ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

রাসায়নিক বর্জ্যে দূষিত নদের পানি

অভয়নগরে ভৈরবের জায়গা দখল করে স্থাপনা নির্মাণ

প্রকাশিত: ১২:১৯, ২৫ আগস্ট ২০১৯

অভয়নগরে ভৈরবের জায়গা দখল করে স্থাপনা নির্মাণ

স্টাফ রিপোর্টার, যশোর অফিস ॥ নদের মধ্যে খানিকটা জায়গা ঘিরে বাঁশের খুঁটি পোঁতা রয়েছে। খুঁটি ঘেঁষে টিন ও নাইলনের জাল দিয়ে বেড়া দেয়া আছে। ঘিরে রাখা জায়গা ভরাট করা হয়েছে মাটি দিয়ে। আবার সেই জায়গার মাঝ বরাবর বাঁশ দিয়ে তৈরি করা হয়েছে একটি সাঁকো। ওপরে কাঠের ছাউনি। সাঁকোর সামনে নদে এসে ভিড়ছে বার্জ ও কার্গো। শ্রমিকেরা বার্জ ও কার্গো থেকে পণ্যভরতি বস্তা মাথায় নিয়ে সাঁকো বেয়ে ওপরে উঠে আসছেন। এর মাত্র আধা কিলোমিটার দূরে নদের জায়গা দখল করে নির্মাণ করা হচ্ছে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। চারটি ঘরের নির্মাণকাজ প্রায় শেষের পথে। ঘরের ওপরের ছাউনি এখনও বাকি। এভাবে প্রতিনিয়ত অভয়নগরের নওয়াপাড়া বাজারের পাশে ভৈরব নদের জায়গা দখল করে নির্মাণ করা হচ্ছে বিভিন্ন স্থাপনা। থেমে নেই দূষণ। বিভিন্ন কারখানার অপরিশোধিত রাসায়নিক বর্জ্য নদের পানি দূষিত করছে। দখল-দূষণে বদলে যাচ্ছে ভৈরবের আসল রূপ। যশোরের অভয়নগর উপজেলার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে ভৈরব নদ। উপজেলার রাজঘাট থেকে চেঙ্গুটিয়া নদের অংশে আগে থেকেই দখল করে নির্মাণ করা হয়েছে বিভিন্ন স্থাপনা। নতুন করে আবার শুরু হয়েছে নদের জায়গা দখল। সঙ্গে ভয়াবহ দূষণ। নদ-নদী, খাল-বিল ও জলাশয় জলাধারের দখল এবং দূষণ প্রতিরোধ রয়েছে উপজেলা নদী রক্ষা কমিটি। গত আড়াই বছরে অভয়নগর উপজেলা নদী রক্ষা কমিটির কোন সভা অনুষ্ঠিত হয়নি। ফলে ভৈরব নদের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ এবং ভৈরব নদের দূষণ রোধে কোন কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না। গত ৫ ফেব্রুয়ারি জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান হাওলাদার যশোরের জেলা প্রশাসককে একটি চিঠি দেন। চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, উচ্চ আদালত গত ৩১ জানুয়ারি ২০১৯ ও ৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ নদ-নদীর দখল, দূষণ, ভরাট, সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা বিষয়ে একটি ঐতিহাসিক রায় ঘোষণা করেছেন। উক্ত রায়ে নদ-নদী, খাল-বিল ও জলাশয় জলাধারের দখল ও দূষণ প্রতিরোধ এবং জনসচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে কয়েকটি সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা প্রদান করেছেন। রায়ে আদালত প্রতিটি জেলা, বিভাগ, পৌরসভা, সিটি কর্পোরেশনের অধিক্ষেত্রনাধীন নদ-নদী, খাল-বিল ও জলাশয় জলাধারের অবৈধ দখলদারদের তালিকা প্রণয়নপূর্বক আগামী ৩০ দিনের মধ্যে জনসমক্ষে প্রকাশের নির্দেশ প্রদান করেছেন। একই সঙ্গে আদালত নদ-নদী, খাল-বিল ও জলাশয় জলাধারের অবৈধ দখল এবং দূষণকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করার আদেশ জারি করেছেন। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার মুরটি গ্রামে পদ্মার শাখা জলঙ্গি থেকে বেরিয়ে ভৈরব মেহেরপুর সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। এরপর চুয়াডাঙ্গা জেলার দর্শনা, ঝিনাইদহ জেলার কোর্ট চাঁদপুর এবং যশোর জেলার তাহিরপুর ও আফ্রা হয়ে ভৈরব খুলনার পশুর নদীতে গিয়ে মিশেছে। তাহিরপুর থেকে খুলনার পশুর-ভৈরবের মিলনস্থল পর্যন্ত মোট দৈর্ঘ্য ১৩৩ কিলোমিটার। এর মধ্যে পশুর-ভৈরবের সঙ্গমস্থল থেকে যশোরের আফ্রা পর্যন্ত ভৈরবের ৩৭ কিলোমিটার প্রবাহমান। এর মধ্যে অভয়নগর অংশে রয়েছে প্রায় ২৫ কিলোমিটার। আফ্রা থেকে বসুন্দিয়া বাজার পর্যন্ত চার কিলোমিটার ক্ষীণধারায় প্রবাহমান। বসুন্দিয়া থেকে চৌগাছা উপজেলার তাহিরপুরের কপোতাক্ষের উৎসমুখ পর্যন্ত ৯২ কিলোমিটার প্রবাহহীন। ভৈরবের যে অংশটুকু বেঁচে আছে দূষণের কবলে পড়ে তারও প্রাণ যায় যায় অবস্থা। সরেজমিনে দেখা গেছে, ভৈরব নদের সবচেয়ে বেশি জায়গা দখল করা হয়েছে যশোরের অভয়নগর উপজেলার ভাটপাড়া থেকে চেঙ্গুটিয়া পর্যন্ত। নদের জায়গায় নির্মাণ করা হচ্ছে অনেক গুদাম, দোকান ও আবাসিক স্থাপনা। নদ-সংলগ্ন কারখানা ও বিদ্যুত কেন্দ্রগুলো তাদের স্থাপনা সম্প্রসারণ করেছে। নদে অবস্থানরত বার্জ ও কার্গোতে পণ্য ওঠানো-নামানোর জন্য নদের মধ্যে বালু, ইট ও পাথর ফেলে পাকা ঘাট তৈরি করা হয়েছে। কারখানার রাসায়নিক বর্জ্য সরাসরি পড়ছে ভৈরব নদে। এ ছাড়া, নদে চলাচলকারী নৌযানের পোড়া তেল, মানুষের পয়ঃবর্জ্য ও গৃহস্থালির বর্জ্যও পড়ছে এ নদে। এতে নদের পানি দূষিত হচ্ছে। নদের সবচেয়ে বেশি দূষণ ঘটাচ্ছে দুটি ট্যানারি- এসএএফ ইন্ডাস্ট্রিজ ও সুপারেক্স লেদার লিমিটেড। এ ছাড়া, মজুমদার ব্রান অয়েল মিল, মজুমদার অটো রাইস মিল এবং মজুমদার এ্যাগ্রো ফুড লিমিটেড ভৈরবের দূষণ ঘটাচ্ছে। বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) হিসাব অনুযায়ী যশোরের অভয়নগর উপজেলায় ভৈরব নদের তীরে অবৈধ স্থাপনা ছিল ৮৬টি। এর মধ্যে যশোর জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে এবং বিআইডব্লিউটিএ’র সহযোগিতায় ২০১৬ সালের অক্টোবর মাসে দুই ধাপে ৫৯টি অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়েছিল। অবশিষ্ট ২৭টি স্থাপনা পর্যায়ক্রমে উচ্ছেদ করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। কিন্তু এর পর থেকে উচ্ছেদ অভিযান কার্যত বন্ধ হয়ে গেছে। উচ্ছেদ অভিযান বন্ধ থাকায় নদের জায়গা দখল করে অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ বাড়ছে। উপজেলা নদী রক্ষা কমিটি সূত্র জানায়, ২০১৭ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি অভয়নগর উপজেলা পরিষদ মিলনায়তনে উপজেলা নদী রক্ষা কমিটির সভায় ভৈরব তীরের অবশিষ্ট স্থাপনা উচ্ছেদ করতে বিআইডব্লিউটিএ’কে অনুরোধ করা হয়। প্রতি মাসে উপজেলা নদী রক্ষা কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। কিন্তু এরপর থেকে উপজেলা নদী রক্ষা কমিটির আর কোন সভা হয়নি। উচ্ছেদও করা হয়নি ভৈরব নদের তীরের অবৈধ স্থাপনা। কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি ভৈরব নদের দূষণ রোধে। নওয়াপাড়া নৌবন্দর কর্তৃপক্ষের সহকারী পরিচালক মাসুদ পারভেজ জানান, নদীর জায়গা দখলকারীদের তালিকা প্রস্তুত করা হয়েছে।
×