ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

রমার কথায় চোখের জল আটকাতে পারেননি অনেকেই

৩০ দেশের কূটনীতিক শুনলেন ১৫ ও ২১ আগস্টের নির্মমতা

প্রকাশিত: ১০:২৬, ২৪ আগস্ট ২০১৯

  ৩০ দেশের কূটনীতিক শুনলেন ১৫ ও ২১  আগস্টের নির্মমতা

স্টাফ রিপোর্টার ॥ বাংলাদেশের ইতিহাসের কলঙ্ক ১৫ ও ২১ আগস্টের ভয়াবহতার কথা বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকদের জানাল ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। একই সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনা চলে পলাতক বঙ্গবন্ধুর খুনীদের দেশে ফিরিয়ে আনার প্রস্তুতি নিয়ে। শুক্রবার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেনের উপস্থিতিতে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরে আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিক বিষয় উপ-কমিটি আয়োজিত ‘বাংলাদেশের উপর ১৫ আগস্টের প্রভাব’ শীর্ষক সেমিনারে উপস্থিত ছিলেন ঢাকায় নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকবৃন্দ। আলোচনা শেষে তারা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি স্মারকে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন। শেখ মুজিব নয়, বাংলাদেশকে হত্যা ॥ পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট শুধু সপরিবারে শেখ মুজিবকে হত্যা করা হয়নি। সেই সঙ্গে বাংলাদেশকেও হত্যা করে আরেকটি পাকিস্তান বানানোর চেষ্টা করা হয় বলে মন্তব্য করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গবর্নর ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন। তিনি বলেন, পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেই ক্ষান্ত হয়নি ঘাতকেরা, পরিকল্পিত আওয়ামী লীগের প্রথম সারির নেতাদের একে একে হত্যা করে। তাদের মূল লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশ থেকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা মুছে ফেলে আরেকটি পাকিস্তান রাষ্ট্র তৈরির। কিন্তু তারা সফল হয়নি। যে বাংলাদেশকে তারা হতে দিতে চায়নি বলে শেখ মুজিবকে হত্যা করেছিল। সেই বাংলাদেশ আজ গড়ে উঠছে তার কন্যা শেখ হাসিনার হাত ধরে। ’১৭ সালে মাথাপিছু আয়ে আমরা পাকিস্তানকে ছাড়িয়ে গেছি। এ সবই সম্ভব হয়েছে জাতির পিতার দেখানো পথে চলে। আলোচনায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন বলেন, বঙ্গবন্ধু প্রদর্শিত পথে চলতে না দেয়ায় আমরা এখনও পিছিয়ে আছি। যদি তার দেখানো পথে বাংলাদেশ এগিয়ে যেতে পারত, তাহলে হয়ত এখন আমরা উন্নত রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি পেতাম। বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলাদেশ ॥ ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হারানো বাংলাদেশে কতটা প্রভাব ফেলেছে তা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, আমাদের জানা উচিত বাংলাদেশের জন্য উনি কী পরিকল্পনা করে গেছেন। কৃষিনির্ভর এই দেশের কৃষকের স্বার্থে কাজ করেছেন তিনি। ’৭২ সালে দেশে ফেরার পর থেকে তিনি সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন কৃষি ও শিক্ষা খাতে। যুদ্ধপরবর্তী বাংলাদেশে কৃষিজমির খাজনা হ্রাস এবং ১৬ হাজারের বেশি যুদ্ধবিধ্বস্ত স্কুল পুনর্নির্মাণ ও সরকারের অধিভুক্ত করেন তিনি। পররাষ্ট্রমন্ত্রী আরও বলেন, বাংলাদেশের সংবিধান বিশ্বের জন্য বিস্ময়। কেননা যুক্তরাষ্ট্র স্বাধীন হওয়ার পর তার সংবিধান তৈরিতে সময় লেগেছে প্রায় ১১ বছর। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে সংবিধান তৈরি করতে সময় লাগে প্রায় ৩ বছর। পাকিস্তানেরও প্রথম সংবিধান তৈরি করতে সময় লেগেছিল ৯ বছর, সেখানে মাত্র ৯ মাসে আমরা আমাদের সংবিধান তৈরি করতে পেরেছি শুধুমাত্র বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কারণে। ফিরিয়ে আনা হবে বঙ্গবন্ধুর খুনীদের ॥ আলোচনা শেষে প্রশ্নোত্তর পর্বে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, বঙ্গবন্ধুর খুনীদের ফিরিয়ে আনতে যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার সঙ্গে কথা বলছে সরকার। যুক্তরাষ্ট্র এর আগে বঙ্গবন্ধুর এক খুনীকে হস্তান্তর করেছে। আশা করছি বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীর আগে যুক্তরাষ্ট্র এই আত্ম স্বীকৃত খুনীকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠাবে। এ সময় বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গবর্নর ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন বলেন, কানাডায় বঙ্গবন্ধুর আত্ম স্বীকৃত খুনীদের একজন রয়েছেন। কানাডা সরকারের সঙ্গে আমরা কথাও বলেছি। তাকে সেখানে আশ্রয় দেয়া হয়নি। কিন্তু কানাডা মৃত্যুদ-কে সমর্থন করে না, এ কারণে মৃত্যুদ-প্রাপ্ত আসামিদের তারা কোন দেশের কাছে হস্তান্তর করে না। পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম কানাডার ব্যতিক্রমী এক উদ্যোগের বিষয়কে স্মরণ করিয়ে বলেন, সম্প্রতি টেক্সাসের মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত এক আসামিকে যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনে প্রেরণ করেছে কানাডা। কেননা ওয়াশিংটন মৃত্যুদন্ডকে সমর্থন করে না। কিন্তু ওয়াশিংটনে প্রেরণের পর যুক্তরাষ্ট্র সরকার তাকে টেক্সাসে প্রেরণ করে যেখানে ওই আসামির মৃত্যুদন্ড কার্যকর হয়। তিনি আরও বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে থাকা বঙ্গবন্ধুর অপর খুনীকে বাংলাদেশে ফেরত আনতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছে চিঠি দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আইন ও শাসনের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের যে নীতি রয়েছে, তাতে আমরা আশাবাদী এই খুনীকে ফেরত পাঠাবে তারা। প্রত্যক্ষদর্শী রমার মুখে পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট ॥ আব্দুর রহমান শেখ (রমা) বলেন, আবদুর রব সেরনিয়াবাতের হত্যাকান্ডের খবর পাওয়ার পর বেগম মুজিব আমাকে রাস্তায় পাঠান দেখে আসার জন্য। আমি দোতলা থেকে নেমে দরজা খুলে বাহিরে গিয়ে দেখে আর্মি অফিসাররা গুলি করতে করতে এগিয়ে আসছে। আমি আবারও দৌড়ে ঘরের ভেতর গিয়ে খবরটি বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিবকে দিলে তিনি তার বড় ছেলে ও মেঝো ছেলেকে ডেকে আনতে বলেন। আমি তিন তলায় গিয়ে কামাল ভাই ও দোতলা থেকে জামাল ভাইকে ডাকি। এ সময় দোতলায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কারও সঙ্গে ফোনে কথা বলছিলেন।’ তিনি ওই ভোর রাতের ভয়াবহতা বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, যখন ওরা গুলি করতে করতে ঘরে প্রবেশ করে তখন শেখ রাসেল ও আমাদের নিয়ে বেগম ফজিলাতুন্নেসা একটি ঘরে দরজা বন্ধ করে ছিলেন। তিনি আমাদের তার পেছনে থাকতে বলেন। যখন দরজা খোলার জন্য বলা হয়, তিনি দরজা খুলেন। তাকে ওপরের ঘরে যেতে বলে সৈন্যরা। কিন্তু সিঁড়ির কাছে স্বামীর লাশ দেখতে পেয়ে তিনি বলেন, ‘আমাকে মেরে ফেলতে চাইলে এখানেই মেরে ফেলো।’ ওখানে থাকা সৈন্যরা তখন ফায়ার করে। ‘এরপর ওই সৈন্যরা বাড়ির সামনে আম গাছের কাছে নিয়ে বসায় আমাদের ও শেখ রাসেলকে। তখনও দোতলার ঘরগুলোতে গুলির আওয়াজ ও মেয়েদের চিৎকার-আর্তনাদ শোনা যাচ্ছিল। খুব সম্ভবত শেখ কামাল ও শেখ জামাল ভাইয়ের বউকে তারা ওই সময় হত্যা করে। এরপর গুলির আওয়াজ থেমে যায়।’- কথাগুলো বলছিলেন আব্দুর রহমান শেখ (রমা)। সেনা সদস্যদের নির্মম আচরণের সঙ্গে তখনো পরিচিত ছিলেন না রমা। সে কারণেই আম গাছের নিচে বসিয়ে রাখা শেখ রাসেল যখন কাঁদতে কাঁদতে জিজ্ঞাসা করছিল, ‘ওরা কি আমাকেও মেরে ফেলবে’। তখন ১২ বছরের রমা ও বসে থাকা অন্যরা বলেছিল, ‘না, তোমাকে মারবে না।’ হয়ত তাদের বিশ্বাস ছিল ছোট রাসেলকে মারার কোন প্রয়োজনীয়তা নেই। কিন্তু একটু পরে আর্মির বড় অফিসার ট্যাঙ্ক নিয়ে প্রবেশ করলে ওখানে থাকা এক সৈন্য তাকে গিয়ে বলে, ‘শেখ রাসেল তার মার সঙ্গে দেখা করতে চাচ্ছে।’ উত্তরে সেই আর্মি অফিসার বলেন, ‘আমরা সেই ব্যবস্থা করতে পারি।’ এরপর মায়ের সঙ্গে দেখা করানোর কথা বলে শেখ রাসেলকে উপরে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে বেশ কিছু সময় শেখ রাসেলের কান্নার আওয়াজ পাই আমরা। এরপর চার-পাঁচটা গুলির শব্দ শুনি। ব্যস। একেবারে নিঃশব্দ। কোন কান্নার আওয়াজ নেই। রমার কথা শুনে উপস্থিত অনেকেই চোখের জল আটকে রাখতে পারেননি। সেমিনারে আরও উপস্থিত ছিলেন আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিক বিষয় উপ-কমিটির সাধারণ সম্পাদক ড. শাম্মী আহমদ ও উপ-কমিটির অন্যান্য সদস্য এবং যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, রাশিয়া, চীন, স্পেন, সুইজারল্যান্ড ও জাপানসহ ৩০ দেশের কূটনীতিক।
×