ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

চলছে শিউলি ঝরার দিন

নীল আকাশে কে ভাসালে সাদা মেঘের ভেলা রে ভাই লুকোচুরি খেলা-

প্রকাশিত: ১০:২৫, ২৪ আগস্ট ২০১৯

নীল আকাশে কে ভাসালে সাদা মেঘের  ভেলা রে ভাই লুকোচুরি খেলা-

সমুদ্র হক ॥ ‘আজ ধানের ক্ষেতে রৌদ্রছায়ায় লুকোচুরি খেলা রে ভাই লুকোচুরি খেলা, নীল আকাশে কে ভাসালে সাদা মেঘের ভেলা রে ভাই....’ অমল ধবল পালে এমন সুরে লেগেছে হাওয়া। এসেছে শরত। ময়ূরকণ্ঠী মেঘনীল রৌদ্রোজ্জ্বল আকাশে কখন যে ছাইরঙা মেঘ জড়ো হয়ে একপশলা বৃষ্টি দিয়েই লুকিয়ে পড়ে টেরই পাওয়া যায় না। এর মধ্যেই অসহনীয় তাপপ্রবাহ শরীরকে নেতিয়ে ফেলে। -শরতে তো এত তাপ থাকার কথা নয়! কি যে হলো জলবায়ুর। এমন স্বগোক্তি বয়োজ্যেষ্ঠদের। এরপরও বাংলার ঋতুচক্রে এসেছে শরত। ঋতুচক্রে শরতের স্বভাবই নির্মল প্রশান্ত কোমল। একেবারে নিভৃতচারী। যুগে যুগে কবি-সাহিত্যিকরা মধুময় মিষ্টি ঋতু বলেছেন। বসন্তের মতো চোখ ধাঁধানো রূপের বাহার নেই। বর্ষার মতো নেই অঝোর বর্ষণ। আকাশে আগুনেররেখা চিড়ে তীব্র ঝলকানি ও গগনবিদারী শব্দ নেই। ঝড়োহাওয়া নেই। ঘন কুয়াশার আস্তরণ নেই। মাঝে মধ্যে যেটুকু বৃষ্টি ঝরে তারও একটা ছন্দ আছে। শান্ত আকাশে বৃষ্টি ঝরিয়ে নববধূর মতো অবগুণ্ঠনের আঁচল ঠোঁট কামড়ে ধরেই লাজুক হয়ে যায়। বসন্তকে বলা হয় ফুলের পাপড়িতে রোমান্টিকতায় ভরা প্রণয় মধুর ঋতু। তবে শরতের ধ্রুপদী রোমান্টিকতার কাছে তা কিছুই নয়। এত ক্লাসিক রোমান্টিকতা অন্য কোন ঋতুর সঙ্গে মেলেই না। শরতই একমাত্র ঋতু যে তার আঙ্গিনায় ফিরে যাওয়া বর্ষাকে কিছুটা সময় থাকতে দেয়। আর মহা ধরিবাজ বর্ষা অন্যের অধিকারে হস্তক্ষেপ করে বেপরোয়া হয়ে ওঠে। অঝোর ধারায় ঝরে পথঘাট ডুবিয়ে দেয়। তখনই শরত ক্ষেপে গিয়ে প্রবাদের ভাষায় ‘বসতে দিলে শুতে চায়’ দেখাচ্ছি মজা। বারিধারা ঝেটিয়ে বিদায় করে আকাশে খেয়ালি রূপালী মেঘ ভাসিয়ে দেয়। ঝলমলে আকাশে শরতের উচ্ছ্বাসে সজীব হয় ধরণী। শরতের নিসর্গ প্রকৃতি ঘিরে কবিগুরুর কত কবিতা, কত গান বাংলা সাহিত্যকে সুবাসিত করেছে তার ইয়ত্তা নেই। ‘শরত প্রাতের প্রথম শিশির প্রথম শিউলি ফুলে, ওগো শেফালি বনের মনের কামনা, হৃদয় কুঞ্জবনে মঞ্জরিল মধুর শেফালিকা, আমরা বেঁধেছি কাশের গুচ্ছ/আমরা বেঁধেছি শেফালি মালা, শিউলি সুরভিত রাতে বিকশিত জ্যোৎ স্রোতে’ ...এমন হাজারো কথামালায় সৃষ্টি শরতের রূপের বর্ণনা চিরন্তন হয়ে আছে। প্রকৃতির এমন রূপ মহানগরে চোখে পড়ে না। কংক্রিটের বনে যেখানে শেষ বিকেলের সোনা রোদের লাজুক আলো ঢুকতেই বাধা পায় সেখানে ক্লাসিক শরত কী করে ধরা দেবে! শরতকে হৃদয়ের গভীর কোণের সুপ্ত ভাললাগা দিয়ে অনুভব করা যায় গ্রামের পথে পা বাড়ালে। যদিও দিনে দিনে সেই ছায়ায় ঘুঘু ডাকা, মায়া ভরা গ্রামের চিরচেনা দৃশ্যের পরিবর্তন হচ্ছে। তবুও ঋতুবৈচিত্র্য অনুভব করা যায় শরতে। প্রকৃতি তার রূপ মেলে ধরে প্রাণ জুড়িয়ে দেয়। নদী তীরে, কোন চরগ্রামে বালুচরে কাশবনে শুভ্র ফুলের গুচ্ছে অনুপম হিল্লোল তোলে নিসর্গ। কাশবনে খুঁজে পাওয়া যায় সত্যজিৎ রায়ের অমর সৃষ্টি ‘পথের পাঁচালী’ চলচ্চিত্রের দুর্গা আর অপুকে। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই গল্পে দুর্গা-অপুর কিশোর প্রণয়ের যে চিরন্তন ও মধুময় রূপ তুলে ধরা হয়েছে শরতের অম্লান রূপই তা ধরে রেখেছে অনন্তকালের হয়ে। শরত শশীরও গর্ব আছে। পূর্ণিমা তিথিতে মায়াবি স্নিগ্ধ আলোয় সিক্ত রাতে নদীর শান্ত ঢেউয়ে চাঁদ ও তারাকে দেখে মনে হবে আকাশ থেকে নেমে নাচছে। প্রবীণরা এমন দৃশ্যে নস্টালজিক হয়ে ফিরে পান তারুণ্যের দিনগুলোয়। হৃদয়ে বাজে সায়গলের কণ্ঠের গান ‘ঝুমুর ঝুমুর নূপুর বাজে চাঁদ নাচে তারা নাচে পাহাড়িয়া ওই নূপুরে বুঝি বন্দী আছে।’ এমন রূপে মাধুরিতে জলাশয়ে ফোটে শাপলা পদ্ম। কোন কিশোর শালুক-ভ্যাট ফুল তুলে পরিয়ে দেয় কিশোরীর খোঁপায়। রূপ পায় কিশোর প্রণয়। শরতের মাধুর্যে পথের ধারে ঝাউবনে ফোটে নাম না জানা কত বনফুল। শরত আগলে রাখে শিউলি ফুলকে। আছে পৌরাণিক উপাখ্যান। সূর্যের প্রভায় মুগ্ধ হয়ে প্রেমে পড়ল এক রাজকন্যা। প্রত্যাখ্যান করল সূর্য। অভিমানে রাজকন্যার আত্মহনন। সেই চিতার ছাই থেকে গজাল উঁচু একটি গাছ। মায়াবি রাতে ফুটল মিষ্টি সৌরভের ফুল। ঝরে পড়ল সূর্য ওঠার আগেই। উপাখ্যানে নিশুতি রাতের এই ফুলই শিউলি। অন্য নাম শেফালি। ফুলগুলো ঝরে ভরে ওঠে গাছতলা। কিশোরবেলায় শিউলিতলায় ফুল কুড়োতে যাওয়া আর মালা গাঁথার আনন্দ অন্যরকম। একটা সময় গ্রামে ও শহরের অনেক বাড়িতেই শিউলি গাছের দেখা মিলত। শিউলি, টগর, মালতি না ফুটলে যে শরত বেমানান। শরতেই হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের শারদীয় উৎসবের বাদ্যি বাজে। সুরসাগর জগন্ময় মিত্রের কণ্ঠের সেই অমর গান ‘এমনি শারদ রাতে তোমায় আমায় দেখা হলো সেই আঙ্গিনায় জ্যোৎস্নাতে...।’ শরতের হৃদয়জুড়ে বাজে এমন কত সুর।
×