ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

আদালতে টাইম বোমা বিস্ফোরণ

প্রকাশিত: ১১:৩৮, ৮ সেপ্টেম্বর ২০১৯

আদালতে টাইম বোমা বিস্ফোরণ

১৯৭১ সালের ৮ সেপ্টেম্বর দিনটি ছিল বুধবার। চট্টগ্রাম আদালত ভবনের দোতলার মুক্তিবাহিনীর গেরিলাদের পেতে রাখা একটি টাইম বোমার বিস্ফোরণ ঘটলে ২ ব্যক্তি নিহত ও ১৭ জন গুরুতর আহত হয়। এদের মধ্যে ৩ জনের অবস্থা মরণাপন্ন। একটি বিদেশী সংস্থা জানিয়েছে যে, গেরিলারা উক্ত টাইম বোমা একটি ছাতার ভেতর লুকিয়ে রাখে। দুই-তিন দিন বিরতির পর পাকসেনারা এই দিন কুমিল্লায় মুক্তিবাহিনীর সেনেরহাট অবস্থানের দিকে অগ্রসর হবার চেষ্টা করে। সেনেরহাট অবস্থানটি দখল করে নেবার জন্য পাকসেনারা সেনেরহাট পশ্চিমে এবং শালদা নদী স্টেশনের পশ্চিমে বিপুল সংখ্যক সৈন্যের সমাবেশ ঘটায়। তারা দুদিক থেকে আক্রমণের প্রস্তুতি নেয়। পাকসেনাদের সৈন্য সমাবেশের কৌশল দেখে মুক্তিফৌজ কমান্ডার বুঝতে পারেন যে, পাকসেনারা মন্দভাগের পশ্চিমে আশাবাড়ি পর্যন্ত মুক্তিফৌজের দখলকৃত সব এলাকা পুনরুদ্ধারের পরিকল্পনা নিয়েছে। এতে তাদের পক্ষে কসবা এবং মন্দভাগ পুনর্দখল করা সহজ হবে। পাকসেনাদের পরিকল্পনা বুঝতে পেরে মুক্তিফৌজ সেনেরহাট অবস্থানকে আরও শক্তিশালী করে তুলেন। সকালে পাকসেনারা তাদের নয় ঘরে অবস্থিত ১২০ এম এম মর্টার, ব্রাহ্মণপাড়ায় অবস্থিত কামান এবং শশীদলে অবস্থিত ৩ ইঞ্চি মর্টারের সাহায্যে মুক্তিফৌজের সেনেরহাট অবস্থানের ওপর প্রচ- গোলাবর্ষণ শুরু করে-সঙ্গে সঙ্গে পাকসেনারা সেনেরহাট অবস্থানের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। পাকসেনাদের কামানের গোলায় মুক্তিফৌজের বেশকিছু লোক শহীদ ও আহত হয়। পাকসেনাদের রকেট লাঞ্চারের গোলায় মুক্তিফৌজের ৪টি বাঙ্কার ধ্বংস হয়ে যায়। পাকসেনারা মুক্তিফৌজের অবস্থানের দেড়শ’ গজ পর্যন্ত অগ্রসর হতে সক্ষম হয়। কিন্তু এতদসত্ত্বেও মুক্তিফৌজের সৈনিকরা এতটুকু মনোবল না হারিয়ে বরং দৃঢ়তার সঙ্গে পাকসেনাদের আক্রমণকে প্রতিহত করেন। মুক্তিফৌজ সৈনিকদের গুলিতে অগ্রসরমান অসংখ্য পাকসেনা হতাহত হয়। মুক্তিফৌজের মুজিব ব্যাটারী গোলন্দাজ বাহিনী পাকসেনাদের ওপর গোলাবর্ষণ করে অনেক পাকসৈন্যকে হতাহত করে। পাকসেনারা পুরোদিন তাদের আক্রমণ চালিয়ে মুক্তিফৌজের প্রতিরোধ ব্যুহ ভেদ করতে না পেরে এবং তাদের অনেক হতাহত হওয়াতে সন্ধ্যায় আক্রমণ বন্ধ করে পিছু হটতে বাধ্য হয়। মুক্তিবাহিনীর কয়েকজন বীরযোদ্ধা শহীদ ও আহত হয়। যশোর সদর থানায় মুক্তিবাহিনীর তিন দল যোদ্ধা পাকবাহিনীর বারিনগর ঘাঁটি আক্রমণ করে। এই আক্রমণে ৩১ জন রাজাকার নিহত ও ৩৫ জন রাজাকার আহত হয়। কোন ক্ষয়ক্ষতি ছাড়াই মুক্তিযোদ্ধা দল নিরাপদে ঘাঁটিতে ফিরে আসে। সিলেটে পাকহানাদার বাহিনী মুক্তিবাহিনীর বগাগ্রাম অবস্থানের ওপর মর্টারের সাহায্যে অতর্কিত হামলা চালায়। এতে মুক্তিবাহিনীর ৬ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা আহত হয়। সুনামগঞ্জে পাকহানাদার বাহিনী স্থানীয় রাজাকার বাহিনীসহ রাণীগঞ্জ বাজার এলাকায় প্রবেশ করে এবং রাণীগঞ্জে শ্রীরামসির মতো পাইকারি হত্যাযজ্ঞ চালায়। এতে ৩০ জন নিরীহ মানুষ শহীদ হন। শুধু তাই নয় পাক বর্বররা রাণীগঞ্জ বাজারের প্রায় দেড়শ’ দোকান আগুন জ্বালিয়ে ভস্মীভূত করে। বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স হেডকোয়ার্টারের গণসংযোগ বিভাগ থেকে প্রকাশিত ‘যুদ্ধ বিষয়ক বুলেটিন’-এ বলা হয়: বিভিন্ন সেক্টরের যুদ্ধসমূহে মুক্তিবাহিনী আজ ১১৯ জন শত্রুসৈন্যকে হত্যা করেছে। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগদানের জন্য পাক প্রতিনিধি দলের নাম ঘোষণা করা হয়। দলের সদস্যরা হচ্ছেন : পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টির ভাইস প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আলী,শাহ আজিজুর রহমান, জুলমত আলী খান, বিচারপতি জাকির উদ্দিন, ব্যারিস্টার কামাল ফারুকী, ড. বেগম এনায়েতউল্লাহ, মিসেস রাজিয়া ফয়েজ, ড. ফাতেমা সাদিক, এ্যাডভোকেট এ.টি. সাদী, এ্যাডভোকেট কে.বাবর প্রমুখ। মুজিবনগর থেকে প্রকাশিত ইংরেজী সাপ্তাহিক ‘বাংলাদেশ’-এর ‘পাগলা কুকুর হইতে সাবধান’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়: জেনারেল ইয়াহিয়া খান তার ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছেন। পাকিস্তানী সৈন্যরা বিচ্ছিন্নভাবে যুদ্ধ করলেও তারা তাদের পরিকল্পনামতো এগুতে পারেনি। এই দিন নয়াদিল্লীর বাংলাদেশ মিশনের প্রধান জনাব কে.এম.সাহাবুদ্দিন দাবি করেন যে ‘বাংলাদেশের প্রায় পুরো এলাকা আমাদের নিয়ন্ত্রণে।’ প্রেস ক্লাবে মধ্যাহ্ন ভোজের আয়োজনের একটি সভায় তিনি বলেন যে ‘এমনকি ঢাকা যা ইসলামাবাদের জন্য নিরাপদ ছিল তাও এখন আর পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য ততটা নিরাপদ নয়। আমাদের সংগ্রামে আমরা যথেষ্ট সফলতা অর্জন করেছি।’ তার সহকর্মী, জনাব আমজাদুল হক পশ্চিম পাকিস্তানকে হুঁশিয়ার করে দিয়ে বলেন যে শেখ মুজিবুর রহমানের কোন ক্ষতি করা হলে সেটা শান্তির প্রতি হুমকি তৈরি করবে কারণ তিনি শুধু বাংলাদেশের নন, সারা পৃথিবীর। জনাব সাহাবুদ্দিন বলেন যে মুক্তিযোদ্ধাদের সফলতা পাকিস্তান আর্মির সদস্যদের ক্যান্টনমেন্টের সীমানার মধ্যে থাকতে বাধ্য করছে। ‘পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণ শুধু ক্যান্টনমেন্টের মধ্যে সীমাবদ্ধ।’ জনাব হক, বাংলাদেশ ইস্যুর রাজনৈতিক সমাধানের পূর্বশর্ত হিসেবে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ও ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি কর্তৃক সামনে আনা ৪-দফা প্রস্তাব পুনরায় ব্যক্ত করেন। সেগুলো হলো : পশ্চিম পাকিস্তান কর্তৃক বাংলাদেশ কে স্বীকৃতি দান, বিনাশর্তে শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তি, আক্রমণকারী সেনাদল সরিয়ে নেয়া এবং পাকিস্তান সেনাবাহিনী দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের সকল ক্ষতির জন্য ক্ষতিপূরণ প্রদান করা। জনাব সাহাবুদ্দিন এবং জনাব হক উভয়ই ঘোষণা করেন যে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সংগ্রামে ‘আমরা আর নিরস্ত্র, অপ্রশিক্ষিত এবং অসহায় নই।’ নরওয়ে থেকে প্রকাশিত ‘দ্য ব্লাডেট’এর ‘পূর্ব বাংলার অধিবাসীদের সাহায্য করুন’ শিরোনামের সম্পাদকীয় নিবন্ধ থেকে জানা যায়, পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের ওপর যে আঘাত করা হয়েছে সেটি বিশ্বব্যাপী এখনো তেমনভাবে অনুভূত হয়নি। বছরের শেষে ১০ মিলিয়ন মানুষ দেশ ছেড়েছেন এবং প্রতিবেশী দেশ ভারত, যেখানে উদ্বাস্তুরা অবস্থান করছে সেখানে তারা প্রচুর পুষ্টির সমস্যার সম্মুখীন। সেখানে যারা কাজ করছেন তারা বলছেন যে এখন পর্যন্ত এক লাখ শিশু খাদ্যের অভাবে মৃত্যু ঝুঁকিতে আছে। যদি দ্রুত খাদ্যের ব্যবস্থা না করা হয় তবে, তারা মৃত্যু মুখে ঝুঁকে পড়বে। পশ্চিমবঙ্গের ভারতীয়রা প্রায় ৩ মিলিয়ন শরণার্থীর জন্য ক্যাম্পে যায়গা করেছে। এই ভারতীয় রাজ্যে ৫ মিলিয়ন শরণার্থী এসেছে। এর অর্থ হচ্ছে ২ মিলিয়নেরও বেশি লোক গ্রামাঞ্চলে রাস্তায়, শহরে এবং অন্যান্য স্থানে বসবাস করছে যেখানে একটু থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। ক্ষুধা ছাড়াও কলেরা এখনও আছে। মহামারী একটি নির্দিষ্ট মাত্রায় স্থিত হয়েছে। তবে রোগবালাই এখনও যারা দুর্বল রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা সম্পন্ন ও অপুষ্টিতে ভুগছে তাদের আক্রমণ করছে। সবচেয়ে কম রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা সম্পন্ন হলো শিশুরা। এদের প্রায় একলাখ সরাসরি মৃত্যু ঝুঁকিতে আছে। প্রায় ৩ লাখ শিশু অপুষ্টিতে আছে। এই পরিসংখ্যানগুলোতে একটি ট্র্যাজেডি রয়েছে যা বাইরের লোকের পক্ষে বোঝা সম্ভব না। এটির বিস্তার এত বিশাল যে তা বায়াফ্রার ঘটনাকেও ছাড়িয়ে যায়। এই ত্রাণ কাজ এতদূর পর্যন্ত যথেষ্ট হয়েছে কিন্তু তা পর্যাপ্ত নয়। প্রায় অর্ধ বিলিয়ন নরওয়েজিয়ান ক্রোনারের মতো সাহায্য প্রদান করা হয়েছে। এতে বোঝা যায় এই ট্র্যাজেডির বিশালতা এবং এটা চাহিদা থেকে অনেক নগণ্য। এই মাসের শেষে, ইউএন-এর রিফিউজি কমিশনকে আরও ৭০০ মিলিয়ন ক্রোনার দিতে হবে যদি এটাকে সচল রাখতে হয়। এটি এই অসম্পূর্ণ ব্যাকগ্রাউন্ডের ভিত্তিতে যে ৫টি নরওয়েজিয়ান রিলিফ সংস্থা নরওয়েতে তাদের বৃহৎ সংগ্রহের প্রচারাভিযান শুরু করেছে এবং ২০ সেপ্টেম্বর নির্বাচন দিবসে, ১ হাজার স্বেচ্ছাসেবক নির্বাচনী এলাকার বাইরে থাকবে এবং ৮০ শতাংশ ভোটদাতার কাছে সাহায্য চাইবে যারা সেদিনের নির্বাচনে ভোট দিতে আসবে। আমরা আশা করি যে প্রত্যেকের কিছু না কিছু দেবার ক্ষমতা আছে। দৈনিক হিন্দুস্তান স্ট্যান্ডার্ডে বাংলাদেশ অভিমুখে ‘স্বাধীনতার অভিযাত্রা’ শিরোনামের সংবাদভাষ্য থেকে জানা যায়, গান্ধী শান্তি ফাউন্ডেশন কর্তৃক অক্টোবর মাসে পূর্ববঙ্গের ’স্বাধীনতা অভিযাত্রা’ সংগঠিত হয়েছিল। অন্তত এক লাখ বাংলাদেশী উদ্বাস্তু যারা বিভিন্ন শিবিরে বসবাস করছে তারা দল প্রতি এক হাজারে তাদের বাড়িতে ফিরে যাবে এবং স্বাধীন বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে সেখানে বসবাস করবে। তারা পাকিস্তান সরকারের সঙ্গে সহযোগিতা করবে না এবং তাদের নিজেদের এলাকায় নিজেদের প্রশাসনকে সংগঠিত করবে। গুপ্তচরগিরি করা লাশ হিসেবে তাদের যেভাবে ডাকা হয়, প্রধান রাস্তা দিয়েই তাদের বাংলাদেশে সরানো হবে। সেই অভিযাত্রায় বিভিন্ন দেশের শান্তিবাদী কর্মীদের অংশগ্রহণ আশা করা হচ্ছে। দুই আমেরিকান, জনাব চার্লি ওয়াকার ও জনাব এ্যালেক্সান্ডার পল যারা পাকিস্তানী জাহাজ ‘পদ্মা’তে যুদ্ধের উপকরণ বোঝাই করাকে প্রতিহত করেছিলেন তারা ইতোমধ্যেই ভারতে পৌঁছেছেন। ‘অপারেশন ওমেগা’র কর্মীদেরও এই অভিযাত্রায় যোগদানের সম্ভাবনা বেশি। এই ফাউন্ডেশন ইতোমধ্যেই ৫০ জন তরুণকে নির্বাচিত করেছে যারা প্রতিজন হাজারো উদ্বাস্তুর নেতৃত্বে থাকবে। পাক বাহিনী এই অভিযাত্রার অভিমুখে বাধা সৃষ্টি করলে অভিযাত্রীরা কি করতে পারেন তা নিয়ে এই সম্মেলনে আলোচনা করা হয়েছে। এছাড়াও ‘ওমেগা’ প্রতিনিধি শান্তিবাদে বিশ্বাসী জনাব ওয়াকার তাদের সঙ্গে যোগ দেবেন। লেখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক [email protected]
×