ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বিএনপির দুই অফিস ঘিরে দুই বলয়

প্রকাশিত: ১০:২৯, ২৪ আগস্ট ২০১৯

বিএনপির দুই অফিস ঘিরে দুই বলয়

শরীফুল ইসলাম ॥ বিএনপির দুই কার্যালয়কে ঘিরে দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে দুই বলয় সৃষ্টি হয়েছে। এ নিয়ে দুই কার্যালয়ের নিয়ন্ত্রণকারীদের মধ্যে টানাপোড়েন চলছে। কারা কোন কার্যালয়ে বসে দলে আধিপত্য বিস্তার করবে এ নিয়ে রীতিমতো চলছে প্রতিযোগিতা। তবে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার অনুপস্থিতিতে দুই বলয়ের নেতারাই লন্ডনপ্রবাসী ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখেন। আর তারেক রহমানও নিজের অবস্থান সুদৃঢ় রাখতে উভয়কূল রক্ষা করে চলেন। সূত্র জানায়, বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া কারাবন্দী হওয়ার পর থেকেই তার গুলশান কার্যালয় ও নয়াপল্টন কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের নিয়ন্ত্রণ ও দলে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে বিভক্ত হয়ে পড়েন সিনিয়র নেতারা। আর তাদের অনুসরণ করতে গিয়ে তৃণমূল নেতাকর্মীরাও দুই বলয়ে বিভক্ত হয়ে পড়েন। একদিকে মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর তার অনুসারীদের নিয়ে গুলশান কার্যালয় থেকে দল নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেন। আর অপরদিকে দলের দফতরের দায়িত্বে নিয়োজিত সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী তার অনুসারীদের নিয়ে নয়াপল্টন কেন্দ্রীয় কার্যালয়কে নিজের আবাসিক কার্যালয় বানিয়ে এখান থেকেই দলীয় কর্মকা- পরিচালনায় আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা করেন। খালেদা জিয়া কারাবন্দী হওয়ার পর একদিনের জন্যও নিজের বাসায় যাননি তিনি। তার স্ত্রী মাঝেমধ্যে দলীয় কার্যালয়ে গিয়ে তার সঙ্গে দেখা করে আসেন। জানা যায়, মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও রুহুল কবির রিজভী নিয়মিত লন্ডন প্রবাসী তারেক রহমানের সঙ্গে আলাদাভাবে নিয়মিত যোগাযোগ করে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা নেন। তবে দুই কার্যালয় থেকে দলীয় কর্মকা-ের সমন্বয় না করে আলাদাভাবে সিদ্ধান্ত নেয়ার কারণে, মাঝে মাঝে একই বিষয়ে ভিন্ন ভিন্ন সিদ্ধান্ত আসে। এর ফলে সারাদেশের সর্বস্তরের নেতাকর্মীদের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়। মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর মাঝে মধ্যে বিএনপি কার্যালয়ে গিয়ে প্রয়োজনীয় কাজ সেরে চলে যান। তবে গুলশান কার্যালয়ে তিনি নিয়মিতই যান। আর দিনরাত নয়াপল্টন কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে অবস্থান করে প্রায় প্রতিদিনই সংবাদ সম্মেলন করেন রিজভী। কখনও কখনও মধ্যরাতেও সংবাদ সম্মেলন করেন। আবার কোন কোন দিন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত ৩ থেকে ৪ বারও সংবাদ সম্মেলন করেন। এদিকে বিএনপির দুই কার্যালয়ের আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে দলীয় কর্মকা- পরিচালনা করতে গিয়ে দলের সাধারণ নেতাকর্মীরা নানামুখী সমস্যার সম্মুখীন হন। দুই কার্যালয়ের আধিপত্য বিস্তারকারী নেতাদের রেষারেষির কারণে কখনও কখনও বিভিন্ন কর্মসূচী পালন বাধাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। এ নিয়ে দলের নেতাকর্মীদের মধ্য চরম অসন্তোষ বিরাজ করছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন বিএনপি নেতা জানান, গতবছর ৮ ফেব্রুয়ারি দলের চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া কারাবন্দী হওয়ার পর থেকেই দেখা যাচ্ছে সাধারণত জাতীয় কোন ইস্যুতে সিদ্ধান্ত আসে গুলশান কার্যালয় থেকে। আর দলের অভ্যন্তরীণ ও সাংগঠনিক বিষয়ে সিদ্ধান্ত আসে নয়াপল্টন কেন্দ্রীয় কার্যালয় থেকে। তবে এসব সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় দলের স্থায়ী কমিটি, ভাইস চেয়ারম্যান, চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টাসহ ৫৯২ সদস্যের নির্বাহী কমিটির অধিকাংশ নেতার সম্পৃক্ততা থাকে না। আর এ কারণে দলের অধিকাংশ নেতা দলীয় কর্মকান্ডে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছেন। তাই এখন দলের কোন কর্মসূচীই তেমন সফল হচ্ছে না। একই কারণে খালেদা জিয়ার মুক্তিসহ বিভিন্ন ইস্যুতে রাজপথের আন্দোলন কর্মসূচীও পালন করতে পারছে না বিএনপি। পর্যবেক্ষক মহলের মতে একটি রাজনৈতিক দলের জন্য সুসময়-দুঃসময় অত্যন্ত স্বাভাবিক বিষয়। সুসময়কে সঠিকভাবে কাজে লাগানো এবং দুঃসময়ে সময়োপযোগী পদক্ষেপ নিয়ে দল পরিচালনা করাই নেতাদের দায়িত্ব। কিন্তু সে দায়িত্ব সঠিকভাবে পরিচালনা না করতে পারলেই নেমে আসে বিপর্যয়। আর এ কারণেই বিএনপির এখন চরম দুর্দিন যাচ্ছে। প্রায় ১৩ বছর হলো বিএনপি ক্ষমতার বাইরে। এ ধরনের পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক দলগুলোকে সাধারণত সর্বস্তরে দল গুছিয়ে সাংগঠনিক শক্তি বৃদ্ধি করতে হয়। সেই সঙ্গে রাজপথে আন্দোলন চাঙ্গা করার চেষ্টা করতে হয়। যেভাবে আওয়ামী লীগ দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে থেকেও দলের শক্তি বৃদ্ধি করতে পেরেছিল। কিন্তু বিএনপি সাংগঠনিক শক্তি বৃদ্ধি দূরে থাক দিন দিন দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। আর এ অবস্থার জন্য দলের সিনিয়র নেতারাই দায়ী। সূত্র জানায়, কারাবন্দী বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার সহসা মুক্তি পাওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই। কারণ, দুই মামলায় সাজা হলেও আরও ক’টি মামলা রয়েছে বিচারাধীন। একে একে আরও ক’টি মামলায়ও তার সাজা হতে পারে। আর লন্ডন প্রবাসী দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বিরুদ্ধেও একাধিক মামলায় সাজা হয়েছে। এছাড়া গ্রেফতারি পরোয়ানা থাকায় তারেক রহমান দেশে ফিরে আসার সম্ভাবনা ক্ষীণ। তাই এ পরিস্থিতিতে দুই কার্যালয়ের রেষারেষিতে দল চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বিএনপি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক বিএনপি নেতা বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে দলের সাংগঠনিক শক্তি বৃদ্ধি করে যেখানে সরকারবিরোধী আন্দোলন জোরদার করার চেষ্টা করা দরকার, সেখানে তা না করে দলের আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে দুই কার্যালয়ের নেতারা দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েছেন। তারা সবাই নিজ নিজ স্বার্থ হাসিলে ব্যস্ত। নিজেদের মধ্যে শক্তি ক্ষয় করে তারা দলকে আরও দুর্বল করতেই ব্যস্ত। এ কারণেই এখন খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিসহ কোন ইস্যুতেই আন্দোলন হচ্ছে না। সম্প্রতি ছাত্রদলের নতুন কমিটি গঠনকে কেন্দ্র করেও দুই কার্যালয়ের দুই রকম অবস্থান লক্ষ্য করা যায়। বিক্ষুব্ধ ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে অবস্থান কর্মসূচী পালন, দলীয় কার্যালয়ে ভাংচুর ও রুহুল কবির রিজভীকে নাজেহাল করার পর নয়াপল্টন কেন্দ্রীয় কার্যালয় থেকে সংগঠনের ১২ নেতাকে বহিষ্কার করা হয়। পরে বহিষ্কৃত নেতারা গুলশান কার্যালয়ে দৌড়ঝাপ করলে তাদের বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করা হয়। এ নিয়ে দুই কার্যালয়ের আধিপত্য বিস্তারকারী নেতাদের মধ্যে মনোমালিন্য হয়।
×