ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

জাল স্ট্যাম্প মার্কেট ॥ দেশজুড়ে শত কোটি টাকার ব্যবসা

প্রকাশিত: ১০:৫২, ২৫ আগস্ট ২০১৯

জাল স্ট্যাম্প মার্কেট ॥ দেশজুড়ে শত কোটি টাকার ব্যবসা

আজাদ সুলায়মান ॥ সারাদেশে জাল স্ট্যাম্পের একটি শক্তিশালী নেটওয়ার্ক প্রায় শত কোটি টাকার মার্কেট গড়ে তুলেছে। বৈধ স্ট্যাম্প ব্যবসার মতো এজেন্ট নিয়োগ করে দীর্ঘদিন ধরেই চক্রটি সক্রিয়। হাজার হাজার লোক জাল স্ট্যাম্প কিনলেও তা ধরা পড়ছে না। কারণ নকল টাকা যত সহজে শনাক্ত করা সম্ভব, জাল স্ট্যাম্প ধরা ততটাই কঠিন। গোয়েন্দা পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন সংস্থা দেশব্যাপী নকল টাকা ধরার জন্য বিশেষ অভিযান চালানোসহ সারাবছরই মাঠে থাকে। কিন্তু নকল স্ট্যাম্পের বিরুদ্ধে কখনও কোন বিশেষ অভিযান বা পদক্ষেপ নেয়া হয় না। এই সুযোগে রাজধানীসহ দেশব্যাপী গড়ে উঠেছে নকল স্ট্যাম্পের সুবিস্তৃত মার্কেট। এই চক্রের লোকজন প্রকাশ্যেই কোর্ট কাছারি, সাবরেজিস্ট্রি অফিস ও নোটারি চেম্বারগুলোয় প্রতিদিনই লাখ লাখ টাকার নকল স্ট্যা¤প বিক্রির লেনদেন করে যাচ্ছে। সম্প্রতি ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের সিরিয়াস ক্রাইম ইনভেস্টিগেশনের রবারি প্রিভেনশন টিমের সিনিয়র সহকারী পুলিশ কমিশনার সোলায়মান মিয়া এ ধরনের তথ্য প্রকাশ করেন। তিনি জানান, তার নেতৃত্বে একটি শক্তিশালী টিমের অভিযানে গত ৯ আগস্ট পল্টন মডেল থানা এলাকায় এক কোটি টাকারও বেশি জাল স্ট্যাম্প উদ্ধার হয়। এ সময় নাইম ইসলাম ও আমিনুল হক দুজনকে গ্রেফতার করা হয়। তবে অভিযানের খবর পেয়ে সুকৌশলে সটকে পড়ে রাসেল আহম্মেদ শান্ত। এরপর থেকে তাকে ধরার জন্য চলে ব্যাপক অভিযান। আটক দুজনকে জিজ্ঞাসাবাদে বেরিয়ে আসে রাজশাহীসহ দেশব্যাপী জাল স্ট্যাম্পের শক্তিশালী নেটওয়ার্কের চাঞ্চল্যকর তথ্য। জানা যায়, রাসেল পালাতে সক্ষম হলেও জাল স্ট্যাম্পের এই সিন্ডিকেট কিভাবে দেশব্যাপী ডিলার নিয়োগের মাধ্যমে শত কোটি টাকার মার্কেট গড়ে তোলা হয়েছে সে সম্পর্কে চমকপ্রদ তথ্য ফাঁস করেছে আটক নাইম ইসলাম ও আমিনুল। তারা দুজন স্বীকার করে কিভাবে কত বছর ধরে এ ব্যবসায় সক্রিয়। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তারা দুজনেই নিজেদের জাল স্ট্যাম্প কেচাকেনা দলের সদস্য হিসেবে স্বীকার করে। তারা দীর্ঘদিন এ চক্রের সঙ্গে জড়িত তারা জানায়, তাদের তৈরি জাল স্ট্যাম্প তারা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান যেমন, পোস্ট অফিস, কোর্ট ও সাবরেজিস্ট্রির অফিসে কর্মরত কিছু অসাধু কর্মচারীর কাছে বিক্রি করে। চক্রটির অন্যান্য সদস্যকে গ্রেফতারের জন্য ডিবির সিরিয়াস ক্রাইম বিভাগ মাঠে নেমেছে বলে জানান সোলায়মান মিয়া। ডিবি সূত্র মতে, জাল স্ট্যাম্প চক্রের মূল হোতা রাসেল আহম্মেদ শান্তর বাড়ি বরগুনার তালতলা থানার কবিরাজ পাড়ায়। সে এ/পি-১১৯, ফকিরাপুলে থেকে প্রথমে রাজধানীতে গড়ে তোলে একটি নিয়ন্ত্রিত মার্কেট। তার অপর দুই সহযোগী হিসেবে দায়িত্ব পালন করে শরীয়তপুরের সখিপুর থানার সুবেদবালারকান্দি গ্রামের নাইম ইসলাম (১৯) ও মতলব কালাদি এলাকার আমিনুল হক। এই তিনজন প্রথমে পল্টনের একটি বাড়িতে গড়ে তোলে জাল স্ট্যাম্প তৈরির কারখানা। আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে এরা কয়েকটি কম্পিউটার প্রিন্টার ও ডিভাইসের মাধ্যমে অনায়াসেই জাল স্ট্যাম্প তৈরির করতে পারে। ওসব স্ট্যাম্পের বেশিরভাগই গুদামজাত করা হতো পুরান ঢাকার সিএমএম আদালত প্রাঙ্গণসহ অন্যান্য কোর্টে। সোলায়মান মিয়া জানান, চক্রটি কৌশলে স্ট্যাম্প তৈরি করে প্রথমে ঢাকায় এবং পরে ঢাকার বাইরে বিক্রি করত। মার্কেট জমে ওঠার পর তারা ডিলার নিয়োগের মাধ্যমে তা আরও সুবিস্তৃত ও নির্ভরযোগ্য করে তোলে। শুধু রাজধানীতেই এ চক্রের রয়েছে ১৫/১৬ জনের সদস্য। ঢাকার বাইরে বিভিন্ন জেলা উপজেলায়ও তারা তাদের নেটওয়ার্ক বিস্তৃত করে। প্রতিদিনই তাদের নিজস্ব স্টলে বিক্রি করা হতো লাখ লাখ টাকার জাল স্ট্যাম্প। এ সম্পর্কে ডিবির এক উর্ধতন কর্মকর্তা জানান, জাল টাকা বাজারে ছড়িয়ে দেয়ার চেয়ে জাল স্ট্যাম্প ছড়ানো অনেক সহজ ও নিরাপদ। জাল টাকার দৌরাত্ম্য বাড়ায় মানুষের মাঝে এত বেশি সচেতনতা সৃষ্টি হয়েছে যে অনেক সময় নতুন বৈধ নোটও বারবার হাতে ঘষে তা যাচাই করে। ব্যাংকগুলোতেও সন্দেহ হলে মেশিনের পাশাপাশি ম্যানুয়ালি তীক্ষè চোখে তা যাচাই করার প্রবণতা রয়েছে। এ ছাড়া দুই ঈদ বা বিশেষ সময়ে জাল টাকার বিরুদ্ধে অভিযান চালানোর পাশাপাশি সারাবছরই পুলিশের গোয়েন্দা কার্যক্রম থাকে। কিন্তু জাল স্ট্যাম্পের বিষয়টা একটু ভিন্ন। মানুষ সাধারণত স্ট্যাম্প জাল, না নকল তা যাচাই করার মতো অতটা আগ্রহ দেখায় না। চক্রটি এই সুযোগই কাজে লাগায়। স্ট্যাম্পের ব্যবহার সাধারণত ক্রেতা-বিক্রেতার বা দুটো পক্ষের মাঝেই চুক্তিতে ব্যবহার করা হয়। একবার যদি চুক্তি সম্পন্ন হয়ে যায় তারপর আর কোন পক্ষই তা নকল না আসল খতিয়ে দেখে না। অথচ টাকার বেলায় প্রতি পদে পদে আসল-নকলের সন্দেহে যাচাই হয়। টাকা যার হাতেই নকল হিসেবে ধরা পড়ে সেই সেটা হয় ধ্বংস করে ফেলে নয়তো ব্যাংকে বা পুলিশে জমা দেয়। এতে জাল টাকা বেশি দিন স্থায়ী হতে পারে না। স্ট্যাম্পের বেলায় এমনটি ঘটে না বলেই চক্রটি অনায়াসেই তা স্থায়ী ও নিরাপদ মার্কেট গড়ে তুলতে পারে। সিনিয়র সহকারী কমিশনার সোলায়মান মিয়া এ বিষয়ে বলেন, কোটি টাকার স্ট্যাম্পসহ যাদের ধরা হয়েছে তারা দেশব্যাপী ডিলার নিয়োগের মাধ্যমে সুসংহত মার্কেট গড়ে তুলেছে। বাজার থেকে বৈধ স্ট্যাম্পের সিরিয়াল নাম্বার সংগ্রহ করে তারা তা ব্যবহার করে জাল স্ট্যাম্পে। শুধু একজনের কাছেই যদি কোটি টাকার (প্রতিটা দশ টাকা মূল্যের ) স্ট্যাম্প থাকে তাহলে সারাদেশের কি অবস্থা হতে পারে সেটা নিয়েই এখন কাজ করছে ডিবি পুলিশের বিশেষ টিম। আমরা এরই মধ্যে কয়েকজনের নাম ঠিকানা পেয়েছি যেগুলো যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। কয়েকজনকে নজরদারিতেও রাখা হয়েছে। খুব শীঘ্রই এ চক্রের অন্যরাও ধরা পড়বে। জাল টাকাার মতো স্ট্যাম্পের বিরুদ্ধেও কোর্ট কাছারি ও অন্যান্য স্থানে নজরদারি চলছে। যেখানেই তথ্য পাওয়া যাবে সেখানেই অভিযান চালানো হবে।
×