ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বঙ্গবন্ধু হত্যার দায়মুক্তি দিল কে?

প্রকাশিত: ১১:৩৭, ৮ সেপ্টেম্বর ২০১৯

বঙ্গবন্ধু হত্যার দায়মুক্তি দিল কে?

॥ প্রথম পর্ব ॥ অবসরপ্রাপ্ত এক বয়োজ্যেষ্ঠ মার্কিন কূটনীতিক চার্লস স্টুয়ার্ট কেনেডি যিনি এখন ভার্জিনিয়ায় এ্যাসোসিয়েশন ফর ডিপ্লোমেটিক স্টাডিজ এ্যান্ড ট্রেনিংয়ের ফরেন এ্যাফায়ার্স ওরাল হিস্ট্রি প্রকল্পের পরিচালক; তিনি ১৯৮৯ সালের ২০ অক্টোবর ৭৪-৭৬ সালে বাংলাদেশে কর্মরত মার্কিন রাষ্ট্রদূত ডেভিস ইউজেন বোস্টারের একটি সাক্ষাতকার নেন। সাক্ষাতকারের সূত্র ধরে আজকের এই রচনা যেখানে রাষ্ট্রদূত বোস্টার বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে উল্লেখ করেছেন, ‘তিনি ছিলেন খুবই এক ক্যারিশম্যাটিক ব্যক্তিত্ব, দুর্দান্ত মানুষ। আপনি কেবল এই ব্যক্তির দিকে তাকিয়ে তাৎক্ষণিকভাবেই তাঁকে পছন্দ করবেন’। বঙ্গবন্ধুর জীবনযাপন সম্পর্কেও বোস্টার উল্লেখ করেন তাঁর সব প্রশংসনীয় মত, ‘যে বাড়িতে তিনি থাকতেন সেটি ছিল খুব বিনয়ী একটি বাড়ি, কোন একটি দেশের রাষ্ট্রপতির বসবাসের জন্য যথাযথ নয়। কিন্তু তিনি দেশের পিতার মতো ব্যক্তিত্ব ছিলেন। ছিলেন অনেকটা জর্জ ওয়াশিংটনের মতো যিনি তাঁর দেশকে স্বাধীনতার দিকে নিয়ে গেছেন। তবে রাষ্ট্র পরিচালনার দক্ষতা তাঁর তেমন ছিল না’! বোস্টারের মতে, ‘শেখ মুজিবের চেয়ে জিয়া প্রশাসক হিসেবে দক্ষ বলে তাঁর কাছে মনে হয়েছে ও সেরকম কাউকেই তখন দরকার ছিল’ (Someone with more managerial talent was required. They had that talent in Zia who eventually succeeded him)! এই যে ‘মুখে এক মনে আর এক’ চরিত্রের তৎকালীন মার্কিন কূটনীতি, বোস্টার হলেন তার এক নিকৃষ্টতম উদাহরণ। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তাঁর শেষ সাক্ষাতে (৫ আগস্ট ১৯৭৫) তাঁরা দুজনই দেশ পরিচালনা, বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য দেশের সম্পর্ক, বঙ্গবন্ধুর ভাবনা ও দর্শন, রাষ্ট্রচিন্তা সবই আলোচনা হয়েছিল এবং পরদিন রাষ্ট্রদূত বোস্টার যে তারবার্তায় এই সাক্ষাতের প্রতিবেদন ওয়াশিংটনে পাঠান সেখানে তিনি বঙ্গবন্ধুর এরকম প্রশংসা করে বিস্তর স্তুতিবাক্য লিখেছিলেন। কিন্তু তিনি প্রতিবেদনের ভাষা বিন্যাসে এই কথাও লিখতে ভুলেননি যে, বঙ্গবন্ধু তাঁকে তাঁর রাষ্ট্রচিন্তার যে দর্শন ব্যাখ্যা করেছিলেন তাতে মার্কিন সরকারের বিচলিত হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে, ‘আমি মার্ক্সিস্ট নই। আমি একজন সমাজতান্ত্রিক; কিন্তু সেটা আমার নিজস্ব পথে। আমি সব দেশের বন্ধু হতে চাই; কিন্তু তার মানে এই নয় যে- কোন দেশ ভাবুক আমাকে কী করতে হবে সেটা সে বলে দেবে’ (I am not a Marxist. I am a Socialist, but a Socialist in my own way. I want to be friends with all countries but I don’t want any country to think it can tell me what to do)। এই প্রতিবেদনের শেষে সারমর্মে বোস্টার লিখেন, ’His repetiation of the theme that he is not a Masrxist, his insistance thay no other power can tell him what to do, and his volunteered criticism of communist China’s farm system all seem intended to ease our minds about the political direction he is taking’। বোস্টার স্বর্গরাজ্যে বাস করতেন, তাই তাঁর অভিজ্ঞ কর্মজীবনের অন্যান্য সাফল্য-ব্যর্থতার সঙ্গে গুলিয়ে বঙ্গবন্ধুকে সম্পর্কে ভেবেছিলেন বড় দেশগুলোর মন জয় করতেই বুঝি তিনি এমন করে কথা বলেছেন। সেটা যে মোটেও নয়, বোস্টার তা জানতেন কিন্তু কূটনীতির ‘হিপোক্রেসির’ আড়ালে থেকে তিনি নিজেদের জন্য উপযোগী কথা সাজিয়ে নিয়েছিলেন ও লিখেছিলেন। যদি তাই-ই হতো বঙ্গবন্ধুকে মেরে ফেলার চক্রান্তে তাদের সায় থাকত? আর না থাকলে জিয়াকে কেন ভাল প্রশাসক মনে হয়েছিল তাঁর? জিয়া কি বঙ্গবন্ধুর সমকক্ষ ছিলেন? এখন যদি আমরা প্রশ্ন করি, বোস্টার কবে থেকে জিয়াকে চিনতেন বা জানতেন? এমন কোন রাজনৈতিক দর্শন জিয়ার ছিল যা বাস্তবায়নে দক্ষতা দেখে বোস্টারের মনে হয়েছিল জিয়া বঙ্গবন্ধুর চেয়ে দক্ষ প্রশাসক? এসবই ছিল কুচক্রীদের আগে থেকে ঠিক করা, ঠিক বঙ্গবন্ধু হত্যার আগের ও পরের তারবার্তা মিলিয়ে দেখলেও পাওয়া যায় মার্কিননীতির মধ্যে বঙ্গবন্ধুবিরোধী নীতির প্রভাব কতটা প্রবল ছিল, যা ১৯৭১ সালে কিসিঞ্জারের নীতির পরাজয়ের প্রতিশোধ নেয়ার বাসনাকে তীব্র করেছিল। আর সে বাসনা চরিতার্থ করতে যুদ্ধকালীন সময় থেকেই মার্কিন ফাঁদে পা দিয়েছিল বাংলাদেশ ও বঙ্গবন্ধুবিরোধী একদল অভিশপ্ত মানুষ। পরের তথ্য অনুসন্ধানের বিশ্লেষণের আগে আমাদের জানা দরকার এই রাষ্ট্রদূত বোস্টার কে ছিলেন ও কী তাঁর পেশাগত তৎপরতা ছিল। ডেভিড ইউজেন বোস্টারের জন্ম যুক্তরাষ্ট্রের ওহায়ো অঙ্গরাজ্যে ১৯২০ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর। প্রথম জীবনে হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির ট্রেনিং সেন্টারের শিক্ষা অফিসার হিসেবে তিনি কাজ করতেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মার্কিন নৌবাহিনীতে যোগ দেন। যুদ্ধের শেষে সিআইএ, পররাষ্ট্র দফতর ও নৌবাহিনীতে বেসামরিক চাকরির জন্য আবেদন করেন ও তিনটি চাকরির জন্যই নির্বাচিত হন। যদিও তিনি পররাষ্ট্র দফতরের কাজই বেছে নেন এবং প্রথম পোস্টিং পান ১৯৪৭ সালে মস্কোতে পলিটিক্যাল অফিসার হিসেবে। কালে কালে তিনি সদর দফতর হয়ে সমাজতান্ত্রিক বলয়ের পূর্ব জার্মানিতে কাজ করেন। ১৯৫৮ সালে ওয়াশিংটনে ফিরিয়ে এনে তাঁকে তখনকার স্টেট ডিপার্টমেন্টের সেক্রেটারি (পররাষ্ট্রমন্ত্রী) জন ফস্টার ডালাসের বিশেষ সহকারী হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। প্রেসিডেন্ট জেনারেল আইজেনহওয়ারের সে আমল ছিল সোভিয়েত বিরোধী স্নায়ুযুদ্ধের তুমুল বিতর্কের সময় যার অন্যতম সহযোগী ছিলেন এই বোস্টার। পরবর্তীকালে তিনি মেক্সিকো ও ল্যাটিন আমেরিকার একজন রাজনৈতিক বিশ্লেষক হিসেবে নাম করেছিলেন এবং সমজাতান্ত্রিক বিশ্বের উত্থান ঠেকাতে মার্কিন নীতির কট্টর অফিসার ছিলেন। ভিয়েতনাম যুদ্ধের আনুপূর্বক বিশ্লেষণে বোস্টার সদর দফতরকে প্রভাবিত করতে পেরেছিলেন। পরে তিনি নেপাল ও পোলান্ডে কর্মরত ছিলেন। নেপাল ছাড়া তাঁর অন্য সব নিয়োগে সদর দফতরের আকাক্সক্ষাই কাজ করেছে বেশি। ১৯৭৪ সালে তাঁকে জেনেভায় নিয়োগ দেয়া হলেও বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত করা হচ্ছে এমন একটি কথা ছড়িয়ে পড়ে। জানুয়ারি মাসে বোস্টার ওয়াশিংটনে তাঁর এক সহকর্মী ল্যারি ইগলবার্গারের সঙ্গে আলাপ করেন যিনি কিসিঞ্জারের খুব কাছের লোক ছিলেন। তিনি তাঁকে নিশ্চিত করেন যে, তিনি বাংলাদেশে রাষ্ট্রদূত হিসেবে যাচ্ছেন। সে নিয়োগের কথা শুনে বোস্টার একজন কর্মকর্তার কাছে নাকালস্বরে জানতে চান, সেখানে আর কোন বিশেষ কাজ তাঁর রয়েছে কী না (I swallowed hard, grumbled and asked whether there was a’ other assignment)। আমাদের অনুসন্ধান করতে হবে এই কথা দিয়ে বোস্টার সেদিন কী বুঝাতে চেয়েছিলেন? আর কী উত্তর তিনি ওই কর্মকর্তার কাছ থেকে পেয়েছিলেন। প্রশ্ন হলো, পূর্ব ইউরোপ ও তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন, সমাজতান্ত্রিক বলয়ের এমন একজন তুখোড় ও অভিজ্ঞ কূটনীতিককে কিসিঞ্জার কেন বাংলাদেশের জন্য নির্বাচিত করলেন? সেটা সহজেই অনুমেয়, বঙ্গবন্ধুর প্রদর্শিত ও প্রবর্তিত কৃষক-শ্রমিক উন্নয়নের যে বাংলাদেশ তখন গঠিত হতে যাচ্ছিল তা থামাতে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত তাদের নিতেই হবে। এরকম একজন অভিজ্ঞ বা ঝানু কূটনীতিক ছাড়া যে এই দেশে তা সম্ভব নয় সেটা খোদ কিসিঞ্জারও হয়তো উপলব্ধি করেছিলেন। বোস্টারের ১৬ আগস্ট ১৯৭৫ সালের প্রতিবেদনেই দেখা যাচ্ছে, তার বিবরণ- ‘গত ২৪ ঘণ্টার পরিস্থিতি দেখে এটা স্পষ্ট যে, পুলিশ, প্যারা মিলিটারি বাংলাদেশ রাইফেল ও রক্ষী বাহিনী সবাই এই ঘটনা মেনে নিয়েছে। সাধারণ মানুষ কোন উল্লাস প্রকাশ না করলেও বুঝা যাচ্ছে তাঁরা সব মেনে নিয়েছে ও স্বস্তিবোধ করছে’। একই প্রতিবেদনে তিনি জানিয়েছেন, ‘হত্যাকা- সংঘটনের সময় মুজিবের ভাগ্নে শেখ মণির বিরুদ্ধে সিদ্ধান্ত নিতেও পরিকল্পনাকারীরা সময় নিতে চায়নি’। তাঁর মানে কি এই নয় যেÑ এসব খুঁটিনাটি সিদ্ধান্তের কথা বোস্টার জানতেন? না হলে সংঘটিত পরিস্থিতিতে হত্যাকারী বা পরিকল্পনাকারীদের মনের ভাবনা ও যুক্তি কি ছিল ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তিনিই বা জানলেন কেমন করে! হত্যাকারীরা তখনও এমন কোন ঘোষণা দেয়নি যে, তাঁরা কেন বঙ্গবন্ধুর পরিবার-পরিজন ও আত্মীয়-স্বজনদের ও ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক সহকর্মীদের হত্যা করেছিল ও কী তাদের উদ্দেশ্য ছিল। মোশতাকের প্রতি আনুগত্য দেখিয়ে তাঁরা বঙ্গবন্ধুর হত্যার কথাই ঘোষণা করছিল যদিও সারা বিশ্বের বিবেকবান মানুষদের না বুঝার কারণ ছিল না যেÑ বঙ্গবন্ধুর দর্শনের হত্যা করতে তাঁর সহযোগীদেরও হত্যা করা হয়েছে। হত্যাকা-ের পৈশাচিকতা থেকে এও প্রমাণিত যে, এ ঘটনার পেছনে ছিল দীর্ঘদিনের পরিকল্পনা ও প্রতিশোধস্পৃহা। সে প্রতিশোধস্পৃহা ছিল একাধারে রাজনৈতিক-ভৌগোলিক স্বাধীনতা অর্জনকারী দেশ বাংলাদেশের বিরুদ্ধে, তাঁর দিক-নির্দেশক নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে ও সমৃদ্ধ সোনার বাংলা গঠনের সব রকম উদ্যোগের বিরুদ্ধে। ৫ আগস্ট বোস্টারের সঙ্গে শেষ সাক্ষাতে বঙ্গবন্ধু তাঁর উন্নয়ন দর্শনের ব্যাখ্যা করতে যেয়ে যে সমবায় আয়োজনের কথা বলেছিলেন তাতে আমরা অনুমান করতে পারি, বোস্টারের ভ্রƒকুঞ্চিত হয়েছিল। না হলে এই আলোচনার এত বিস্তারিত ওয়াশিংটনে পাঠানো প্রতিবেদনে উল্লেখ থাকত না। কারণ, ওই সময়টা যে মুখ্য বোস্টারকে নিশ্চয়ই তা প্রমাণ করার দরকার হয়ে পড়েছিল। এমনকি বঙ্গবন্ধু যে চীনের পরিবার ভেঙ্গে দেয়া কৃষি সমবায়ী পদ্ধতি বাংলাদেশের জন্য উপযুক্ত হবে না আর চীনাদের তিনি তা ১৯৫৭ সালেই জানিয়ে দিয়েছিলেন, সে ব্যাখ্যা শুনে নিশ্চয়ই বোস্টার বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক চিন্তা কতটা পরিপক্ব এটা ভেবে সে আলোচনার বিস্তারিত উল্লেখ করতে কোন ভুল করেননি। লেখক : পরিচালক, আমাদের গ্রাম গবেষণা প্রকল্প [email protected]
×