ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

যেভাবে জগলুকে হত্যা করে তার স্ত্রী ও দুই প্রেমিক

প্রকাশিত: ০১:২৭, ২ সেপ্টেম্বর ২০১৯

যেভাবে জগলুকে হত্যা করে তার স্ত্রী ও দুই প্রেমিক

স্টাফ রিপোর্টার, যশোর অফিস ॥ ঝিনাইদহের এলজিইডি’র গাড়িচালক হাসানুজ্জামান জগলুকে পূর্বপরিকল্পিতভাবে হত্যা করে স্ত্রী তাহমিনা পারভীন তমা ও তার দুই প্রেমিক বন্ধুরা। দীর্ঘদিন জগলু থেকে আলাদা থাকা এবং জগলুর কাছ থেকে নেয়া টাকা ফেরত চাওয়ায় বিরক্ত হতেন স্ত্রী তহমিনা। এ কারণে নতুন বন্ধুদের সাথে নিয়ে তাহমিনা ঢাকা থেকে প্রথমে যশোরে এরপর ঝিনাইদহে গিয়ে তাকে উঠিয়ে নিয়ে গাড়ির মধ্যে ফাঁস দিয়ে হত্যা করেন। হত্যার আগে চেতনানাশক দিয়ে অচেতন করা হয় জগলুকে। নিহতের স্ত্রী তাহমিনা পারভীন তমা সোমবার যশোরের সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট গৌতম মল্লিকের আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দীতে হত্যার কথা স্বীকার করেছেন। যশোর পিবিআইএর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার কেএমএইচ জাহাঙ্গীর হোসেন জানিয়েছেন, জগলু হত্যা মামলাটি পিবিআই হাতে পাওয়ার পর পর্যালোচনা করে। এরপর নিহতের স্ত্রী তাহমিনা পারভীন তমা এবং ছেলেকে হেফাজতে নিয়ে নানাভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। পিবিআইএর কাছে তাহমিনা হত্যার পরিকল্পনা এবং কিভাবে হত্যা করা হয়েছে তা স্বীকার করেন। কুষ্টিয়ার স্কুলপাড়ার জুগিয়া গ্রামের হাসানুজ্জামান জগলুর সাথে তাহমিনা পারভীন তমার বিয়ে হয় ১৯৯৯ সালে। জগলু ঝিনাইদহের এলজিইডি অফিসের গাড়িচালক ছিলেন। স্ত্রী তমা, এক ছেলে ও এক মেয়েকে নিয়ে জগলু কুষ্টিয়া শহরে থাকতেন। ২০০৮ সালে জগলু সাসপেন্ড হওয়ার পর তাদের সংসারে অর্থিক সংকট দেখা দেয়। এ কারণে উভয়ের মধ্যে বাকবিতন্ডা লেগেই থাকতো। এতে দাম্পত্য জীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। তমা তার ছেলেকে নিয়ে ঢাকায় চলে যান এবং মিরপুর-১৩ নম্বর এলাকার একটি বাড়ি ভাড়া করে থাকতেন। ছেলেকে আদমজী ক্যান্টনমেন্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজে ভর্তি করান। আর মেয়ে থাকতো কুষ্টিয়ায়। ঢাকা থাকাকালীন তমার সাথে মুরসালিন ও আল-আমিন নামে দুই যুবকের বন্ধুত্ব হয়। এ বিষয়টি ভালোভাবে নিতে পারেননি জগলু। তমার সাথে প্রায় সময় এ নিয়ে তর্ক হতো। সন্দেহ তৈরি হয় তার মনে। গালিগালাজও করতেন মোবাইল ফোনে। তমা ঢাকার কেরানীগঞ্জের একটি বাড়িতে মুরসালিনের স্ত্রী সেজে এবং আল-আমিন দেবর সেজে থাকতেন। কুরবানির ঈদে তমা কুষ্টিয়ায় যান কিন্তু জগলুর সাথে দেখা হয়নি। মোবাইল ফোনে গালিগালাজ করে জগলু। বন্ধুদের পেছনে তমা অনেক টাকা পয়সা খরচ করে ফেলেন। জগলু টাকা চাইলে দিতে না পারায় গালিগালাজ করতেন। গত ২৬ আগস্ট তমা মিরপুরে তার ছেলের বাড়িতে যান। সে সময় জগলু তাকে ফোন দেন এবং অকথ্যভাষায় গালিগালাজ করেন। তমা বাড়ির সামনে এসে মুরসালিন এবং আল-আমিনকে ফোন দেন। তারা আসলে তমা বলেন, ‘জগলু আমার জীবনটাকে অতিষ্ট করে তুলেছে। তোমরা কিছু একটা করো।’ তখনই তিনজন জগলুকে হত্যার পরিকল্পনা করে। তমা জানান, জগলু টাকা চেয়েছিল। টাকার কথা বললে সে আসবে। সে সময় পরিকল্পনা হয়, একটি গাড়ি নিতে হবে। গাড়ির মধ্যে অচেতন করে হত্যা করতে হবে। তা না হলে ধস্তাধস্তি হবে। মুরসালিন এবং আল-আমিন উবার থেকে একটি গাড়ি ভাড়া করেন। গাড়ি চালকটি তাদের পরিচিত। চালকের বাড়ি খুলনার ডুমুরিয়ায়। ২৭ আগস্ট বেলা ১২টার দিকে তারা তিনজন একটি কাঁচের বোতলে চেতনানাশক ও রশি নিয়ে যশোরে পৌঁছে হোটেল জাবির ইন্টারন্যাশনালে উঠেন। হোটেলে পরিচিত একজনের সাথে তাদের দেখা হয়। পূর্বপরিচিতের বাড়িতে গিয়ে বিশ্রাম নেন তারা। মণিরামপুর কেশবপুরে বেড়াতে বের হন। সে সময় জগলু ফোন দেন তমাকে। তমা জানায়, কিছু কসমেটিকস ও কাপড় কেনার জন্য যশোরে এসেছেন। সে সময় জগলু তার কাছে ৫০ হাজার টাকা চান। ২০ হাজার টাকা দিতে পারবে বলে তমা জানায় এবং ঝিনাইদহের শামীমা ক্লিনিকের সামনে যেতে বলেন। রাত ১০টার দিকে তারা উবারের গাড়ি নিয়ে শামীমা ক্লিনিকের সামনে যান। সেখান থেকে জগলুকে গাড়িতে তুলে নেয়া হয়। জগলু পিছনের ছিটের মাঝে, তাহমিনা তার ডানপাশে, আল আমিন বাম পাশে এবং মুরসালিন গাড়ির সামনে ছিটে বসেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী তাহমিনা ও আল-আমিন দুই পা চেপে ধরেন জগলুর। সে সময় মুরসালিন চেতনানাশক একটি তুলার মধ্যে ভিজিয়ে নাকে চেপে ধরলে জগলু অচেতন হয়ে পড়েন। তখন গাড়ির মধ্যেই রশি দিয়ে গলায় ফাঁস লাগিয়ে হত্যা করা হয় জগলুকে। প্রায় ৪০ মিনিট ধরে চালক যশোরের দিকে গাড়ি চালিয়ে আসতে থাকেন। পরে একটি ফাঁকা জায়গায় গাড়ি থেকে ফেলে দেয়। মুরসালিন ও আল-আমিন গাড়ি থেকে নেমে গলায় ছুরি চালিয়ে জবাই করে মৃত্যু নিশ্চিত করে। এরপর তারা ওই গাড়িতে করে প্রথমে মানিকগঞ্জ মুরসালিনের খালার বাসায় উঠেন তারা। মুরসালিন, আল-আমিন ও গাড়িচালক রক্তমাখা গাড়িটি পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলেন। আর তমা নিজের পোশাক পাল্টে অন্য পোশাক পড়ে ঢাকায় চলে যান। অতিরিক্ত পুলিশ সুপার এমকেএইচ জাহাঙ্গীর হোসেন জানিয়েছেন, জিজ্ঞাসাবাদের জন্য গত ৩১ আগস্ট তমাকে যশোর পিবিআই এর অফিসে ডাকা হয়। সেখানে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করলে তিনি ঘটনার কথা স্বীকার করেন। তাকে আটক করে সোমবার আদালতে পাঠানো হয়। আদালতে তিনি স্বামী হত্যার বর্ণনা দিয়েছেন। বাকি তিনজন মুরসালিন ও আল আমিন এবং উবারের চালককে আটকের জন্য অভিযান চালানো হচ্ছে।
×