ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

শাহরিয়ার কবির

কাশ্মীর কোন পথে

প্রকাশিত: ০৯:১৬, ২৪ আগস্ট ২০১৯

কাশ্মীর কোন পথে

॥ বারো ॥ ‘অল পার্টি হুরিয়াত কনফারেন্স’ সম্পর্কে ইন্টারনেটের উইকিপিডিয়ায় বলা হয়েছে কাশ্মীরের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনগুলোর মোর্চা। হুরিয়াত নেতারা নিজেদের স্বাধীনতাকামী বলতে পছন্দ করেন। প্রথম বার কাশ্মীরে গিয়ে হুরিয়াত কনফারেন্সের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মীর ওয়াইজ মৌলভী মোহাম্মদ উমর ফারুখের সঙ্গে নির্বাচন নিয়ে কথা বলেছিলাম। তার সাফ কথা- ‘কাশ্মীরে নির্বাচন হতে পারে শুধু কাশ্মীরী জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের প্রশ্নে। এছাড়া ভারত সরকারের অধীনে কাশ্মীরে অন্য কোন নির্বাচন আমরা চাই না।’ সেবার জম্মু ও কাশ্মীরে ভারতের লোকসভা নির্বাচনের দু’সপ্তাহ আগে শ্রীনগরে মীর ওয়াইজ মঞ্জিলে এক সাক্ষাতকারে ছাব্বিশ বছর বয়সী ধর্মীয় নেতা উমর ফারুখ এ কথা বলেছিলেন। তিনি আরও বলেছেন, সাত দিনের ভেতর তিনি সারা কাশ্মীরে নির্বাচন বর্জনের আহ্বান জানাবেন। জম্মু ও কাশ্মীরে লোকসভা আসন রয়েছে ৬টি। ৬টি আসনের ভেতর তখন ৩টি ফারুখ আবদুল্লাহর দল ন্যাশনাল কনফারেন্সের, ২টি বিজেপির, ১টি কংগ্রেসের। অল পার্টি হুরিয়াত কনফারেন্স আগের নির্বাচনও বর্জনের আহ্বান জানিয়েছিল। মুখ্যমন্ত্রী ফারুখ আবদুল্লাহ যদিও তাঁর সাক্ষাতকারে বলেছিলেন, হুরিয়াত নেতারা নির্বিঘেœ সারা কাশ্মীরে নির্বাচনবিরোধী প্রচারণা চালাচ্ছেন কিন্তু আমার শ্রীনগর যাওয়ার আগের দিনই প্রাক্তন হুরিয়াত নেতা শাবির আহমদ শাহকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। হুরিয়াত যখন গঠিত হয় তখন এর প্রধান নেতাদের একজন ছিলেন শাবির শাহ। ১৯৯৮ সালে হুরিয়াত থেকে বেরিয়ে এসে শাবির শাহ ‘জম্মু কাশ্মীর ডেমোক্রেটিক ফ্রিডম পার্টি’ গঠন করেছেন। হুরিয়াত কনফারেন্সের দফতরের চেয়ে শাবির শাহ্র দফতর আকারে যেমন বড়, অভিজাতও বটে। উঁচু পাচিল ঘেরা এক তিনতলা বাড়িজুড়ে শাবির শাহ্র দফতর। একই পাড়ায় হুরিয়াতের অফিস এক দোতলা বাড়িতে। রাজবাগে শাবির শাহ্র অফিসে গিয়েছিলাম ১৮ আগস্ট বিকেলে। বাংলাদেশ থেকে এসেছি শুনে অফিসের অন্য নেতাকর্মীরা খুবই আগ্রহী হয়ে উঠলেন। তরুণ সাংবাদিক তারিখ শাহ বললেন, ‘শাবির শাহ এখনও রাজবাগ থানায় আছেন। তার সঙ্গে আমাদের আরও বারোজন নেতাকে গ্রেফতার করেছে। আপনি যদি দেখা করতে চান তাহলে আপনাকে নিয়ে যেতে পারি।’ কাশ্মীরের স্বাধীনতাকামী নেতাদের ভেতর সবচেয়ে বেশি সময় কারারুদ্ধ ছিলেন শাবির শাহ। (এ পর্যন্ত মোট ৩১ বছর) ’৬৮ সালে ১৪ বছর বয়সে তিনি প্রথম গ্রেফতার হন। শ্রীনগরে শাবির শাহ ফ্যান ক্লাব তাঁর ওপর একটি বই বের করেছে, বাংলায় যার নাম- ‘বিবেকের কণ্ঠ।’ এ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল তাকে ‘কারাবন্দী বিবেক’ হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে। এই বইতে শাবির শাহকে উল্লেখ করা হয়েছে ‘কায়েদ-এ-কাশ্মীর’ হিসেবে। শাবির শাহকে দেখতে সেদিনই রাজবাগ থানায় গিয়েছিলাম। থানার বাইরে প্রশস্ত লনে দুটো তাঁবু টাঙানো। সহযোদ্ধা পরিবেষ্টিত হয়ে ঘাসের ওপর বসেছিলেন মধ্যবয়সী সুদর্শন নেতা শাবির শাহ। পরিচয় জেনে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। বললেন, ‘আপনি এত দূর থেকে আমাদের কাশ্মীরে এসেছেন। আপনার যোগ্য আপ্যায়ন করব তার সুযোগ পাচ্ছি না।’ তার হাতে ব্যান্ডেজ বাঁধা ছিল। জানতে চাইলাম কিভাবে হয়েছে। শাবির শাহ বললেন, ‘গ্রেফতারের সময় পুলিশ আমাদের সবার ওপরই মারধর করেছে। তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, হুরিয়াতের অন্যতম উদ্যোক্তা হওয়া সত্ত্বেও সেখান থেকে বেরিয়ে এসেছেন কেন। শাবির শাহ বললেন, ‘আমরা কাশ্মীরের স্বাধীনতার জন্য যে আন্দোলন করছি সেখানে একক নেতা নির্বাচন করা খুব জরুরী। তাছাড়া সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন সমস্যা বাদ দিয়ে শুধু স্বাধীনতার আন্দোলন বেশিদিন জারি রাখা যায় না। আমি জনগণের বিভিন্ন সমস্যা সম্পর্কেও কথা বলতে চাই। এরকম আট দফা কর্মসূচী আমি হুরিয়াত কনফারেন্সের সামনে রেখেছিলাম। তারা এগুলো গ্রহণ করতে রাজি হয়নি। তাই আমি সেখান থেকে বেরিয়ে এসেছি। তাকে প্রশ্ন করেছিলাম, আপনারা যদি কখনও কাশ্মীর স্বাধীন করেন তার চেহারা কী রকম হবে? পাকিস্তান, আফগানিস্তান বা ইরানের মতো মৌলবাদী তালেবানী রাষ্ট্র না সেক্যুলার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র? শাবির শাহ বললেন, আমি গণতন্ত্রে বিশ্বাসী, অহিংসায় বিশ্বাসী। স্বাধীনতার পর কাশ্মীরের জনগণই সিদ্ধান্ত নেবে তারা কী ধরনের রাষ্ট্র ব্যবস্থা চায়। তার কাছে জানতে চাইলাম, স্বাধীনতা কি চান শুধু মুসলমানদের জন্য? কাশ্মীরে তো হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানও আছে। তারা আপনাদের আন্দোলনে নেই কেন? শাবির শাহ বললেন, ‘আপনার এই বক্তব্য আমার দলের জন্য প্রযোজ্য নয়। আমার দলে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান সবাই আছে। জম্মুতে আমাদের ভাইস চেয়ারম্যানই হিন্দু।’ পাশে ছিলেন তাদের দলের দফতর সচিব বশীর আহমেদ মীর। নেতার বক্তব্যের সঙ্গে যোগ করলেনÑ ‘আমাদের এই নীতি হুরিয়াত থেকে বেরিয়ে আসার অন্যতম কারণ।’ বললাম, ‘হুরিয়াতের এখনকার চেয়ারম্যান জামায়াতে ইসলামীর সৈয়দ আলী শাহ গিলানীরা তো চান কাশ্মীরকে ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন করে পাকিস্তানের সঙ্গে যোগ দিতে।’ শাবির শাহ বললেন, ‘হুরিয়াতের আরও কোন কোন নেতাও এরকম চান। আমাদের বক্তব্য হচ্ছে সব কিছু নির্ধারণ করবে কাশ্মীরের জনসাধারণ। কাশ্মীরের জনগণ ভারতের উপনিবেশ হয়ে যেমন থাকতে চায় না, পাকিস্তানের সঙ্গেও যুক্ত হতে চায় না।’ মীর ওয়াইয মোহাম্মদ উমর ফারুখও শাবির শাহ্র মতো সহিংসতায় বিশ্বাসী নন বলে জানিয়েছেন। তার বক্তব্য হচ্ছে কাশ্মীর সমস্যার সমাধান করার জন্য ভারত পাকিস্তানের আলোচনাই যথেষ্ট নয়। আলোচনায় কাশ্মীরেরও প্রতিনিধিত্ব থাকতে হবে। কাশ্মীরীদের প্রতিনিধি কে জানতে চাইলে জম্মু কাশ্মীর আওয়ামী এ্যাকশন পার্টির প্রধান মীর ওয়াইয উমর ফারুখ বললেন, এপিএইচসি (অল পার্টি হুরিয়াত কনফারেন্স) হচ্ছে কাশ্মীরের জনগণের একমাত্র প্রতিনিধি। শ্রীনগরের অভিজাত এলাকায় উঁচু পাচিল ঘেরা চমৎকার সাজানো এক বাড়িতে থাকেন উমর ফারুখ। সুদর্শন এই তরুণ নেতার পিতা মীর ওয়াইয মৌলভী মোহাম্মদ ফারুখ আততায়ীর হাতে নিহত হয়েছেন ১৯৯০-এ। তখন উমরের বয়স মাত্র ষোলো। এই বয়সে তাকে মীর ওয়াইয-এর দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিতে হয়েছে। উমর জানিয়েছেন, সারা পৃথিবীতে একমাত্র কাশ্মীরে মীর ওয়াইয (প্রধান পুরোহিত বা পোপ জাতীয়) প্রথা রয়েছে, যিনি হচ্ছেন কাশ্মীরী মুসলমানদের প্রধান ধর্মীয় নেতা। চারশ’ বছর ধরে বংশ পরম্পরায় এই প্রথা কাশ্মীরে জারি রয়েছে। ষোল বছর বয়সে এই গুরুদায়িত্ব বহন করার অনুভূতি ব্যক্ত করতে গিয়ে উমর ফারুখ বললেন, ‘আমি এর জন্য একেবারেই প্রস্তুত ছিলাম না। তখনও আমার স্কুল শেষ হয়নি। ভেবেছি বড় হয়ে কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার হব। পিতার মৃত্যু আমার জীবন যাপনের পুরোটাই বদলে দিয়েছে। প্রতি শুক্রবারে প্রধান মসজিদে ইসলাম ধর্মের ব্যাখ্যা করতে হবে, মানুষকে ইসলামের মর্মবাণী বোঝাতে হবে- এটা আমার জন্য খুবই কঠিন কাজ ছিল। তার ওপর বলতে হবে স্থানীয় কাশ্মীরী ভাষায়, যা তখনও আমি ভাল মতো বলতে পারতাম না। (অভিজাত কাশ্মীরীরা উর্দু ভাষায় কথা বলেন)। আমাকে প্রথমে ভাষা শিখতে হয়েছে। ধর্মের বিভিন্ন বিষয়ে জানতে হয়েছে। আলহামদুলিল্লাহ, খুব অল্প সময়ের ভেতর আমি এতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি।’ ধর্মীয় নেতা হয়ে রাজনীতির সঙ্গে কেন যুক্ত হলেন, এর জবাবে উমর ফারুখ বলেছেন, ‘আপনি হয়তো জানেন না ১৯৩১ সালে কাশ্মীরের প্রথম রাজনৈতিক দল মুসলিম কনফারেন্স গঠন করেছিলেন আমার চাচা মীর ওয়াইয ইউসুফ শাহ। তখন শেখ আবদুল্লাহও এর সঙ্গে ছিলেন। পরে শেখ আবদুল্লাহ বেরিয়ে গিয়ে ন্যাশনাল কনফারেন্স গঠন করেছেন। আমি যখন কাশ্মীরের মুসলমানদের ক্রমাগত নির্যাতিত হতে দেখেছি তখনই স্থির করেছি এর বিরুদ্ধে রাজনৈতিকভাবে এবং সাংগঠনিকভাবে প্রতিবাদ জানাতে হবে। এই উদ্দেশ্যেই আমার পিতার হাতে গড়া আওয়ামী এ্যাকশন পার্টিতে যোগদান করি। এরপর আমি স্বাধীনতাকামী অন্য সব দলকে এক মঞ্চে আনার উদ্যোগ গ্রহণ করি। ’৯২-এর ২৭ ডিসেম্বর আমার বাড়িতে সর্বদলীয় বৈঠক হয়, যেখানে আমি সভাপতিত্ব করি। এভাবেই ১৯৯৩-এর ৯ মার্চ জন্ম হয় অল পার্টি হুরিয়াত কনফারেন্সের। গত বছর পর্যন্ত আমি এর সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছি।’ সর্বদলীয় সেই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন প্রবীণ জামায়াত নেতা সৈয়দ আলী শাহ গিলানী, ইসলামিক ফ্রন্টের আরেক বয়োজ্যেষ্ঠ নেতা মওলানা মোহাম্মদ আব্বাস আনসারী ও গোলাম মোহাম্মদ ভাটসহ অন্য মুসলিম নেতৃবৃন্দ। আঠারো বছরের তরুণ মীর ওয়াইয মোহাম্মদ উমর ফারুখকে হুরিয়াতের প্রথম সভাপতি নির্বাচনের মাধ্যমে এটাই প্রমাণ হয় যে কাশ্মীরী মুসলমানরা মীর ওয়াইয প্রথাকে যথেষ্ট মান্য করেন। সাক্ষাৎকারে উমর কথা বলেছেন উপমহাদেশীয় টানমুক্ত বিশুদ্ধ ইংরেজীতে এবং অত্যন্ত সাবলীলভাবে জবাব দিয়েছেন সব প্রশ্নের। মীর ওয়াইজ হওয়ার পর পড়াশোনায় কোন বিরতি দেননি বলে জানালেন উমর ফারুখ। বাড়িতে পড়াশোনা করেছেন। গত বছর ইসলামের ইতিহাসের ওপর স্নাতকোত্তর ডিগ্রী অর্জন করেছেন। উমর ফারুখের পিতা মীর ওয়াইয মৌলভী মোহাম্মদ ফারুখকে কারা হত্যা করেছে এটা এখনও রহস্যাবৃত। শ্রীনগরের সাংবাদিকরা বলেছেন তাঁকে হত্যা করেছে জঙ্গী মৌলবাদীরা। জম্মু কাশ্মীর ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্ট (জেকেএলএফ)-এর নেতারা বলেছেন, তাঁকে হত্যা করেছে ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনী। উমর ফারুখকে যখন এ বিষয়ে প্রশ্ন করি তিনি এর জন্য সরাসরি ভারতীয় বাহিনীকে দায়ী করেননি। বলেছেন, ‘তখন ভি পি সিং-এর সরকার ক্ষমতায় ছিল। আমরা ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারকে বলেছি তদন্ত করার জন্য। সরকার বলেছিল তদন্ত করবে, আজ পর্যন্ত সেই তদন্তের ফল আমরা জানি না। তবে আমার পিতার শুভানুগমন ও শোক মিছিলে পুলিশ হামলা চালিয়ে ৩৫ জনকে হত্যা করেছে। এই দিনটি আমরা এখনও কাশ্মীরে কালো দিবস হিসেবে পালন করি।’ কাশ্মীর স্বাধীন হলে এর রাষ্ট্রীয় নীতি কী হবে এর জবাবে উমর ফারুখ বলেছেন, ‘আমরা মনে করি সব কিছু ইসলামের বিধান অনুযায়ী চলা উচিত। তবে যেহেতু আমরা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি, আমরা মনে করি স্বাধীনতার পর কাশ্মীরী জনগণই স্থির করবেন তারা কোন ধরনের ব্যবস্থা চান।’ (ক্রমশ.)
×