ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

মোজাফফর আহমদ

প্রকাশিত: ১১:৪৭, ২৫ আগস্ট ২০১৯

মোজাফফর আহমদ

প্রায় শতবর্ষী বৃক্ষের মতো ছিলেন তিনি। তাঁর প্রতীকী ছায়া পেয়েছে জাতি; আর অনুভূত হয়েছে এ কালে তাঁর মতো প্রাজ্ঞ, সৎ, নির্লোভ, দায়িত্বশীল একজন উঁচুমাপের রাজনীতিকের দারুণ অভাববোধ। অধ্যাপনার মাধ্যমে কর্মজীবন শুরু করলেও কালে কালে বাম রাজনীতিক মোজাফফর আহমদ হিসেবেই দেশে তাঁর একটি শ্রদ্ধাপূর্ণ আসন গড়ে উঠেছিল। তিনি ছিলেন মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকারের উপদেষ্টা, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, ভারতীয় উপমহাদেশের বাম রাজনীতির অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব। বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের অধিকারী এই গুণী বরণীয় ব্যক্তিত্ব চিরবিদায় নিলেন শুক্রবার রাতে। ছাত্র রাজনীতিতে অধ্যাপক মোজাফফরের হাতেখড়ি ১৯৩৭ সালে। মহাত্মা গান্ধী ছিলেন তাঁর প্রেরণা। কৈশোরে কুমিল্লার চান্দিনায় গান্ধীজি আসবেন শুনে বাড়ি থেকে হেঁটে যাত্রা করেন। পথেই জানতে পারেন গান্ধী এসেছিলেন। আর বলে গেছেন, ‘হিন্দু-মুসলমান এক হও, ব্রিটিশদের এ দেশ থেকে খেদাও’। গান্ধী বক্তব্য দেননি, বাণী দিয়েছেন। এটি কিশোর মোজাফফরকে প্রাণিত করে। মাওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে ১৯৫৭ সালে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি গঠিত হলে তিনি এর কেন্দ্রীয় নেতা হন। ১৯৫৮ সালে সামরিক শাসন জারি হলে সামরিক জান্তা আইয়ুবের সরকার তাঁর বিরুদ্ধে হুলিয়া জারি করে। আট বছর আত্মগোপনে থাকার পর ১৯৬৬ সালে প্রকাশ্য রাজনীতিতে ফিরে আসেন। পরের বছরই ন্যাপ বিভক্ত হলে মস্কোপন্থী অংশের পূর্ব পাকিস্তান শাখার সভাপতির দায়িত্ব নিতে হয় তাঁকে। পরবর্তীকালে বঙ্গবন্ধুর ৬ দফার পক্ষে অবস্থান নেন। সে এক ইতিহাস। মোজাফফর আহমদ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন ও স্বাধীনতা যুদ্ধে তাঁর ভূমিকা অবিস্মরণীয়। বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার যে ধারাবাহিক লড়াই-সংগ্রাম, তাতে অধ্যাপক মোজাফফর আহমদের বড় অবদান রয়েছে। যুক্তিনিষ্ঠ নিজস্ব স্বচ্ছ দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারী হতে হয় সামাজিক রাষ্ট্রিক সম্মাননা গ্রহণে অপারগতা প্রকাশের জন্যে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর মন্ত্রিত্ব নিতে অস্বীকার করা মোজাফফর আহমদ ২০১৫ সালে বাংলাদেশ সরকারের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা স্বাধীনতা পুরস্কারও গ্রহণ করেননি। তিনবছর আগে সরকার তাঁকে স্বাধীনতা পদক দিতে চেয়েছিল। তিনি সবিনয়ে তা গ্রহণে অপারগতা প্রকাশ করেন। তাঁর লিখিত বক্তব্যে যুক্তি মেলে পদক-সম্মাননা গ্রহণে তাঁর নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি। লিখেছেন, ‘পদক নিলেই সম্মানিত হয়, এই দৃষ্টিভঙ্গিতে আমি বিশ্বাসী নই। দেশপ্রেম ও মানবতাবোধে উদ্বুদ্ধ হয়ে আমি রাজনীতিতে এসেছিলাম, কোন পদক বা পদ-পদবি আমাকে উদ্বুদ্ধ করেনি। সত্যিকার অর্থে যাঁরা মুক্তিযুদ্ধ করেছিলেন, জীবন উৎসর্গ করেছিলেন তাঁরা কেউই কোন প্রাপ্তির আশা করেন না। পদ বা পদকের জন্য কখনও রাজনীতি করিনি। রাজনীতির অর্থ দেশসেবা, মানুষের সেবা।’ তাঁর এই অভিমত রাজনীতিক-বুদ্ধিজীবীদের ত্যাগী হতে প্রেরণা দেবে। প্রধানমন্ত্রী তাঁর শোক বার্তায় দেশের স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনে এই নেতার ভূমিকাকে স্মরণ করেন। উল্লেখ করেন দেশের প্রগতিশীল রাজনীতির জন্যে জাতির কাছে তাঁর চিরস্মরণীয় অবদানের বিষয়টিও। মানুষ যখন নশ্বর তখন তাঁর শারীরিক প্রয়াণ আমরা কিছুতেই এড়াতে পারি না। ব্যক্তি যত পরমনির্ভর সদাকাক্সিক্ষত স্বজন হোন না কেন, তাঁকে বিদায় জানাতেই হয়। তাঁকে অন্তিম অভিবাদন। লেনিনকে উদ্ধৃত করে কেবল তাঁর পক্ষেই যেন বলা সম্ভব ছিল: ‘আমার সমস্ত জীবন উৎসর্গ করেছি পৃথিবীর সুন্দরতম আদর্শ সমাজতন্ত্রের জন্য।’ তাঁর স্মৃতির প্রতি জানাই আমাদের গভীর ভালবাসা ও শ্রদ্ধা। শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি আমাদের আন্তরিক সমবেদনা ও সহমর্মিতা।
×