ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

যুদ্ধকালীন সরকারের উপদেষ্টা অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ আর নেই

প্রকাশিত: ১২:৩৯, ২৪ আগস্ট ২০১৯

যুদ্ধকালীন  সরকারের উপদেষ্টা  অধ্যাপক মোজাফফর  আহমদ আর নেই

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ ভারতীয় উপমহাদেশের বাম রাজনীতির পুরোধা ব্যক্তিত্ব, স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতিদের অন্যতম, মুজিবনগর সরকারের উপদেষ্টাম-লীর সর্বশেষ সদস্য, বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) প্রধান অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ আর নেই। শুক্রবার সন্ধ্যা ৭টা ৪৫ মিনিটে তিনি রাজধানীর এ্যাপোলো হাসপাতালে ইন্তেকাল করেন (ইন্না লিল্লাহি...রাজিউন)। তার বয়স হয়েছিল ৯৭ বছর। তিনি বার্ধক্যজনিত বিভিন্ন রোগে ভুগছিলেন। পরিবারের সদস্যরা জানান, গত কয়েক দিন ধরে তিনি রাজধানীর এ্যাপোলো হাসপাতালের আইসিইউতে লাইফ সাপোর্টে ছিলেন। তার মৃত্যুর বিষয়াটি নিশ্চিত করেন ন্যাপের আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক পরিতোষ দেবনাথ। অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের একমাত্র জীবিত সদস্য ছিলেন। জীবন সায়াহ্নে এসে বারিধারার পার্ক রোডে মেয়ের বাড়িতে থাকতেন তিনি। গত ১৪ আগস্ট অধ্যাপক মোজাফফরকে এ্যাপোলো হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এ ক’দিন তাকে হাসপাতালের আইসিইউতে রাখা হয়। অবশেষে সেখানেই তিনি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদের মৃত্যুতে শোক ও গভীর দুঃখ প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এক শোকবার্তায় মরহুমের বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা ও তার শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান রাষ্ট্রপতি। শোক বিবৃতিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অধ্যাপক মোজাফফর আহমদের দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে দেশের মহান স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধ এবং বিভিন্ন গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ভূমিকার কথা স্মরণ করেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘দেশের প্রগতিশীল রাজনীতিতে তার অবদান জাতি চিরদিন শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবে।’ শোক বিবৃতিতে প্রধানমন্ত্রী মরহুমের পরিবারের শোকাহত সদস্যদের প্রতি সমবেদনা জানান ও বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করেন। ১৯২২ সালের ১৪ এপ্রিল কুমিল্লার দেবীদ্বার উপজেলার এলাহাবাদ গ্রামে মোজাফফর আহমদ জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে সম্মানসহ স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রী আর্জন করেন। পরবর্তীতে তিনি ইউনেসকো ডিপ্লোমা ডিগ্রীও লাভ করেন। কৃতিত্বের সঙ্গে শিক্ষা জীবন শেষ করে তিনি অধ্যাপনার পেশায় যোগ দিয়েছিলেন। প্রথমে চট্টগ্রাম সরকারী কলেজ পরে ঢাকা কলেজ এবং তারপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি পড়িয়েছেন। ১৯৫২ থেকে ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে অধ্যাপনা করেন। ১৯৫৪ সালে অধ্যাপনা ছেড়ে দিয়ে সম্পূর্ণভাবে রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হন তিনি। ১৯৫২ সালে তিনি ভাষা আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে তিনি যুক্তফ্রন্টের প্রার্থী হিসেবে জয়ী হয়েছিলেন। ১৯৫২ সালের ২৪ অক্টোবর আমিনা আহমেদকে বিয়ে করেন। আর একমাত্র মেয়ে আইভির জন্ম হয় ১৯৫৫ সালে। বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের অধিকারী অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন ও স্বাধীনতা যুদ্ধে তার ভূমিকা অবিস্মরণীয়। বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার যে ধারাবাহিক লড়াই-সংগ্রাম তাতে অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদের বড় অবদান রয়েছে। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে ঢাকার কাকরাইলে মোজাফফর আহমদের বাবার বাড়ি লক্ষ্য করে গোলাগুলি শুরু হলে তিনি বাসা থেকে বেরিয়ে যান। এরপর সীমান্ত পেরিয়ে চলে যান ভারতের আগরতলায়। তিনি মুক্তিযুদ্ধের একজন অন্যতম সংগঠক। ন্যাপ-সিপিবি-ছাত্র ইউনিয়নের যৌথ গেরিলা বাহিনীরও তিনি অন্যতম সংগঠক। একাত্তরে ন্যাপ ও কমিউনিস্ট পার্টি-ছাত্র ইউনিয়নের কর্মীদের নিয়ে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়তে বিশেষ গেরিলা বাহিনী গড়ে তোলায় নেতৃত্ব দেন মোজাফফর আহমদ। প্রশিক্ষণ শেষে ওই বাহিনী ঢাকা, নরসিংদী, কুমিল্লা, নোয়াখালী, চট্টগ্রাম, রংপুরসহ বিভিন্ন রণাঙ্গনে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়। মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকারে সর্বদলীয় উপদেষ্টা কমিটির সদস্য ছিলেন অধ্যাপক মোজাফফর। তাজউদ্দীন আহমদকে আহ্বায়ক করে ছয় সদস্যের মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রবাসী সরকারের উপদেষ্টাম-লী গঠন করা হলে তাতে অধ্যাপক মোজাফফর আহমদকেও সদস্য করা হয়। বাংলাদেশের পক্ষে আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায় ও জনমত গড়ে তোলার জন্য তিনি সোভিয়েত ইউনিয়নসহ বিভিন্ন দেশ সফর করেছেন। জাতিসংঘেও তিনি বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে যোগ দেন। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে যোগ দিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে বিশ্বজনমত গঠনে ভূমিকা পালন করেন মোজাফফর আহমদ। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর মন্ত্রিত্ব নিতে অস্বীকার করা মোজাফফর আহমদ ২০১৫ সালে বাংলাদেশ সরকারের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা স্বাধীনতা পুরস্কারও গ্রহণ করেননি। তিনবছর আগে সরকার তাকে স্বাধীনতা পদক দিতে চেয়েছিল। তিনি সবিনয়ে তা গ্রহণে অপারগতা প্রকাশ করেন। দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে তিনি একাধিকবার কারাবরণ করেছেন। ১৯৭৯ সালের নির্বাচনে অধ্যাপক মোজাফফর সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৮১ সালে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে তিনি ন্যাপ-সিপিবি ও প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক শক্তির প্রার্থী হয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। ন্যাপের প্রেসিডিয়াম সদস্য স্ত্রী আমিনা আহমেদ আওয়ামী লীগের মনোনয়নে নবম সংসদের সংরক্ষিত আসনের সাংসদ ছিলেন। বর্ষীয়ান এই রাজনীতিবিদের মৃত্যুতে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা, মন্ত্রী ও বুদ্ধিজীবী মহল শোক প্রকাশ করেছেন। তার মৃত্যুতে শোক জানিয়েছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপার্সন তারেক রহমান ও দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। এ ছাড়া মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (ন্যাপ) অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য অধ্যাপক মোজাফফর আহমদের মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন বাংলাদেশ ন্যাপের চেয়ারম্যান জেবেল রহমান গাণি ও মহাসচিব গোলাম মোস্তফা ভূঁইয়া। শোক বার্তায় তারা বলেন, বাংলাদেশের জাতীয় রাজনীতিতে কিংবদন্তিতুল্য এ নেতার মৃত্যুতে দেশ হারাল একজন অভিভাবক রাজনীতিককে। জীবনে অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ কখনও অন্যায়ের সঙ্গে আপোস করেননি মন্তব্য করে ন্যাপ নেতারা বলেন, মুক্তিযুদ্ধে অবদানস্বরূপ সরকার ২০১৫ সালে তাকে স্বাধীনতা পদকের জন্য মনোনীত করলেও তিনি সবিনয়ে তা ফিরিয়ে দেন। তার মতে, রাজনীতির অর্থ দেশ এবং মানুষের সেবা। পদ বা পদবির জন্য কখনও রাজনীতি করেননি তিনি। পদক দিলে বা নিলেই যে মানুষ সম্মানিত হয়, এ দৃষ্টিভঙ্গিতে তিনি বিশ্বাসী ছিলেন না।
×