জন্য আরও এক মিলিয়ন ডলার অনুদানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে যা ব্যবহৃত হবে ছয় মাসের জন্য ১৮টি জলযান কিনতে যা দিয়ে যোগাযোগ ব্যবস্থা পূনঃপ্রতিষ্ঠা করা যায় ও লোকদের কাছে ত্রাণ সামগ্রী পৌঁছানো যায়। বর্তমানে প্রায় ২০০ মার্কিন ত্রাণ বিশেষজ্ঞ বাংলাদেশে অবস্থান করছে। এদেরকে মার্কিন সরকার নির্দেশনা দিয়েছে বেসামরিক জনসাধারণকে বিচ্ছিন্নতা বিরোধী প্রশিক্ষণ দিতে। এই বিশেষজ্ঞরা ইতোমধ্যে তাদের কাজ শুরু করে দিয়েছে। আর সর্বোপরি, ভিয়েতনামে ব্যবহৃত কিছু মার্কিন ‘কোবরা’ হেলিকপ্টার পাকিস্তানী সামরিক জান্তার হাতে তুলে দেয়া হয়েছে যাতে তারা স্বাধীনতা সংগ্রামীদের দমন করতে পারে। ইতিহাসবিদ এ.এল.বাসাম বাংলাদেশ নিয়ে তার কিছু ভাবনার কথা লিখেছেন যা পরবর্তী সময়ে সাপ্তাহিক বাংলাদেশ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল তিনি বলেন, কলকাতা ভ্রমণের শুরুতে কিছু দুর্দশাগ্রস্ত, অসুখী মানুষদের দেখেছি। এরা পূর্ববাংলার অত্যাচারিত মানুষ। পশ্চিম পাকিস্তানের পশুতুল্য সেনাবাহিনী দ্বারা সংগঠিত নিষ্ঠুর অত্যাচারে বাধ্য হয়ে পালিয়ে আসা মানুষ । আমি শান্তিপ্রিয় মানুষ, মানুষকে ঘৃণা করতে উৎসাহিত করা আমার কাজ নয়। পৃথিবীর ইতিহাসে মানুষের প্রতি মানুষের বিদ্বেষ আর তিক্ততার ক্ষমতা কতটা প্রবল তার উদাহরণ স্বয়ং আমার নিজের জন্মভূমির ইতিহাস। —————- পূর্ববাংলার নিষ্ঠুরতা একমাসের মধ্যেই যে চরমতায় রূপ নিয়েছে যা জালিয়ান ওয়ালাবাগের চেয়েও নৃশংস এবং যা পরিকল্পনা আর সাবধানতার সাথে ঘটছিল। নৃশংসতার মাত্রা অনুমোদিত হারে এতটাই বৃদ্ধি পেয়েছিল, যার ফলশ্রুতিতে বিগত তিনমাসে পূর্ববাংলায় দশলক্ষেরও বেশি প্রাণহানি ঘটে। ভারতীয় সীমান্তে লাখ লাখ শরণার্থীদের উপস্থিতি পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর আচরণ প্রমাণের জন্য যথেষ্ট। পাকিস্তানীদের কৃত নিষ্ঠুরতা বাঙ্গালী কখনও ভুলবে না। আবার বাঙালীরা ইচ্ছাকৃতভাবে কখনও তাদের শাসনব্যবস্থা মেনে নেবে না। পাকিস্তানী বিজ্ঞজনেরা অবশ্যই সেটা এখন উপলব্ধি করতে পারছেন। জাতিসংঘ দুটি সরকারকেই আলাদাভাবে জনজীবন রক্ষার্থে-পাকিস্তান সরকারকে তার সেনাবাহিনীর প্রভাব বিস্তার না করে সেটা প্রত্যাহার এবং নতুন রাষ্ট্র গঠনের অনুমতি প্রদানের জন্য নির্দেশ দিয়েছেন। দৈনিক যুগান্তর পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মুক্তিফৌজ গত শুক্রবার কুষ্টিয়া জেলার চুঁয়াডাঙ্গার ২২ কিলোমিটার উত্তরে আলমডাঙ্গায় পাক বাহিনীর সরবরাহ ঘাঁটি আক্রমণ করে ৭০ জন পাকসেনা নিহত ৩০ জন আহত হয়। মুক্তিফৌজদের আক্রমণে বেসামাল হয়ে পাক বাহিনী অস্ত্রশস্ত্র ফেলে ঘাঁটি ত্যাগ করে। সরবরাহ ঘাঁটিটি সম্পূর্ণভাবে বিধ্বস্ত হয়েছে। লেখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক [email protected]
×